ডিসরাপশনঃ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক বিদ্রোহের ডাক

মনিজা মনজুর

“এই যে, শুনছেন? এই যে, আমি এখানে। চাঁদ থেকে বলছি। কি বিশ্বাস হচ্ছে না? আরে এতো অবাক হওয়ার কি আছে? পৃথিবী তো আমাকে থাকতে দিচ্ছে না! তাই চাঁদে চলে এলাম। জানিনা কতদিন টিকে থাকব!!! এখানে সবুজ নেই, বৃষ্টি নেই,  ব্যাঙের ডাক নেই! খুব মনে পড়ে পৃথিবীটার কথা! এখনও কি গাছে সবুজ পাতা দেখা যায়?টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শোনা যায়? কে জানে?”

প্রিয় পাঠক,এটি একটি কাল্পনিক চিঠি।অবাক হচ্ছেন চিঠিটা পড়ে?একদিন হয়তো আপনার অথবা আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও এমনই একটা চিঠি লিখতে হতে পারে পৃথিবীকে উদ্দেশ্য করে। কেন?

কারণটা হয়তো আপনি নিজেই!! ক্রমাগত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবী আজ মারাত্মক হুমকির মুখে। যদি সতর্ক না হন, তাহলে আপনাকেই আপনার পৃথিবী আর জায়গা দিবে না।!! জলবায়ু পরিবর্তন আজ আর কোনো নতুন ঘটনা নয়। প্রতিনিয়ত মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে, হচ্ছে কোটি টাকা খরচ করে বনেদী রাষ্ট্রগুলোর সম্মেলন। কিন্তু আমরা কি পারছি বৈশ্বিক উষ্ণতাকে  দমিয়ে রাখতে? আদৌ লাভ হচ্ছে কি বড় সম্মেলনের আয়োজন করে, নিত্য নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এবং আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনকে সামনে রেখে নির্মিত হয়েছে একটি তথ্যচিত্র, যার নাম ‘ডিসরাপশন(Disruption)’, মুক্তি পায় ৭ সেপ্টেম্বর,২০১৪।

10599335_10152725884736103_8362940649773469794_n

তথ্যচিত্রটি মূলত তৈরী করা হয়েছে একটি পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে।জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় এ পদযাত্রাটি হতে যাচ্ছে আগামী ২১ সেপ্টেম্বর,২০১৪। যেখানে অংশ নিচ্ছে রিও, দিল্লী,বার্লিন,প্যারিস,নিরইয়র্ক এবং লন্ডনের মত শহরগুলো। এই কর্মসূচি শুধুমাত্র পৃথিবীকে বাঁচানোর নয়,পৃথিবীর শৃঙ্খলা রক্ষার কর্মসূচি।এখনই সময় বদলানোর,সঠিক ইঙ্গিতটি মানুষের কাছে পৌঁছানোর।আমরাই প্রথম এবং শেষ প্রজন্ম  যারা একই সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অনুভব করছি এবং আমাদেরই এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত। কারণ, আগামী দুই বছরে আর কোনো জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে না। নিজের প্রাপ্য বুঝে নেওয়ার সময় এখনই।

তথ্যচিত্রে কথা বলেছেন বিশ্বের নামকরা সব পরিবেশবিদ এবং বিজ্ঞানীরা। এই তালিকায় আছেন- লেসলি ক্যাগান,কেয়া চ্যাটার্জী,হেইডি কুলেন,জাস্টিন গিলিস,ডঃ জেমস হ্যান্সেন, ভ্যান জোন্স, ডেনিস হায়েস, নাওমি ক্লেইন,রিকেন প্যাটেল,বিল ম্যাকবেন,জিনেট টুমার সহ আরো অনেকে।

