পরিবেশ রক্ষায় যোগ্য নেতৃত্বের সন্ধানে; আর্থ চ্যাম্পিয়ন্স প্রোগ্রাম'১৪
লিসান আসিব খান
আর্থ চ্যাম্পিয়ন্স প্রোগ্রাম (ইসিপি) এমন একটি প্রোগ্রাম যার মাধ্যমে তরুণদের পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি ও নেতৃত্ব গঠনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, সেই সাথে এই বিষয় সম্পর্কিত অনেক জ্ঞান দেয়া হয়। প্রতিযোগিতা-মূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই বছর দেশের প্রায় ১৫টি জেলা থেকে ২৮ জন প্রতিযোগী কে বাছাই করা হয়েছিলো। এবং তাঁরা ছিলেন নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পড়ুয়া শিক্ষার্থী। পাঁচ দিন ব্যাপি এই প্রোগ্রামটি অনুষ্ঠিত হয় ২৫ থেকে ৩০ ডিসেম্বর সীতাকুণ্ডের গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের একটি আবাসিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে।
বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো এবং বৃহৎ পরিবেশ সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার’ (আইইউসিএন) এর যৌথ সহায়তায় ইসিপি’১৪ প্রোগ্রামটি অনুষ্ঠিত হয়। পরিবেশের উন্নয়ন সম্পর্কিত যেকোনো পদক্ষেপের দ্রুত ও কার্যকরী ভুমিকা পালন করে আইইউসিএন সমগ্র বিশ্বকে সহায়তা করে আসছে অনেকদিন ধরেই।
১ম দিন (২৬ ডিসেম্বর, ২০১৪)
পৃথিবী সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা প্রদানের মধ্য দিয়ে দিনটি শুরু করা হয়, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা পরিবেশের মাঝে নিজেদের নতুনভাবে আবিষ্কার করেন। প্রকৃতি এবং সমাজ সম্পর্কিত দ্বিতীয় সেশনটি পরিচালনা করেন এনামুল মজিদ খান সিদ্দিক। এই সেশনটির মাধ্যমে তাঁরা বাস্তুসংস্থান ও এর স্থিতিস্থাপকতা এবং সেই সাথে বাস্তু পুনর্বাসন সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারেন। এর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের আইইউসিএন এর কার্যক্রম সম্পর্কেও অভিহিত করা হয়। তৃতীয় সেশনটি পরিচালনা করেন শিহাব সমীর। সঠিক নেতৃত্বের গুরুত্ব ও সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সুনেতৃত্ব কিভাবে সমাজ বদলে দিতে পারে, সেইসব নিয়ে তিনি এই সেশনে আলোচনা করেন। সর্বশেষ সেশনটি পরিচালনা করেন মোঃ আশিকুর রহমান এবং ইয়ামিন হামিদ। এই সেশনটি ছিলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে পরিবেশ, জলবায়ু এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিস্তর আলোচনা হয়, এবং এদের মাঝে আন্তঃসম্পর্ক সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়। এই আলোচনা চলা কালীন একটি ভিন্নরকম অনুশীলন পদ্ধতির আয়োজন করা হয়। যেখানে অংশগ্রহণকারীদের কয়েকটি দলে বিভক্ত করে দেয়া হয় এবং তাঁদেরকে আলোচনায় উঠে আসা সমস্যাগুলোর সমাধান বের করতে বলা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে আলোচনার সাপেক্ষে প্রতিটি দল কিছু সমাধান বের করে ফেলে। যেমনঃ সৌর বোতল, বৃষ্টির পানির মাধ্যমে সেচ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচারণা ইত্যাদি। এছাড়া আরো গবেষণার মাধ্যমে পরিবেশের সমস্যা গুলোর সমাধান বের করা প্রসঙ্গ দিয়েই এই সেশনের ইতি টানা হয়।
২য় দিন (২৭ ডিসেম্বর, ২০১৪)
দ্বিতীয় দিনের প্রথম সেশনে অংশগ্রহণকারীরা নেতৃত্ব নিয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করার সুযোগ পান। এবং এই সেশনটি সুনিপুণভাবে পরিচালনা করেন শিহাব সমীর। অংশগ্রহণকারীদের একজন নেতা এবং ব্যাবস্থাপকের মধ্যে তফাৎটুকু পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয়। নেতৃত্ব সম্পর্কে তাঁদের দৃষ্টিকোণ বোঝার উদ্দেশ্যে একটি দলবদ্ধ অনুশীলন হয় এবং সবশেষে সহানুভূতি এবং সমবেদনা প্রকাশ সম্বন্ধে একটি ছোট্ট নাটক প্রদর্শন করা হয়। বাস্তুসংস্থানের উপর কেন্দ্র করে দ্বিতীয় সেশনটি পরিচালনা করেন রাফি মোস্তফা। সেখানে অংশগ্রহণকারীদের বাস্তুসস্থানের পাশাপাশি পরিবেশের বস্তুগত এবং জৈবিক দিক সম্পর্কে ধারণা প্রদান করা হয়, এর সাথে অভিযোজন এবং প্রাকৃতিক স্থিতিস্তাপকতার আলোচনা তো ছিলোই। তৃতীয় সেশনে আব্দুল্লাহ আল শাকিল পরিবেশের সাথে টিকে থাকা প্রসঙ্গে আলোচনা করেন। বিষয়টি বাস্তবিক অর্থে বোঝানোর জন্য কাগজের স্তম্ভ বানিয়ে অংশগ্রহণকারীদের দেখান হয় কিভাবে সীমিত সম্পদ নিয়েও পরিবেশের সাথে টিকে থাকা যায়।
চতুর্থ সেশনে আশিক মাহমুদ রানা শেখান, কিভাবে সমাজের সমস্যা গুলো শনাক্ত করে তার সমাধান বের করতে হয়। অনবায়নযোগ্য শক্তির ব্যাবহার প্রসঙ্গে পঞ্চম সেশনটি পরিচালনা করা হয় এবং পুনরায় এর নেতৃত্বে ছিলেন শিহাব সমীর। এখানে কোন ধরনের নবায়নযোগ্য শক্তি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অধিক কার্যকর সেই বিষয়ে আলোচনা করা হয়। ষষ্ট সেশনটি পরিচালনা করেন নাজমুন নাহার ও অদিতি সায়ন্তনি দাস, সেখানে পরিবেশের গঠন সংক্রান্ত বিষয় গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়। একটি আর্থ ক্লাব কিভাবে গঠন করতে হয় এবং এটি গঠনের সময় কী কী ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে হতে সেই সব বিষয় এই আলোচনায় উঠে আসে।
৩য় দিন (২৮ ডিসেম্বর, ২০১৪)
প্রোগ্রামের তৃতীয় দিনে, উপকূলবর্তী বনায়ন, জীববৈচিত্র্য, বাসস্তুসংস্থান এবং বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কে সুনিপুণ ধারণা প্রদানের উদ্দেশ্যে অংশগ্রহণকারীদের বামুন সুন্দর বন পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হয়।
পরিদর্শন শেষে পরিবেশগত বিচারের উপর একটি সেশন পরিচালিত হয়, এবং এটি পরিচালনা করেন জনাব নাসের আলম। এর মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীরা বিচার, ন্যায় বিচার এবং তুলনামূলক বিচার সমূহের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে জানতে পারেন। দ্বিতীয় সেশনটি পরিচালনা করেন জনাব মিজান, সেখানে উন্নত পরিবেশের জন্য আইইউসিএন এর বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা করা হয়। তিনি উপকূলীয় প্রাণী-উদ্ভিদ, তাদের জীবনধারা এবং বন পরিদর্শন সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা ব্যাখ্যা করেন। শেষ সেশনটিতে দেখানো হয়, পোস্টারের মাধ্যমে, কিভাবে তাঁরা তাঁদের সংগ্রহকৃত সব তথ্য উপস্থাপন করতে পারবেন এবং ঐ কেমন করে পরিদর্শন সম্পর্কিত সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। এখানে সম্প্রদায় ভিত্তিক প্রকল্প সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়। সেশনটি পরিচালনা করেন আব্দুল্লাহ আল শাকিল। এখানে অংশগ্রহণকারীরা নিজ নিজ সম্প্রদায়ে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়, সেগুলো সম্পর্কে বলার সুযোগ পায়। সেশনটির মাধ্যমে সেসব সমস্যার সমাধান নিয়ে সুন্দরভাবে পরিকল্পনা করা হয়।
৪র্থ দিন (২৯ ডিসেম্বর, ২০১৪)
মানুষ এবং কাজ ভিত্তিক নেতৃত্ব সম্পর্কে আলোচনার মধ্য দিয়ে এই দিনটি শুরু করেন শিহাব সমীর। তিনি সহানুভূতি এবং কর্মদক্ষতার মধ্যে তুলনামূলক বর্ণনা দেন। সুনেতৃত্বের সংজ্ঞা কী, সেটি বোঝাতে গিয়ে তিনি অংশগ্রহণকারীদের সমবেদনা, সহানুভূতি, পরস্পরের প্রতি আস্থা প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিষয়গুলো খুব চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেন। কোনভাবে অহংকার প্রকাশ করলে তা নেতৃত্বের উপর কী পরিমাণ প্রভাব ফেলে,সেটিও পরিষ্কারভাবে বোঝানো হয়, আর শেখানো হয় অংশগ্রহণকারীরা তাঁদের অন্তিম মুহুর্তে কেমন করে লড়াই করবে, সেটিও। এরপর অংশগ্রহণকারীরা তাঁদের ভ্রমন এবং পরিদর্শনে যা যা শিখলেন ও যেভাবে ঘটে যাওয়া সমস্যা গুলো মোকাবিলা করলেন তা বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করেন।
অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি!
প্রোগ্রামের শেষ দিনের সমাপনী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা তাঁদের বক্তৃতায় এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতাগুলো সংক্ষিপ্ত ভাবে তুলে ধরেন। তাঁদের প্রায় সব কথাই ছিলো ইতিবাচক। তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই ইসিপি কে তাঁদের আরেকটি পরিবার হিসেবে দাবী করে একই ধরণের আবেগ প্রকাশ করেন। এই প্রোগ্রামটি সফল করার জন্য আয়োজকদের পক্ষ থেকে যে পরিমাণ কঠোর পরিশ্রম করা হয়েছে তাঁর প্রশংসা করেন। তাঁদের কথায় প্রশিক্ষক ও অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সুসম্পর্কের বিষয়টি বেশ স্পষ্ট ছিল। পরিশেষে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে তাঁরা ব্যক্ত করেন, যে বিষয়গুলো তাঁরা ইসিপি’ ১৪ থেকে সাথে নিয়ে যাচ্ছেন সেগুলো হচ্ছে “আত্মবিশ্বাস”, “নেতৃত্বের গুণাবলী”, “উন্নত দক্ষতা” । তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি মনের ভেতর গেঁথে গেছে, তা হলো আমাদের চারপাশের পরিবেশের জন্য “সচেতনতা” !