
বলুন তো, ফড়িং কতো প্রকার ??? !!!
শাওন চৌধুরী
ছোটবেলাতে ফড়িং নিয়ে খেলা করেনি এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, অন্তত একদিনের জন্য হলেও কেও না কেও খেলেছে। শহুরে লোকের ক্ষেত্রে এই হার কম হলেও গ্রামের লোকেদের ক্ষেত্রে শতভাগ সত্য। হাত দিয়ে ফড়িং ধরে অনেকে দেখে যে সে কয় প্রজাতির ফড়িং ধরতে পারে! আজকে ফড়িং ধরার কথা না বরং ফড়িং সম্পর্কে কিছু মজার গল্প বলতে চেষ্টা করবো।
ফড়িং দু’ধরণের হতে পারে, ড্রাগনফ্লাই ও ড্যামসেলফ্লাই এবং দু’ধরণের ফড়িংই ওডোনাটা নামক বর্গের অন্তর্গত। ওডোনাটা হচ্ছে একটা গ্রীক শব্দ, ফ্যাব্রিসিয়াস সর্বপ্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। এর অর্থ হচ্ছে, ‘দাঁতযুক্ত’, নীচের চোয়ালে দাঁত থাকার কারণেই এরকম নামকরণ। ড্রাগনফ্লাই অ্যানাইসোপ্টেরা এবং ড্যামসেলফ্লাই জাইগোপ্টেরা নামক উপবর্গের অন্তর্গত। প্রধানত এদের আকার, স্বভাব ও বাসস্থানে অনেক পার্থক্য থাকার কারণেই এরকম করে বিভক্ত করা হয়েছে। ওডোনাটা বর্গের অধীনে প্রায় ৫৯০০ প্রজাতি রয়েছে যার সিংহভাগই হচ্ছে ড্রাগনফ্লাই।
* ড্রাগনফ্লাই ও ড্যামসেলফ্লাই উভয়েই ফড়িং তবে এদের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে। আসুন এগুলো জেনে নেয়া যাক…
ড্রাগনফ্লাইয়ের বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই চোখদুটি একে অপরকে স্পর্শ করে কিংবা সংলগ্ন থাকে। ড্যামসেলফ্লাইয়ের ক্ষেত্রে, চোখগুলো মাথার দু’প্রান্তে থাকে।
ড্রাগনফ্লাইগুলো ড্যামসেলফ্লাইয়ের তুলনায় আকারে বড় ও মোটা হয়। ড্যামসেলফ্লাইগুলো লম্বা কিন্তু অনেক চিকন প্রকৃতির হয়ে থাকে।
ড্রাগনফ্লাইয়ের সামনে পাখা জোড়া পেছনের পাখা থেকে বড় হয় এবং বিশ্রামরত অবস্থায় পাখাগুলো ছড়ানোই থাকে। পক্ষান্তরে ড্যামসেলফ্লাইয়ের সামনের ও পেছনের পাখাগুলো আকারে সমান হয়ে থাকে এবং বিশ্রামের সময়ে উদরের ওপরে একসাথে ভাজ করা থাকে।
* একটা ড্রাগনফ্লাই কয়েকবছর বাঁচতে পারে, অনেকেই হয়তো ভেবে নিয়েছেন, আমরা যেই ফড়িংকে দেখি সেটা এতোদিন বাঁচে! আসলে তা না, এদের জীবনচক্র সম্পন্ন হতে এতো সময় লাগে। এদের জীবনচক্রে তিনটা ধাপ রয়েছে, ডিম, নিম্ফ এবং পূর্ণাংগ ড্রাগনফ্লাই। আমরা যা দেখি সেটা হচ্ছে পরিণত ড্রাগনফ্লাই কারণ জীবনচক্রের বাকি ধাপগুলো পানিতে সম্পন্ন হয়। একারণেই পানির চারপাশে এদের বেশি দেখা মেলে।
সাধারণত উড়ন্ত অবস্থায় এসব ড্রাগনফ্লাই মিলনে অংশ নেয়। মিলনের পরে স্ত্রী সদস্য পানিতে যেয়ে উপযুক্ত ছোট উদ্ভিদের কান্ডে বা পাতায় ছিদ্র করে ডিম পাড়ে। যদি উপযুক্ত উদ্ভিদ না পায় তাহলে সাধারনত পানিতেই ডিম পাড়ে। হ্যাচিং এর পরে এরা নিম্ফে পরিণত হয়। এদেরকে তখন দেখতে অনেকটাই বাইরের পৃথিবী থেকে আগত কোন প্রাণির মতোন মনে হয়। পরিণত অবস্থার আগ পর্যন্ত এরা পানিতেই অবস্থান করে। কিছু কিছু প্রজাতিতে পূর্ণাংগ হতে প্রায় চার বছর সময় লাগে। স্রোতযুক্ত নদীর তুলনায় এরা পুকুরে বা স্রোতহীন জলাশয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করে কারণ সেখানকার পানি অনেক শান্ত হয়। নিম্ফ অবস্থায় এরা মশার লার্ভা, পানিতে বসবাসরত নানান রকম ছোট পতঙ্গ এমনকি অন্য ছোট ড্রাগনফ্লাইয়ের নিম্ফও খেয়ে থাকে। নিম্ফ যখন পরিণত হয় তখন বারবার রূপান্তরের মাধ্যমে এদের গায়ের আবরণের পরিবর্তন ঘটাতে থাকে এবং চারপাশের আবহাওয়া এবং তাপমাত্রা যখন ঠিক থাকে তখন পানির ঐ উদ্ভিদের কান্ডের ওপরে চলে আসে এবং এক্সুভিয়া বা খোলস ত্যাগ করে ওপরে উঠে আসে। ভাল করে খেয়াল করলে অনেক উদ্ভিদেই এই এক্সুভিয়ার দেখা মেলে। এরপর এদের পূর্ণাংগ অবস্থার সূচনা ঘটে তখন এরা পানি থেকে ডাঙ্গায় উঠে আসে। এসময় এদের প্রধান কাজ হচ্ছে খাবার শিকার করা ও মিলনসংগী খুঁজে বের করা। এরা মাত্র ত্রিশ মিনিটে এদের শরীরের সমান খাবার খেতে পারে!! পরিণত অবস্থায় এরা মাত্র দু’মাস বাঁচে।
ড্যামসেলফ্লাইয়ের জীবনচক্র অনেকটাই ড্রাগনফ্লাইদের মতোনই। এদের জীবনচক্রেও ডিম, নিম্ফ ও পূর্ণাংগ অবস্থা, এই তিন পর্যায়ই থাকে। এদের ডিম ড্রাগনফ্লাইয়ের তুলনায় অনেক ছোট হবার কারণে এরা পানিতে ডিম পাড়তে পারে না, ছোট ছোট পানিতে বিদ্যমান উদ্ভিদের কান্ডে বা পাতায় ছিদ্র করেই ডিম পাড়ে। এসব ডিম হ্যাচ হতে প্রায় এক থেকে তিন সপ্তাহ সময় লাগে। নিম্ফ অবস্থাতে এরা প্রায় তিন মাস থেকে তিন বছর সময় অতিবাহিত করে। ড্রাগনফ্লাই নিম্ফের মতোন এরাও খাবার হিসেবে মশার লার্ভা, ছোট ছোট পানির পতংগ কিংবা ক্ষুদ্র মাছ খেয়ে থাকে। পরিণত হবার পূর্ব পর্যন্ত পাঁচ থেকে পনেরবার এরা শরীরের বাইরের আবরণ ত্যাগ করে। পরিণত অবস্থায় এরা তিন সপ্তাহ থেকে শুরু করে সাত মাস পর্যন্ত বেঁচে থাকে। ড্রাগনফ্লাইয়ের মতোন এরাও মাংসাশী।
* এ পর্যন্ত প্রাপ্ত সবথেকে বড় ওডোনাটান হচ্ছে মধ্য আমেরিকাতে প্রাপ্ত হেলিকপ্টার ড্যামসেলফ্লাই (Megaloprepus coerulatus) যা কিনা ১৯১ মিমি হয়ে থাকে। সবথেকে ভারী ওডোনাটান হচ্ছে, Tetracanthagyna plagiata ও Petalura ingentissima, যারা কিনা যথাক্রমে ১৬৫ ও ১১৭ মিমি হয়ে থাকে। টিলিয়ার্ড এর মতে, Southern Giant Darner ঘন্টাপ্রতি প্রায় ৬৫ মাইল বেগে উড়তে পারে।
* আসুন, ড্রাগনফ্লাই ও ড্যামসেলফ্লাই সম্পর্কে মজার কিছু তথ্য জেনে নেয়া যাক।
অনেকেই হয়তো ধরে নিতে পারেন যে হয়ত বা কয়েকশত বছর আগে এদের আবির্ভাব ঘটেছিল কিন্ত এটা জানলে অবাক হবেন যে, ডাইনোসরের অনেক আগেই পৃথিবীতে এদের আবির্ভাব ঘটেছিল যদিও তখন এরা গ্রিফেনফ্লাই নামে পরিচিত ছিল। কার্বনিফেরাস যুগে, প্রায় ৩০০ মিলিয়ন বছর পূর্বে এদের আগমন ঘটেছিল।
অনেকেই দেখে থাকবেন যে এদেরকে পুকুর কিংবা জলাশয়ের ধারেকাছে কেন দেখা যায়! আসলে এদের জীবনচক্রের সিংহভাগ এসব জলাশয়ে সম্পন্ন হবার কারণেই এখানে এদের বেশি দেখা মেলে।
শুনলে অবাক হবেন যে, এরা পায়ুপথের সাহায্যে শ্বাস গ্রহণ করে!! না, ভূল শুনছেন না, সত্যি এরকমটাই ঘটে। নিম্ফ অবস্থায় মলাশয়ের মধ্যে এদের গিলস থাকার কারণেই ঐ পর্যায়ে এরা পায়ুপথের সাহায্যে শ্বাস নেয়।
নিম্ফ থেকে পরিণত হবার আগে এরা পানি সংলগ্ন কোন পাথর কিংবা ছোট উদ্ভিদের কান্ডে উঠে এসে শেষবারের মতোন শরীরের আবরণ ত্যাগ করে। এটা করতে এদের প্রায় ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করতে হয়। তখন এদের শরীর অনেক নরম হয়ে থাকে এবং শক্ত হতে অনেক সময়ের প্রয়োজন, কয়েক দিন লাগে। শরীর নরম থাকার কারণে এরা ভাল করে উড়তেও পারেনা যার কারণে বেশীরভাগ ওডোনাটানই এসময়ে শিকারে পরিণত হয়। শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ ফড়িং-ই এভাবে মারা যায়!
এদের দৃষ্টিশক্তি অসাধারণ। মাথার প্রায় পুরোটা জুড়েই এদের চোখ থাকার কারণে এরা প্রায় ৩৬০ ডিগ্রী কোণে সবকিছু দেখতে পারে। একটা চোখে প্রায় ৩০০০০ লেন্স থাকে। এরা এদের মস্তিষ্কের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই দর্শণকার্যে ব্যবহার করে। এরা মানুষের থেকে অনেক বেশি তরংগদৈর্ঘের আলো দেখতে পারে যার কারণে অনেক সহজেই বিভিন্ন ধরণের আলোর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে।
ড্রাগনফ্লাইগুলো এদের চারটি পাখার প্রতিটা পৃথকভাবে নাড়াতে পারে। প্রতিটা পাখা ওপর-নিচ করা ছাড়াও এদের পাখাকে অক্ষ বরাবর ঘোরাতে পারে। এরা ওপর-নিচ, সামনে পেছনে সমানে যেতে পারে এমনকি কিছু কিছু অবস্থায় পাখিদের মতোন হোভারিংও (পাখা নাড়িয়ে একই স্থানে স্থির থাকা) করতে পারে। আর কোন পতংগের এরকম ক্ষমতা নেই। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির কিছু গবেষক এদের চলাফেরা ও একই সাথে শিকার ধরার বিষয়টি গবেষণা করেছেন। অনেক শাটার স্পিড সম্পন্ন ক্যামেরার সাহায্যে এরা দেখতে পেরেছেন যে শিকার ধরার জন্য উড়ে গিয়ে, শিকার ধরে আবার স্থির হতে এদের মাত্র এক থেকে দেড় সেকেন্ড সময় লাগে।
অন্যান্য প্রাণিদের মতোন এদেরও নির্দিষ্ট সীমানা থাকে এবং এই সীমানার মধ্যে অন্য কোন পুরুষ সদস্য এসে পড়লে তখন একজন আরেকজনকে তাড়িয়ে দেয়। যখন স্ত্রী সদস্য ভাবে যে মিলনে অংশ নিবে তখন পুরুষ সদস্যের সীমানাতে প্রবেশ করে এবং ঐ পুরুষ সদস্য কতোটা আকর্ষণীয় তা দেখার পরে মিলনে অংশ নেয়। মিলনের পরে স্ত্রী সদস্য পানিতে ডিম পেরে এসে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে আবার উড়তে শুরু করে। মিলনের পর থেকে ডিম পাড়ার পূর্ব পর্যন্ত ঐ পুরুষ সদস্য পাহাড়ারত থাকে যেন আর কোন পুরুষ সদস্যের সাথে ঐ স্ত্রী সদস্য মিলনে অংশ না নিতে পারে!
বেশীরভাগ পুরুষ পতংগেরই যৌনাংগ উদরের ওপরের দিকে থাকে কিন্তু ড্রাগনফ্লাইয়ের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে না। এদের কপুলেটরি অর্গান উদরের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগের নীচে থাকে যদিও এদের শুক্রাণু উদরের নবম ভাগের প্রবেশপথে থাকে। মিলনের পূর্বে উদর ভাঁজ করে এরা যৌনাংগে শুক্রাণুগুলো নিয়ে নেয়।
অনেকেই হয়তো ভেবে থাকতে পারেন যে, মোনার্ক বাটারফ্লাইই মাইগ্রশন এর সময়ে পতংগদের মধ্যে সবথেকে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে! কিন্তু শুনলে অবাক হবেন যে, Globe Skimmer নামক ড্রাগনফ্লাই মাইগ্রেশনের সময়ে ভারত সাগরের ওপর দিয়ে প্রায় ১১০০০ মাইল পথ অতিক্রম করে।
অন্যান্য পতংগের মতোন এরাও শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণি হলেও শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য এদের প্রকৃতির ওপরে নির্ভরশীল হতে হয় না বরং নিজেরাই সূর্যের আলোর সাথে পাখাকে নানান ভাবে কাজে লাগিয়ে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
একসময় আমাদের দেশে ঝাঁকে ঝাঁকে ফড়িং উড়ে যেতে দেখা যেত কিন্তু এখন এটা অলীক কল্পনা মাত্র। সমগ্র পৃথিবীতে যেখানে প্রায় ৫৯০০ প্রজাতি পাওয়া যায় সেখানে বাংলাদেশে এদের সংখ্যা মাত্র দু’শোর কাছাকাছি। নির্বিচারে গাছপালা নিধন, পুকুর ভরাট ও বাসস্থান ধ্বংসের কারণে এদের সংখ্যা এখন অনেক কমে গেছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধরে রাখতে এদের অবদান অনেক। যদি আমরা সচেতন না হই তাহলে হয়তো সেদিন খুব বেশি দূরে নেই যেদিন জাদুঘরে যেয়ে ফড়িং দেখতে হবে!