
ভালো নেই প্রাণের শহর ঢাকা!
মাহবুব রেজওয়ান সানি
আমাদের প্রাণের শহর, ঢাকা শহর। প্রায় দেড়কোটি মানুষের এই শহরের আনাচে-কানাচে, অলিতে-গলিতে কতো বিচিত্র গল্পই না ছড়িয়ে আছে! একটু ভালো থাকার তাগিদে,উন্নত সুযোগ-সুবিধার আশায় প্রতিদিন কতো মানুষ যে ঠাই নিচ্ছে এই শহরের কোলে, তার কোন হিসেব নেই। যাকে ঘিরে আমাদের এতো স্বপ্ন, এতো আশা; তাকে কি আদৌ ভালো রাখতে পারছি আমরা! আমরা কি একটু খবর নেই? কেমন আছে আমাদের ভালোবাসার শহরটি!
যানজটের যন্ত্রণা আর ধূলাবালিতে ঢাকা এই ঢাকা শহরকে চলতে ফিরতে যতই গালি দেই না কেন, আসলে আমরা সবাই কিন্তু খুব ভালোবাসি এই শহরটিকে। ভালোবাসার মানুষকে অবহেলা করলে যেমন মানুষটি কষ্ট পায়, আমাদের ছোট ছোট কিছু অবহেলার কারণে আমাদের ভালোবাসার এই ঢাকা শহরটিও কিন্তু কষ্ট পাচ্ছে। এতোটাই যে ধীরে ধীরে বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা।সম্প্রতি, যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) বৈশ্বিক বাসযোগ্যতা শীর্ষক জরিপের ফলাফলে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বাসযোগ্যতার মাপকাঠিতে ঢাকা দ্বিতীয়বারের মতো নিচের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে। এই তালিকায় সবচেয়ে নিচে স্থান পেয়েছে গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক। গত বছরের ফলাফলও কিন্তু একইরকম ছিল। অর্থাৎ, বেশ লম্বা সময় ধরেই কিন্তু মুমূর্ষু রোগীর মতো কোনমতে ‘বেঁচে’ আছে আমাদের প্রাণের এই শহরটি।আর এই তালিকায় শীর্ষে আছে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহর। শীর্ষ ১০ শহরের মধ্যে চারটিই অস্ট্রেলিয়ার শহর। বাকি তিনটি হলো: অ্যাডিলেড, সিডনি ও পার্থ। বাসযোগ্যতার তালিকায় ১ থেকে ১০-এর মধ্যে এশিয়ারএকটি শহরও নেই।
বাসযোগ্যতা নির্ধারণে পাঁচটি মানদণ্ড ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলো হলো: স্থায়িত্ব, স্বাস্থ্য পরিষেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামো। অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা বলতে গেলে আসলে হতাশ হতে হয়। আমাদের ঢাকা শহরে হয়তো অনেক উঁচু দালান রয়েছে, কিন্তু বেশিরভাগই অত্যন্ত অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। তাছাড়া, অনেক ক্ষেত্রেই আজকাল দেখা যাচ্ছে আইনের ফাঁক গলেও অনেকেই অনুমোদন ব্যাতিত উঁচু দালান তৈরি করছেন। যা একই সাথে আমাদের নিজেদের জীবন এবং মাটির স্বাস্থ্যের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ। যত্রতত্র এসব দালান গড়ে ওঠায় রাস্তায় প্রচণ্ড যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু তথাকথিত এই সব দালানের বেশিরভাগের নিজস্ব পার্কিংলট নেই। যার কারণে যানজট আরও বেশি হচ্ছে।
জীবিকার তাগিদে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ ঢাকা শহরে প্রবেশ করছে। জনসংখ্যা ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত হওয়ার কারণে একই সাথে যেমন তাদের পর্যাপ্ত আবাসের ব্যাবস্থা করা সম্ভব হচ্ছে না, তেমনি এই বর্ধিত জনসংখ্যার স্বাস্থ্য পরিষেবাও চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
উন্নত পড়াশোনার জন্য প্রতিবছর বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় এক লাখ ছাত্র ঢাকা শহরে ঠাই নিচ্ছে। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবে অনেকেই জেনে, না জেনে নিম্নমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা নিতে বাধ্য হচ্ছে। এতে করে কি লাখ লাখ ছাত্রের ভবিষ্যৎ জীবনজাত্রার মান আরও নিচে নেমে যাচ্ছে না?
আর পরিবেশ দূষণ! যে শহরের সাথে যানজট আর জনসংখ্যার বাড়াবাড়ি রকম সখ্যতা, সেখানকার পরিবেশ আর কতোটাই বা বিশুদ্ধ থাকতে পারে! যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলার কারণে পানি নিষ্কাশন ও পয়োঃনিষ্কাশনের রাস্তাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বর্ধিত জনসংখ্যার স্থান সংকুলানের জন্য খাল ভরাট করে নতুন নতুন আবাস তৈরি করা হচ্ছে। এতে করে সামান্য বৃষ্টিতেই ঢাকা শহর যেন মোটামুটি একটি খালে পরিণত হয়ে যায়! এর প্রভাবে যেমন মশা-মাছির প্রকোপ বাড়ছে। তেমনি পানি বাহিত নানারকম রোগে আক্রান্ত হচ্ছে আমাদের এই শহরের বাসিন্দারা।
সরকার যেমন দায় এড়াতে পারে না, তেমনি আমাদেরও দায় এড়ানোর কোন সুযোগ নেই। আমরা প্রত্যেকে যদি আলাদাভাবে সচেতন হতাম, প্রত্যেকে যদি নিজেদের কাজগুলো সঠিকভাবে পালন করতাম, তাহলে হয়তো বিশ্ব দরবারে ঢাকা শহরকে এভাবে উপস্থিত হতে হতো না। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও আইনের শাসনের অভাবও বর্তমান পরিস্থিতির জন্য বহুলাংশে দায়ী। আমরা কি চাইলে পারি না, আমাদের ভালোবাসার ঢাকা শহরকে বিশ্ব দরবারে খানিকটা ভদ্রস্থ চেহারায় উপস্থাপন করতে!!