350.org নামের প্রতিষ্ঠানটির সহায়তায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে  ‘People’s climate march and mobilization’ নামের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ। 350.org এর মতে, পরিবেশের ভয়ঙ্কর ইঙ্গিতগুলো জলবায়ু পরিবর্তন করে তা ধারন ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, সেই সাথে তা মানুষের স্থিতাবস্থার ব্যাঘাত ঘটায়। তাই এখনি সময় সাহসী পদক্ষেপ নেওয়ার।জলবায়ু পরিবর্তন মানেই শুধুমাত্র পরিবেশ নিয়ে মাথাব্যথা, তা নয়। এর সাথে জড়িত সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারও। বিশ্বের বড় রাষ্ট্রগুলোর যথেচ্ছাকৃত কার্বন ব্যবহারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে ছোট দেশগুলো, জলবায়ু পরিবর্তনে যাদের ভূমিকা নেই বললেই চলে। প্রতিবছর অনেক সম্মেলন, অনেক নীতিমালা প্রণয়ন করে একরকম প্রহসনের আয়োজন করা হয়। যার সিংহভাগ আশার আলো দেখেনি। উল্টো ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়েই চলেছে।কিভাবে ক্ষতি হচ্ছে তার বিস্তারিত তথ্যচিত্রটি দেখলে জানতে পারবেন। ওদিকে প্রতিবাদ করতে গিয়ে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে কারাবরণ করতে হয়েছে অনেক পরিবেশপ্রেমীকে।

10406368_10152650480447708_2930954779247970433_n

১৮২৪ সালে বিজ্ঞানী জোসেফ ফুরিয়ার গ্রীন হাউস ইফেক্ট এর কথা বলেছেন।এরপর ১৮৫০ সালে জন টিনডাল ধারনা দিয়ে গেছেন, ‘Absorption of heat radiation by carbon di oxide’ নিয়ে। ১৯৫৮ সালে চার্লস কিলিং ‘কিলিং কার্ভ” নামে একটি লেখচিত্র দেন, যা সময়ের সাথে কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ নির্দেশ করে।এটি আজও প্রচলিত এবং দ্রুতহারে বাড়ছে কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনমাত্রা।এরপর আরো গবেষনা, আরো অনেক আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু মানুষের সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞে জলবায়ু তার নিয়মের বাইরে চলে যাচ্ছে। যার প্রতিদানে প্রতিনিয়ত সম্মুখীন হতে হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের।এ থেকে বোঝা যায়, আমরা অনেক কিছুই জানি, কিন্তু এর সমাধান নিরুপনের বেলায় আমরা অনেক কৃপণ!!

mlo_full_record

 

প্রায় ৫২ মিনিটের এই তথ্যচিত্রে, “New York City Environmental Justice Alliance” এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এডি বাতিস্তার মতে,“এটি শুধু পরিবেশ নিয়েই নয়,এটি সমাজকে নিয়ে,এটি আমাদের দায়িত্ব নিয়ে, এটি অধিকার নিয়ে।” “This Changes Everything: Capitalism Vs. Climate” বইয়ের লেখক নাওমি ক্লেইন তার বক্তব্যে বলেছেন,“বৈশ্বিক উষ্ণতার এই যুগে জলবায়ু সংকটের চাহিদা মোকাবেলায় যে সকল সুযোগ আছে তার মধ্যে রয়েছে-দ্রুত নবায়নযোগ্য শক্তি সম্প্রসারন,অধিক সতর্কিত এবং স্বল্প ধ্বংসাত্মক অর্থনীতি এবং কর্পোরেট আধিপত্য থেকে গণতন্ত্র কে রক্ষা করা”।

আমরা যারা পৃথিবীর আশ্রয়ে আশ্রিত তাদের প্রত্যেকেরই তথ্যচিত্রটি দেখা প্রয়োজন।অতীতে অনেক বড় বিপ্লব ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে।আজ নতুন একটি ইতিহাস লেখার সময়। আর বিপ্লবে মানুষের চেয়ে বড় শক্তি কিছু নেই। আওয়াজ তুলুন, পরিবেশের বিষয় থেকে একে আপনার রাজনৈতিক অধিকারে রূপ দিন। নতুবা চাঁদে গিয়ে পৃথিবীর ঠিকানায় চিঠি লিখতে হতে পারে!!!

তথ্যচিত্রটি দেখতে পাবেন এই লিঙ্কেঃ http://watchdisruption.com/

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics