কুনোব্যাঙের গতিবিধি জানিয়ে দিবে ভূমিকম্পের আগাম সতর্কবার্তা
মোঃ আরাফাত রহমান খান
এই শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ ও উদ্বিগ্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হল ভূমিকম্প । বিজ্ঞানের এই স্বর্ণযুগেও ভূমিকম্পের মত সমস্যার আজও কোন সমাধান হয়নি । মানবসৃষ্ট কোন যন্ত্র এখন পর্যন্ত পূর্বাভাস দিতে পারেনি ভূমিকম্পের সময় বা স্থান । এই সমস্যা সমাধানের জন্য দিনরাত গবেষণা করে যাচ্ছেন বিশ্বের সকল বিখ্যাত বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো । গত বছরের ২৫ এপ্রিল নেপালে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্প পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ ও আলোচিত ভূমিকম্পের মধ্যে একটি । প্রায় ৮০০০ মানুষ এই ভূমিকম্পে মৃত্যুবরণ করেছিল। যদি কোন ধরণের ভূমিকম্প পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হতো, হতাহতের পরিমাণ হয়তো বেশ খানিকটাই কমে যেত ।
তবে অবাক হওয়ার মত বিষয় হল ভূমিকম্পের আভাস পাওয়ার মত ইন্দ্রিয় আছে কুনোব্যাঙের । ২০০৯ সালের দিকে ইতালির লা’একুলায় প্রায় ৯৪ টি সদস্য বিশিষ্ট একটি কুনোব্যাঙ কলোনি মাত্র ৩ দিনে ঐ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়, যদিও সময়টা ছিল কুনোব্যাঙের প্রজনন মৌসুম । ঠিক ঐ ৩ দিন পরেই লা’একুলায় এই ভূমিকম্প হয় । আরও মজার ব্যাপার হল সৌভাগ্যবশত ২০০৯ সালের দিকেই যুক্তরাজ্যের মিল্টন কেইনেস বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জীববিজ্ঞানী গ্রান্ট রেচেল তখন কুনোব্যাঙের আচরণগত একটি গবেষণা করছিলেন । ০৬ এপ্রিল ২০০৯ তারিখে যখন ভূমিকম্প হল , রেচেল তখন ২৯ দিনের উপাত্ত সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। তিনি বলেন “ ভূমিকম্পের ৫ দিন আগে থেকেই কুনোব্যাঙের আচরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলাম যা বাকি দিন গুলো থেকে একদমই অন্নরকম ছিল” । তারপর দলটির প্রজনন মৌসুম সত্ত্বেও পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে সেই সময়ে কুনোব্যাঙ সত্যিই ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পেয়েছিল এবং ভূমিকম্প উৎপত্তিস্থল থেকে এদের কলোনির দুরত্ত ছিল মাত্র ৭.৫ কিলোমিটার ।
International Journal of Environmental Research and Public Health এ ২০১১ সালে রেচেল তার একটি প্রবন্ধে ভূমিকম্প ও তার পূর্ববর্তী সকল রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ব্যখ্যা প্রদান করেন । ভূমিকম্পের পূর্বে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠে একটি বিশাল অভ্যন্তরীণ চাপের সৃষ্টি হয়। ঐ চাপের ফলে ভূপৃষ্ঠে অবস্থিত কণাগুলো চার্জিত হয়ে আয়নিত অবস্থা প্রাপ্ত হয়। চার্জিত আয়নসমূহ বাতাসের সংস্পর্শে এসে আয়নিত অক্সিজেন কাঠামো গঠন করে । যা পরে পানিতে মিশে গিয়ে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড উৎপন্ন করে। এর ফলে ঐ পরিবেশে থাকাকালীন সময়ে যে কোন ব্যক্তির মাথাব্যাথা,বা বমি ভাব হতে পারে। কারন হাইড্রোজেন পার অক্সাইড হাইপোথ্যালামাস উদ্দীপ্ত করে প্রচুর পরিমাণ সেরাটোনিন নিঃসরিত করে, যা মানব শরীরে অস্বস্তির কারন । এছাড়াও ভূমিকম্প-পূর্ব পরিবেশে ভূপৃষ্ঠের পানিতে চার্জিত আয়নের ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় কপিতয় বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান সৃষ্টি হয় যার প্রতি কুনোব্যাঙ খুবই সংবেদনশীল, যার প্রভাবে কুনোব্যাঙের মধ্যে স্থান পরিবর্তনের প্রবণতা সহজেই চোখে পরে।
কেবল কুনোব্যাঙ নয়, অন্যান্য অনেক জলজ ও উভচরদের মধ্যে এই ধরণের আচরন বিশেষ লক্ষণীয়। সাপ ও পিঁপড়েও ভূমিকম্পের আভাস আগে থেকেই অনুধাবন করতে পারে। ১৯৭৫ সালে চিনের হাইয়েং শহরে শীতের মাঝামাঝি সময়ে সব সাপ শীতনিদ্রা ভেঙে পালিয়ে যেতে শুরু করে যার এক মাস পরেই হাইয়েংতে ভূমিকম্প হয়েছিলো ।
ডঃ গ্রান্ট বলেন জলজ ও উভচর প্রানিরাই ভূমিকম্প পূর্ব-পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল হয়ে থাকে , কারন এরা ভূপৃষ্ঠের জলাশয়ের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে। তাই ভূমিকম্প পূর্বোক্ত সকল ক্রিয়া-বিক্রিয়াশীল ঘটনা এই জলজ প্রানিরাই সবার আগে বুঝতে পারে ।
সেই দিন আর বেশি দূর নয় যখন ব্যাঙ কিংবা স্বয়ংক্রিয় যান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা পূর্বাভাস পেয়ে যাব ভূমিকম্পের। সেদিন রক্ষা পাওয়া যাবে ভয়াবহ বিপর্যয়ের কবল থেকে, রক্ষা পাবে হাজারো প্রান-সম্পদ । হয়তোবা রক্ষা পেতে পারে আমাদের সোনার বাংলাদেশ।