ডুলাহাজরা শেখ মুজিব সাফারি পার্ক: জ্ঞান আর প্রকৃতির মিলনমেলা

মোঃ সাইফুল ইসলাম
দিনটি ছিল  স্নিগ্ধ-সুন্দর মনোরম ৮ নভেম্বরের সকাল বেলা। আমাদের চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) ডিভিএম অনুষদের ১৫ তম ব্যাচের ৭১ জন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাসফরে ডুলাহাজরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক ভ্রমণে নিয়ে যান মেডিসিন ও সার্জারী বিভাগের প্রফেসর ড. রায়হান ফারুক স্যার। চট্টগ্রাম কিংবা কক্সবাজার বেড়াতে এলে এই সাফারি পার্ক ভ্রমণের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবেন না, কারণ নগরায়নের এই যুগে সবুজ শ্যামল গাছপালা, মুক্তভাবে বিচরণশীল প্রাণিরা আপনার মন কাড়বেই। সেদিন ঘুরে ফিরে কি দেখেছিলাম সারাদিন সেই দৃশ্যপটের কিছুটা তুলে ধরার প্রয়াসে আমার এই লেখা। আশা করি সবার ভাল লাগবে।OLYMPUS DIGITAL CAMERA
সাফারী পার্ক: সাফারি পার্ক, অনেক সময় যাকে বলা হয় ওয়াল্ড লাইফ পার্ক। এটি হচ্ছে অনেকটা চিড়িয়াখানার মতো যেখানে পর্যটকের আকর্ষণ করা হয় ।দর্শনার্থীরা তাদের যানবাহন চালিয়ে যাবেন এবং প্রাকৃতিক পরিবেশে মুক্তভাবে বিচরণশীল প্রাণীদের দেখতে পাবেন। আবার সাফারি পার্কে কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে তাদের প্রদত্ত খাবার যানবাহনের ভিতর থেকে খাওয়ানোর ব্যবস্থাও থাকে। সহজভাবে বলা যায় এখানে প্রাণীরা থাকবে মুক্ত। তাদের ঘিরে রাখা হবে অদৃশ্য বেড়া দিয়ে। যেগুলোও প্রাকৃতিক গাছপালা, লতাপাতা কিংবা ঝোপঝাড়ে ঢাকা থাকবে। এতকিছু বিবেচনায় কেউ কেউ একে সাফারি পার্ক না বললেও কিছুই করার উপায় নেই। কারণ এই পার্কে প্রাকৃতিক অবকাঠামোর চেয়ে অত্যাধুনিক ও কৃত্রিম অবকাঠামোই বেশি গড়ে তোলা হয়েছে।
সাফারি পার্কের অবস্থান ও প্রাণী বৈচিত্র: ডুলাহাজারা সাফারি পার্কটি কক্সবাজার জেলা সদর থেকে ৫০কিলোমিটার উত্তরে এবং চকরিয়া থানা থেকে ১০কিলোমিটার দক্ষিণে, কক্সবাজার জেলা সদরের দক্ষিণ বন বিভাগের ফাসিয়াখালি রেঞ্জের ডুলাহাজারা ব্লকে অবস্থিত। মূলত এটি হরিণ প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠলেও এতে বাঘ, সিংহ, হাতি, ভালুক, গয়াল, কুমির, জলহস্তী, মায়া হরিণ, সাম্বা হরিণ, চিত্রা হরিণ, প্যারা হরিণ, মিঠা ও নোনা পানির কুমিরসহ নানাবিধ পাখপাখালির সমাহার রয়েছে। সবুজ-শ্যামল গাছপালায় বিস্তৃত মোট ৬০০হেক্টর এলাকা দেখলে দর্শনার্থীদের মন ভরে যায়। এটি ১৯৯৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্ররালয় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রতিষ্ঠা ব্যয় ছিল ৯ কোটি ৯৯ লক্ষ টাকা।dulahazra safari park

একনজরে পার্কের অবস্থান ও বিবরণতো জানলাম। এখন কি ইচ্ছে করছেনা ভিতরটা একটু ঘুরে দেখার! আসুন একটু ভিতরে ঘুরে আসি।

