ভূমিকম্প ও বাংলাদেশঃ প্রস্তুতি ও করণীয়

সম্প্রতি নেপালে ঘটে যাওয়া ৭.৯ ও ৬.৭ মাত্রার ভূমিকম্প জানিয়ে দিয়ে গেলো যে এর শক্তি ও ভয়াবহতা কীরূপ আকার ধারন করতে পারে। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল নেপালের পোখরা। উৎপত্তিস্থল থেকে ৭৪৫ কিলোমটার দূরে, বাংলাদেশে এই ভূকম্পন অনুভূত হয় ৩ থেকে ৫ রিখটার স্কেলে। ঘনবসতিপূর্ণ এদেশে বড় কোনো ভূমিকম্প যে বিশাল দুর্যোগ বয়ে নিয়ে আসবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এই দূর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি এবং এই বিষয়ে সচেতনতা যে কতটা দূর্বল তা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এবং জনমনের আতংঙ্ক থেকে সহজেই অনুমেয়।

২০১৫ সালের ২৫ এপ্রিল নেপালে সংঘটিত ভূমিকম্পের স্থান ( সূত্রঃ ইউ এস জি এস)
২০১৫ সালের ২৫ এপ্রিল নেপালে সংঘটিত ভূমিকম্পের স্থান ( সূত্রঃ ইউ এস জি এস)

সাধারণত তিনটি প্রধান কারণে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকে- ভূপৃষ্ঠজনিত, আগ্নেয়গিরিজনিত,শিলাচ্যুতিজনিত।

বাংলাদেশ মূলত ভারত ও মায়ানমারের ভূঅভ্যন্তরের দুটি ভূচ্যুতির অর্থাৎ faultline এর প্রভাবে আন্দোলিত হয়, কেননা বাংলাদেশ, ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং মায়ানমারের  টেকটোনিক প্লেটের মধ্যে অবস্থানরত। যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের রজার বিল হাম  এর গবেষণা মতে, ভারতীয় এবং ইউরেশীয় প্লেট দুটি দীর্ঘদিন যাবৎহিমালয়েরপাদদেশে আটকা পড়ে আছে, অপেক্ষা করছে বড় ধরণের ভূ-কম্পনের। যার তীব্রতা হতে পারে প্রায় ৮.০ মাত্রার।

earthquake
ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত নেপাল। এমন চিত্র হতে পারে আমাদের প্রিয় ঢাকারও।

জাতিসংঘ ভূমিকম্পের দূর্যোগ সূচি অনুসারে, ঢাকা বিশ্বের ২০ টি ঝুঁকিপূর্ণ শহরের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে। প্রথমে আছে ইরান। আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতে, বাংলাদেশে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পও হবার মত faultline নেই। তবে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্পও হওয়ার মত faultline আছে ঢাকার অদূরে মধুপুরে।

গত ১৫০ বছরে বাংলাদেশে ৭টি বড় আকারের ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে দুটির কেন্দ্র ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে।  একটি ১৮৮৫ সালের ১৪ জুলাই ৭.০ মাত্রার , যার কেন্দ্র ছিল মানিকগঞ্জে, এটি “বেঙ্গল আর্থকোয়াক” নামে পরিচিত। অপরটি ১৯১৮ সালের ৮ জুলাই শ্রীমঙ্গলে যার মাত্রা ছিল ৭.৬। এছাড়া বড় ধরনের ভূমিকম্পএর মধ্যে ২০০৭ সালের নভেম্বরে ৬.০ এবং  ২০১১ সালের  ১৮  সেপ্টেম্বর  ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়।  চট্টগ্রামে ১৯৯৭ সালে ৬.১ মাত্রার ভূমিকম্পে ২৩ জন  নিহত হয়েছিল।

ভূমিকম্প ঝুঁকি অনুযায়ী ঢাকাকে চারটি এলাকায় ভাগ করা যায় । ম্যাপে দেখা যাচ্ছে উত্তরা এলাকা সবচেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং খিলগাঁও, বাড্ডা, গুলশান, ক্যান্টনমেন্ট এবং পুরনো ঢাকার বুড়িগঙ্গা সংলগ্ন অঞ্চল বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় রয়েছে।

ঢাকার ভূমিকম্প ঝুঁকি এলাকা (সূত্রঃ ডেইলি স্টার)
ঢাকার ভূমিকম্প ঝুঁকি এলাকা (সূত্রঃ ডেইলি স্টার)

ভূমিকম্পের সময় দুই ধরনের কম্পন টের পাওয়া যায়- প্রাইমারি ওয়েভ এবং সেকেন্ডারী ওয়েভ। অবকাঠামো ধ্বংসের জন্য মূলত দায়ী শক্তিশালী সেকেন্ডারী ওয়েভ এবং শ্লথগতি সম্পন্ন সারফেস ওয়েভ। প্রাইমারী ওয়েভ থেকে সেকেন্ডারী ওয়েভের ব্যবধান খুব বেশি নয়। ভূমিকম্প টের পাবার মোটামুটি ১১ সেকেন্ডের ব্যবধানে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়ে যায়। এর মধ্যেই আপনাকে আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

ভূমিকম্পের সাথে অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলির মধ্যে একটি বড় পার্থক্য হচ্ছে এটি খুব কম সময়ে কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই সম্পন্ন হয়। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেবার মতো কোনো উপযুক্ত পন্থা বা প্রযুক্তি এখনও আবিষ্কৃত হয় নি। ভূমিকম্প বিষয়ে তাই সবার ব্যক্তিগত পূর্বপ্রস্তুতি ও এ সময়ে করণীয় সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরী।
নিজ এলাকার ভূমিকম্প ঝুঁকি সম্পর্কে ধারণা রাখাও প্রস্তুতির একটা অংশ। ভূমিকম্প ঝুঁকি অনুযায়ী ভূ-তাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশকে তিনটি প্রধান অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। সিলেট বিভাগসহ নেত্রকোনা, শেরপুর, কুড়িগ্রাম জেলা এবং ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, গাইবান্ধা, রংপুর ও লালমনিরহাট জেলার অংশবিশেষ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে রয়েছে। ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ইত্যাদি জেলা মাঝারি ঝুঁকিপ্রবণ এলাকায় পড়েছে।

sayemmoon007happy_1271455603_24-E_Zone_map
বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা

ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহর ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত হলেও বিশেষ করে ঢাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ন, নাজুক দালান-কোঠা এবং অত্যধিক জনসংখ্যা ভূমিকম্পে ক্ষয়-ক্ষতির সংখ্যা অনেক বাড়িয়ে দিতে পারে।

প্রস্তুতিঃ

১। খোঁজ নিন আপনার ভবনটিতে ভূমিকম্পরোধক ব্যবস্থা আছে কিনা, থাকলে তা কী মাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করতে পারবে। যদি না থাকে তবে রেট্রোফিটিং-এর ব্যবস্থা নিন। কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পুরনো ভবনেও রেট্রোফিটিং-এর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। রেট্রোফিট হলো ভবনের পুনর্জন্ম। জরাজীর্ণ ভবনে নবজীবন লেপে দেওয়া, যেখানে পুরোনো ভবনটিকে না ভেঙে নতুন করা সম্ভব। প্রায় প্রতিটি ভবনেই রেট্রোফিটিং করা সম্ভব। যথাযথভাবে যদি কাজটি করা যায়, তাহলে ভবনের স্থায়িত্বও বেড়ে যাবে ৫০ বছর বা তারও বেশি। জাপানে ভূমিকম্প একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু তাদের ভবনগুলিতে ভূমিকম্পরোধক ব্যবস্থা থাকায় তাদের ক্ষয়ক্ষতি হয় অতি সামান্য।
২।পরিবারের সবার সাথে বসে এ ধরনের জরুরী অবস্থায় কি করতে হবে, কোথায় আশ্রয় নিতে হবে- মোট কথা আপনার পরিবারের ইমার্জেন্সি প্ল্যান ঠিক করে সব সদস্যদের জানিয়ে রাখুন। ভূমিকম্পের সময় হাতে খুব সামান্যই সময় পাওয়া যাবে। এ সময় কী করবেন তা সবাইকে নিয়ে আগেই ঠিক করে রাখুন।
৩।বড় বড় এবং লম্বা ফার্নিচারগুলোকে যেমন- শেলফ ইত্যাদি দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখুন যেন কম্পনের সময় গায়ের উপর পড়ে না যায়। আর টিভি, ক্যাসেট প্লেয়ার ইতাদি ভারী জিনিষগুলো মাটিতে নামিয়ে রাখুন।
৪।বিছানার পাশে সবসময় টর্চলাইট, ব্যাটারী এবং জুতো রাখুন।
৫। বছরে একবার করে হলেও ঘরের সবাই মিলে আসল ভূমিকম্পের সময় কী করবেন তার একটা ট্রায়াল দিন।

করণীয়ঃ
নিচের পরামর্শগুলো বেশি কার্যকরী যদি ভবনে ভূমিকম্পরোধক ব্যবস্থা থাকেঃ
১।ভূমিকম্পের সময় বেশি নড়াচড়া, বাইরে বের হবার চেষ্টা করা, জানালা দিয়ে লাফ দেবার চেষ্টা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা উচিত। একটা সাধারণ নিয়ম হল- এ সময় যত বেশি মুভমেন্ট করবেন, তত বেশি আহত হবার সম্ভাবনা থাকবে। আপনার ভবনে যদি ভূমিকম্পরোধক ব্যবস্থা থাকে বা রেট্রোফিটিং করা থাকে তবে ভূমিকম্পের সময় বাসায় থাকাই সবচেয়ে নিরাপদ।
২।আমেরিকান রেডক্রসের পরামর্শ অনুযায়ী- ভূমিকম্পের সময় সবচেয়ে উত্তম পন্থা হল ‘ড্রপ-কাভার-হোল্ড অন’ বা ‘ডাক-কাভার’ পদ্ধতি। অর্থাৎ কম্পন শুরু হলে মেঝেতে বসে পড়ুন, তারপর কোন শক্ত টেবিল বা ডেস্কের নীচে ঢুকে কাভার নিন, এমন ডেস্ক বেছে নিন বা এমনভাবে কাভার নিন যেন প্রয়োজনে আপনি কাভারসহ মুভ করতে পারেন।
কোনো ভবন ভূমিকম্পরোধক হলে তা খুব কমই ধসে পড়ে; যেটা হয় তা হল আশেপাশের বিভিন্ন জিনিস বা ফার্নিচার গায়ের উপর পড়ে আহত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই এগুলো থেকে বাঁচার জন্য এ সময় কোন শক্ত ডেস্ক বা টেবিলের নিচে ঢুকে আশ্রয় নেয়া জরুরী।
৩।ভূমিকম্পের সময় এলিভেটর/লিফট ব্যবহার পরিহার করুন।
৪।ভূমিকম্পের সময় যদি গাড়িতে থাকেন তবে গাড়ি বন্ধ করে ভেতরে বসে থাকুন। গাড়ির বাইরে থাকলে আহত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
৫। ‘মেইন শক’ বা মূল ভূমিকম্পের আগে এবং পরে মৃদু থেকে মাঝারি আরো কিছু ভূমিকম্প হতে পারে যেগুলো ‘ফোরশক’ এবং ‘আফটার শক’ নামে পরিচিত। সতর্ক না থাকলে এগুলো থেকেও বড় বিপদ হয়ে যেতে পারে। সাধারণত কোনো বড় ভূমিকম্পে ‘আফটার শক’ প্রথম ঘণ্টার মধ্য থেকে শুরু করে কয়েক দিনের মধ্যে হতে পারে।
৬।প্রথম ভূমিকম্পের পর ইউটিলিটি লাইনগুলো (গ্যাস, বিদ্যুৎ ইত্যাদি) একনজর দেখে নিন। কোথাও কোন লিক দেখলে মেইন সুইচ বন্ধ করে দিন।

ধ্বংসস্তুপে আটকে পড়লে করণীয়ঃ
১। ধুলাবালি থেকে বাঁচার জন্য আগেই সাথে রুমাল বা তোয়ালে বা চাদরের ব্যবস্থা করে রাখুন।
২। ম্যাচ জ্বালাবেন না। দালান ধ্বসে পড়লে গ্যাস লিক হয়ে থাকতে পারে।

৩। চিৎকার করে ডাকাডাকি শেষ অপশন হিসেবে বিবেচনা করুন। কারণ, চিৎকারের সময় মুখে ক্ষতিকারক ধুলাবালি ঢুকে যেতে পারে। পাইপে বা ওয়ালে বাড়ি দিয়ে বা মুখে শিস বাজিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতে পারেন। তবে ভাল হয় সাথে যদি একটা রেফারির বাঁশি বা হুইসেল থাকে, তার প্রস্তুতি নিয়ে রাখুন আগেই।

বিগত ঘটনাগুলো থেকে দেখা যায়, দূর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের পদক্ষেপ বরাবরের মতই দূর্বল। ভূমিকম্পের কোনো নির্দিষ্ট সময় সূচি বা পূর্বাভাস নেই। তাই সরকারী এবং বেসরকারী পর্যায়ে ভূমিকম্পও প্রতিরোধক পূর্বপ্রস্তুতি সম্পর্কে সচেতনত সৃষ্টি করা অতি প্রয়োজন।

প্রস্তুতি ও করণীয় সম্পর্কে পরামর্শটির জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই, লেখক তানভীর ইসলাম কে। তিনি নগর পরিকল্পনাবিদ ও সহকারী অধ্যাপক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, জ্যাকসনভিল স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics