তালিপাম : জীবন যেখানে মৃত্যুর গল্প শোনায়
তরিকুল ইসলাম রাহাত
একবার ভাবুন তো? আপনি জানেন যে আপনার অনাগত বংশধরই হবে আপনার মৃত্যুর কারণ । জন্মের সাথে সাথেই সে ছিনিয়ে নেবে আপনার জীবন। ভাবছেন, এ কি করে সম্ভব? আর যদিওবা সম্ভব হয়, কি দরকার এমন বংশধরের? যেখানে নতুন একটি জীবনের আবির্ভাবে আপনার নিজের জীবনই বিপন্ন হবার পথে, সেখানে আপনি চাইবেন না আপনার অযাচিত এই বংশধরটিকে । চাইবেন না সেই বংশধর আলোর মুখ দেখুক । সেটিই স্বাভাবিক হয়তো । নিজের জীবনকে বিপন্ন করে কে-ই বা চায় নতুন জীবনের সূচনা করতে? আর যখন আপনি জানবেন সংকোচ আছে আপনার বংশধরটির জীবন নিয়েও, অর্থাৎ সে টিকে থাকতে পারবে কি-না পৃথিবীর আলো-বাতাসে তা-ও ঠিক নিশ্চিত নয়; তখন? আপনাকে অনেক বড় একটি ধাঁধায় ফেলে দেওয়ার জন্য শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি ।
আপনার ক্ষেত্রে যেটি চিন্তা করাও কঠিন, সেই কাজটিই নিরবে নিভৃতে করে যাচ্ছে বিপন্ন একটি উদ্ভিদ । আপনাকে ভাবতে বলেছিলাম কেবল । এবার আসুন ভাবনা থেকে বের হয়ে আসি । গল্প শুনি বিলুপ্তপ্রায় এক উদ্ভিদের, গল্প শুনি উদারতার ।
লেখাটির শিরোনাম- জীবন যেখানে মৃত্যুর গল্প শোনায় । হ্যা, আমরা আপনাকে সেই গল্পই শোনাবো । যেখানে নতুন জীবনকে স্বাগত জানাতে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিচ্ছে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির এক উদ্ভিদ।
ইতিমধ্যেই IUCN কর্তৃক Extinct in the Wild ঘোষিত হওয়া উদ্ভিদটির নাম ‘তালিপাম’ । আকৃতিগত ভাবে তাল গাছের সাথে সাদৃশ্য থাকায় লোকমুখে এটি ‘বন্যতাল’ হিসেবেই পরিচিত । কেউ বলে না দিলে বা পার্থক্যগুলো ধরিয়ে না দিলে গাছটিকে তালগাছের সাথে পার্থক্য করা প্রায় অসম্ভব । Arecaceae গোত্রভুক্ত এই গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Corypha taliera, যার আদি আবাস মিয়ানমারে হলেও মূলত ভারত এবং বাংলাদেশেই চোখে পড়ে বেশি ।
উচ্চতায় প্রায় একশ ফিট পর্যন্ত লম্বা হওয়া একটি স্বাভাবিক তালিপাম উদ্ভিদ প্রায় শতবছরে একবার ফল দেয় । ফল পাকতে সময় নেয় বছরখানেক এবং ফল পাকার প্রায় সাথে সাথেই গাছটির মৃত্যু ঘটে । তালিপাম এমন একটি উদ্ভিদ জীবন যেখানে মৃত্যুর আমন্ত্রণপত্র সাথে নিয়ে আসে, আর এখানেই তালিপামের অনন্যতা । এর বিলুপ্ততার কারণও অবশ্য এটি ।
১৮১৯ সালে উইলিয়াম রক্সবার্গ নামক স্কটিশ বিজ্ঞানী ভারতে সর্বপ্রথম বৃক্ষটির অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন । বাংলাদেশে সর্বপ্রথম তালিপামের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, ১৯৫০ সালে । অনেকটা ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া উদ্ভিদটিকে সনাক্ত করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক এম. সালাম খান । পরবর্তীতে স্থানীয় বিজ্ঞানী শ্যামল কুমার বসুর সহায়তায় গাছটি বর্তমান উপ-উপাচার্য ভবনের বাসভবনের বেষ্টনীতে স্থান পায় । ২০০১ সালে উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত এই তালিপাম গাছটিকে পৃথিবীর সর্বশেষ বন্য তালিপাম গাছ হিসেবে চিহ্নিত করেন ।
২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গাছটিতে শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট পুষ্পমঞ্জরী বের হওয়ার পর অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ছোট ছোট ফুল আসতে থাকে । ২০০৯ সালের শুরুতে গাছটিতে ফল ধরে এবং ঠিক এক বছর পর একই বছরের অক্টোবর মাসে ফল পাকতে শুরু করে । আর তাতেই বেজে উঠে গাছটির বিদায়ের করুণ সুর । ফল পেকে ঝরে পড়তে থাকার সাথে সাথেই শুকিয়ে যেতে থাকে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো সর্বশেষ এই তালিপাম গাছটি ।
২০০৮ সালের ১৮ অক্টোবর ‘দৈনিক প্রথম আলো’ তে তালিপামটি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে গাছটি সেসময় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে । আর তাতে করে গাছটির নতুন প্রজন্মকে সংরক্ষণ করতে প্রকৃতি প্রেমিক ও বিভিন্ন বিপন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী সংগঠন এগিয়ে আসে । গাছটি মারা যায় ২০১২ সালে । কিন্তু মারা যাওয়ার আগে প্রচুর ফল উৎপাদন করায় সেগুলো থেকে প্রাপ্ত চারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যভবন সহ বেশ কিছু জায়গায় রোপন করা হয়েছে । ঢাকার মতিঝিলে অবস্থিত নটর ডেম কলেজ চত্বরে নটর ডেম নেচার স্টাডি ক্লাবের উদ্যোগে তিনটি তালিপাম চারা রোপন করা হয়েছে । সব মিলিয়ে সারা বাংলাদেশে প্রায় ৫০০ তালিপাম বেড়ে উঠছে উদারতার জয়গান গাওয়ার জন্য ।
জীবনের জয়গান গেয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া এই উদ্ভিদটি বাংলাদেশ তথা এই অঞ্চলের এন্ডেমিক উদ্ভিদ । যেহেতু বাংলাদেশ ব্যতীত পৃথিবীর আর কোন দেশে বর্তমানে এর অস্তিত্ব নেই, তাই এটি আমাদের সম্পদ । আমাদের ঐতিহ্য । গুরুত্বপূর্ণ ঔষধি গুণসম্পন্ন এই উদ্ভিদটিকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন সচেতনতা । কেবল সচেতনতা নয়, পাশাপাশি প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় এই উদ্ভিদটিকে বিলুপ্ত হওয়া থেকে বাঁচাতে পারি আমরা । হ্যা, আমরাই । বেঁচে থাকুক তালিপাম । প্রকৃতির এই সম্পদ থেকে ভবিষ্যত গবেষণায় আরো উল্লেখযোগ্য ঔষধি উপাদান আবিষ্কৃত হোক ।
তালিপাম গেয়ে যাক জীবনের জয়গান ।
বিধাতার সৃষ্টি আসলেই বিচিত্রতায় পরিপূর্ণ ।