শুরুতেই ১০ টাকা প্রবেশ ফি গুণতে হবে আপনাকে। তবে শিক্ষার্থী ও বিদেশীদের জন্য ৫ টাকা। মাত্র ২০ টাকা হলে গাড়ি পার্কিং করতে পারবেন। গেট দিয়ে প্রবেশ করেই হাতের ডানপাশের ডিসপ্লে ম্যাপটা দেখে নিবেন। বামপাশে দেখবেন ডাইনোসরের প্রতিকৃতি। এরপরই দেখবেন বিরলপ্রজাতির কাছিম ও কচ্ছপ সংরক্ষণ কেন্দ্র। একটু সামনে এগিয়ে বামে তাকান। চোখে পড়বে বন্যপ্রাণী চিকিৎসালয়। হনুমান, ময়না পাখি ইত্যাদি চোখে পড়বে। সবাই একসাথে না হেটে ৩/৪ জনের ছোট ছোট গ্র“পে হাটলে মজাটা একটু বেশিই হয়। ভিতরে সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষের গাড়ি আছে। খুব কম টাকাতে ওঠা যায়। আপনি গাড়িতে চড়বেন না। কারণ এতে গাছের ডালে লাফিয়ে চলা কাঠবিড়ালী, জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা হরিণ, বানর দেখা মিস করে ফেলবেন। বানরেরা খাবারের জন্য হোক কিংবা আপনার আনন্দটা আরেকটু বাড়ানোর জন্য হোক আপনার পিছু পিছু হাটতে পারে। সাফারি পার্কের ভিতর চিৎকার করা থেকে বিরত থাকবেন। কোন প্রাণীকে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিত খাবার দিবেন না।OLYMPUS DIGITAL CAMERA
আপনার ঘুরে দেখা এখানেই শেষ হয়নি! রাস্তা ধরে হাটতেই থাকুন। এক সময় দেখবেন ইমু, ময়ুর, অজগর সাপ। আর দেখবেন কালো রঙের শেয়াল। আরও সামনে যান বাঘের খাঁচা চোখে পড়বে। এভাবে চলতে চলতে একেবারে শেষপ্রান্তে পৌঁছালে দেখবেন জলহস্তি। এছাড়াও আপনি পাখিশালায় পাখি, তারপরেই কুমির ও একটু সামনে পাবেন হাতি।
যা নেবেন সাথে: পার্কের ভিতর খাবার নিয়ে প্রবেশ করা নিষেধ। তবে পানির বোতল নিতে ভুলবেন না। আর সাথে থাকবে ক্যামেরা। ভিতরে ছবি তোলা নিষেধ নয়। তবে প্রাণীদের সামনে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ বন্ধ করে রাখাই ভাল। আবার বাঘ, সিংহের খাঁচার ভিতর হাত দিয়ে ছবি তোলার মত বীরত্ব দেখাতে যাবেন না। আমার ক্যামেরায় ধরা ছবিটি লক্ষ করুন। পার্ক রক্ষীদের সহায়তায় কিছু টাকার বিনিময়ে সিংহের খাঁচায় হাত দিয়ে ছবি তোলার অনুমতি পেয়েছেন তারা। এসব থেকে বিরত থাকবেন। অনেক চমৎকার দৃশ্য পাবেন ছবি তোলার মত। পার্কটি আপনার মন কাড়বেই।
পরিশেষ: এক সময় গগনচুম্বী গর্জন, বৈলাম, তেলসুর, সিভিট, চাপালিশ, চাপাফুল এবং বিবিধ লতা ও ঔষুধিসহ কক্সবাজারের চিরসবুজ বনাঞ্চল ছিল হাতি, চিতাবাঘ, হরিণ, ভাল্লুক, বন্যশুকর, বানর, উড়ন্ত কাঠবিড়ালী এবং অজগরসহ বিভিন্ন জাতের সরীসৃপ, ধনেশ, মাছরাঙ্গা, ফিঙ্গে, কেশরাজসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখপাখালির মত বিরল বন্যপ্রাণীর সমারোহে সমৃদ্ধ। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বাড়তি চাপে এবং অবৈধ শিকারের ফলে এ বনাঞ্চলের বন্যপ্রাণীসহ জীববৈচিত্রের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হয়। ফলে অনেক বন্যপ্রাণী প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যেতে থাকে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার কক্সবাজার বনাঞ্চল থেকে সেই ষাটের দশকেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এদের সংরক্ষণ খুব জরুরী হয়ে পড়ছে।safari park photo
তাই প্রকৃতিপ্রেমীদের নিরলস পরিশ্রম ও সরকারের সহায়তায় গড়ে ওঠে এই পার্কটি। কক্সবাজার সাফারি পার্কে আপনাকে স্বাগতম। আসুন, দেখুন, জ্ঞান আহরণ করুন। আপনার ভ্রমণ আনন্দময় ও সুখকর হোক।
লেখক- চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়

আরো দেখান

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics