
হুমকীর মুখে ইরাবতী ডলফিন !
লিসান আসিব খান
“ঢেউয়ের সাথে খুনসুটি তার
বুদ্ধির জন্য খ্যাতি
খেলোয়াড় সুলভ মানসিকতার অধিকারী
পানির রাজা ডলফিন”
নীল আকাশের নিচে উত্তাল সাগরের নোনা জল যখন আছড়ে পরে একে অপরের উপর, ঝিরি ঝিরি বাতাসে তৈরি হয় ফেনা আর দূর সাগরের নীলাভ অথৈ পানির মাঝে পানিতে দাপাদাপি করে বেড়ানো প্রণীটি যখন হয় ডলফিন তখন মনে হবে যেন সাগরে ঝাপ দিয়েই চলে যাই ডলফিনের দেশ।
মিঠা পানির ডলফিন বিশ্বের মধ্যে একমাত্র সুন্দরবন এলাকায় বাস করে। এসব ডলফিন বিশ্বের বিপন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলোর অন্যতম। কিন্তু আমাদের অজ্ঞতা এবং পরিবেশ বিরোধী কাজের জন্য আজ তারা হুমকির পথে । আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগে যেখানে শত শত ডলফিন দেখা যেত আজ সেইখানে হাতে গোনা কিছু সংখ্যক দেখা যায় মাত্র ।
ইরাবতী; যদিও একে কখনো কখনো ইরাবতী নদীর ডলফিন বলা হয় তবে এটি নদীর ডলফিন নয়, ইরাবতী ডলফিন মহাসাগরের ডলফিন। সমুদ্র উপকূলের কাছাকাছি, নদীর সাথে সংযোগস্থলে স্বাদু ও নোনা পানির মিশ্রণ আছে এমন এলাকায় এরা বসবাস করে। বর্তমানে পৃথিবীতে এদের সংখ্যা আনুমানিক ৭০০০ এর অধিক যার ৯০ শতাংশই বাংলাদেশে বসবাস করে। বাংলাদেশ বাইরের ইরাবতীকে মহাবিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আজ থেকে কয়েক বছর আগেও প্রাণিবিজ্ঞানীদের কাছে ইরাবতী ছিল স্বপ্ন , তারা মনে করতেন হয়তো বা ইরাবতীকে আর দেখা যাবে না এই পৃথিবীর বুকে । কিন্তু আশার আলো দেখান বাংলাদেশের একদল প্রাণিবিজ্ঞানী। বাংলাদেশের সুন্দরবন উপকূল জুড়ে বিরল প্রজাতির ৬ হাজার ডলফিন পাওয়ার খবরে বিশ্বজুড়ে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মধ্যে হইচই পড়ে গিয়েছিলো , তাদের মধ্যে ৫,৮৩২টি বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী পানিতে এবং ৪৫১টি সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের লবণাক্ত পানিতে বসবাস করতো । আরো পাওয়া গিয়েছিলো সাদা রঙের হাম্পব্যাক ডলফিন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য যেন তাদের পিছু ছাড়ল না। গত ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ফার্নেস তেল বোঝাই ট্যাংকার ডুবির পর তেল ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। তারপর থেকেই শ্যালা নদীতে ডলফিনের অভয়াশ্রমে আর আগের মত দেখা মিলছে না ইরাবতীসহ ছয় প্রজাতির ডলফিনের। এছাড়া ফার্নেস তেল দুর্ঘটনার আগে ৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর চাঁদপাই রেঞ্জে দুইটি সিমেন্টের কাঁচামাল বোঝাই জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটে যা ইরাবতীকে বিলুপ্তির পথে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি সুন্দরবনের পূর্বাঞ্চলীয় ধাংমারি, চাঁদপাই এবং দুধমুখী এলাকাকে ডলফিনের জন্য অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করার পরও এইসব সংরক্ষিত এলাকায় জাহাজ ডুবির ঘটনা আবারও আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সত্যিই আমরা কতটা উদাসীন।
সুন্দরবনের ধাংমারি, চাঁদপাই এবং দুধমুখীর ৩১ কিলোমিটার জায়গায় তাদের বিচরণ কিন্তু এই পয়েন্ট দিয়ে চলা-চলকারী ভারি নৌযানের পাখার আঘাতে প্রতিনিয়ত মৃত্যু ঘটছে ডলফিনের । এছাড়া নদীর পাড়ের মাটি ভেঙ্গে নদীতে মিশে যাওয়ায় ডলফিনের আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে । আর এইসব কারণে পর্যটক হারাচ্ছে সুন্দরবন, রাজস্ব হারাচ্ছেও বন বিভাগ।
গত বছরের ২ জুলাই টাঙ্গাইল কালিহাতি উপজেলার চারান বিল থেকে ৮ ফুট লম্বা মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়। যখন নদীতে তাদের অভায়াশ্রম বিনষ্ট হচ্ছে তখন তারা দ্রুতই স্থান ত্যাগ করছে এবং লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে ।
গত বছরও সুন্দরবনের জয়মনি থেকে ১৫ কিলোমিটার ভিতরে বাদামতলি খালের আশে পাশে ইরাবতীকে খেলা করতে দেখা যেত কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে আর দেখা যাচ্ছে না তাদের।
সুন্দরবনই ডলফিনের বৃহত্তম আবাস ও প্রজনন-ভূমি বলে মনে করা হয়। পূর্ব সুন্দরবন এদের বংশবৃদ্ধি ও সংরক্ষণের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ তবে এখানেও এরা নিরাপদ নয়, পাচার, খাদ্যসংকট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জেলেদের জালে ধরা পরে তারা প্রতিনিয়তই মারা পড়ছে। তবে এ জন্য বনের ওপর নির্ভরশীল জেলেদের সচেতন করে তোলার পাশাপাশি সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে জাহাজ চলাচল বন্ধ করতে হবে।