
মায়াময় খুড়লে পেঁচা
রুবাইয়া জাহান বাণী
পৃথিবীর আলো নিভে গেলে রাতের অন্ধকারে জীবন্ত হয় এই নিশিচরেরা। অন্ধকারই তাদের জন্য আলো। ঘুমের রাজ্যে যখন আমরা ঢলে পরি তখন এরা উড়ে বেড়ায় পৃথিবীময়। আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে তাদের গভীর দূরদৃষ্টি, তীক্ষ্ণ শ্রবণ শক্তি আর নিশ্চুপ বিচরণ কোন উড়ন্ত শিকারীর অব্যর্থ শিকারের প্রত্যাশায় যেন এক নির্বাক উচ্ছলতা নিস্তব্ধ চাঞ্চল্য! তার ভুতুরে ডাকে ভয় পায় নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। সত্যিই কি সে খুব ভয়ংকর? কে এই আঁধারের যাত্রী? আসলে ডাগর চোখের পেঁচার কথা বলছিলাম এতক্ষন। যার চোখ দুটি মানুষের চোখের মতই সামনে বসিয়ে দিয়েছেন স্রষ্টা। তাকে ভয়ংকর বলি কি করে! এমন জোড়া আঁখির বন্দনা না করে পারি না! তার দিকে তাকালে দৃষ্টি থেমে যায়, এক জোড়া চোখ যখন আরেক জোড়া চোখকে পূর্ণ খুঁজে পায় তখন ভালবাসা না হয়ে পারে না। সে আমাকে দেখছে আমি ভাবছি, আমি তাকে দেখছি সে ভাবছে, ভাবের ব্যাকুলতায় হৃদয় আটকে পড়েছে তাই একসাথে! পেঁচার চোখ সত্যিই ব্যতিক্রম। অন্যান্য পাখিদের চোখ মাথার দুই দিকে থাকে যেখানে এর দুই চোখ মাথার একই দিকে।
পেঁচা নিয়ে সংস্কার-কুসংস্কারের শেষ নেই। এর সাথে মানুষের সম্পর্ক কিছুটা নেতিবাচক বহুকাল থেকেই। আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে একে দেখলে ভুত দেখার মতই জ্ঞান করা হত একসময়। কেবল আমাদের দেশেই না, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও একে নিয়ে নানা লোকবিশ্বাস প্রচলিত। সত্যিকারভাবে একে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। খুবই নিরীহ সে। মাংসাশী হওয়ায় ছোটখাট প্রানী শিকার করে খায়। হঠাৎ করে দেখলে এর শান্তভাব আর স্থির চাহনি মানুষকে কিছুটা বিস্ময় এনে দেয় যার কারণে না জেনেই মানুষ একে ভয় করা শুরু করে। মানুষের জন্য ক্ষতিকর এমন প্রানী খেয়ে এরা উপকারই করে থাকে সবসময়।
পৃথিবীতে ১৭৩ প্রজাতির পেঁচা আছে যার মধ্যে আমাদের দেশে আছে ১৬ প্রজাতির। এদের মধ্যে একটি পেঁচার গল্প বলব এখন। যার নাম খুড়লে পেঁচা (Spotted Owlet); প্রায়ই দেখতে যাওয়া হয় তাকে। তার বাসায় নিচে গিয়ে দাঁড়াই। এক শীতের দুপুরে প্রজাপতি খুঁজতে গিয়ে তীক্ষ্ণ এক ডাকে প্রথম তার দেখা পেয়েছিলাম। যেন সে আমাকে তার বাসায় নিমন্ত্রণ করেছে! সেই থেকে তার সাথে বন্ধুত্ব আমার!
খুড়লে পেঁচা গাছের কোটর, কিংবা বিল্ডিং এর পরিত্যক্ত ফাঁক-ফোঁকড়ে থাকতে খুব ভালবাসে। এ কারণে একে কোটরে পেঁচাও বলা হয়। এদের বৈজ্ঞানিক নাম Athene brama indica । আমাদের দেশের পেঁচার মধ্যে এরাই সবচেয়ে ছোট। এদের চোখের চারিদিক ও গলা সাদা। চোখের তারা ফ্যাকাশে থেকে সোনালি হলুদ। পিঠের দিক গাঢ় বাদামী, তার উপর সাদা ফোঁটা থাকে। স্ত্রী ও পুরুষ দেখতে একইরকম। তবে প্রজনন ঋতুতে স্ত্রী পেঁচার লেজ চকচকে হয়ে যায়। উচ্চতায় এরা ২১ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
খুড়লে পেঁচা সাধারণত নিশাচর। দিনের আলো তেমন সহ্য করতে পারে না। তবে প্রয়োজনে দিনের বেলাতেও কদাচিৎ বের হতে দেখেছি। মানুষের চেয়ে এদের চোখে রড সেল (অন্ধকারে দেখতে সহায়তাকারী সেল) এর সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় রাতের বেলায় এরা খুব ভালো দেখে । কিন্তু গাঢ় অন্ধকারে এরা চোখের চেয়ে কানকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। শ্রবণশক্তি খুবই প্রখর। কেবল শব্দ দ্বারা চালিত হয়ে এরা নিকষ কালো অন্ধকারে শিকার ধরতে পারে। শিকারের চলাচলের সামান্য ধ্বনিও এদের কান এড়িয়ে যায় না। এদের গোলাকার মুখ, কানের পেছনের পালক সবই সূক্ষ্ম আর ক্ষীণ শব্দ ধরতে সহায়ক। গাছের ডালে ঠায় বসে মাথা পুরো ঘুরিয়ে এরা পেছনে তাকাতে পারে । চারপাশে কি হচ্ছে নিঃশব্দে তার খবরাখবর রাখে এভাবে। খুড়লে পেঁচা জোড়ায় জোড়ায় থাকে। একে অন্যের জন্য এদের অনেক মায়া। একজনের গায়ে আরেকজন হেলান দিয়ে গাছের ডালে বসে বিশ্রাম নেয় দিনের বেলা। প্রায়ই এরা নিজের পালক পরিপাটী করার সময় আপন সঙ্গীর পালকেও আদর করে দেয় ঠোঁট দিয়ে। গলায় চুলকিয়ে দেয়, আদর পেয়ে আরামে চোখ বুজে নেয় অন্যজন। কি মমত্ব আর ভালবাসায় সংসার করে ওরা! দেখে মুগ্ধ হই। দিনের বেলাটা এভাবেই বিশ্রামে আর ভালবেসে কাটে। সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথেই শিকারের নেশায় মত্ত হয়। টিকটিকি, ইঁদুর, ছুঁচো, সাপ, ব্যাঙ, পোকামাকড়, ছোট পাখি, পাখির ছানা সবই ধরে খায়। ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত সক্রিয় থাকে এই দক্ষ শিকারি। কাছাকাছি থাকলে এদের তীক্ষ্ণ “চিকিক-চিকিক-চিকিক” আওয়াজ আর ভারি ডানার ঝাপটানোর শব্দ শোনা যায় হঠাৎ হঠাৎ। সারা রাত কিছু সময় পর পরই এভাবে এরা ডাকে। শিকার পেয়ে হয়তো খুশির খবর জানান দেয় প্রিয়জনকে!
যদিও পেঁচার শিকারী স্বভাবের জন্য সবাই একে অন্যচোখে দেখে, কিন্তু এই পাখিটি আসলে মায়াময়। প্রকৃতিপ্রেমী কবি জীবনানন্দ দাশ এর পেঁচা কবিতার অদ্ভূদ সুন্দর চরণে এ পাখির মায়াময় তীক্ষ্ণ উদাসী স্বভাবের বাস্তব বহিঃপ্রকাশ ফুটে উঠেছে…
“সেই পাখি–
আজ মনে পড়ে
সেদিনও এমনি গেছে ঘরে
প্রথম ফসল;
মাঠে মাঠে ঝরে এই শিশিরের সুর–
কার্তিক কি অঘ্রানের রাত্রির দুপুর!–
হলুদ পাতার ভিড়ে বসে,
শিশিরে পালক ঘ’ষে ঘ’ষে,
পাখার ছায়ায় শাখা ঢেকে
ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে দেখে
মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে
জেগেছিল অঘ্রানের রাতে
এই পাখি!”
মজার বিষয় হল,দিনের বেলায় পেঁচার দিকে তাকিয়ে মাথা উঠা-নামা করলে নাকি ওরাও সুন্দর ভঙ্গিতে ওদের মাথা উঠা-নামা করে। দর্শনক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নাকি এরা এমনটা করে থাকে!
এদের প্রজনন কাল পৌষ থেকে বৈশাখ পর্যন্ত। এক সাথে ৩ থেকে ৪টি ডিম পাড়ে স্ত্রী পেঁচা। ২৫ দিনে ডিম ফুটে পেঁচা পরিবারে নূতন শিশু পেঁচার শুভাগমন হয়। মা-বাবা শিকার ধরে এনে ছোট টুকরা করে বাচ্চাদের মুখে ঢুকিয়ে দেয়। এদের পালক গজাতে ৩০ দিন এর মত লাগে।
তুলতুলে ছোট সুন্দর এ পাখিটি আমাদের দেশে এখনও পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে। তাই IUCN একে Least Concern বা আশংকাহীন প্রজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। কিন্তু যেভাবে ঝোপ-জঙ্গল বিনাশ, কীটনাশক, ইদুঁরনাশক এর প্রয়োগ, নগরায়ন এর দৌরাত্ব চলছে সেদিন হয়তো আর বেশি দূরে নয় যখন পেঁচাশুমারী করতে গিয়ে এর দেখা মিলবে না আর। এভাবেই হঠাৎ করে আমাদের দেশ থেকে বহু পাখ-পাখালী আর জীব-জন্তু বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে আমাদের অসতর্কতা আর অবহেলার সুযোগে। সেই সুযোগকে বারংবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেয়া যাবে না। এদের সংরক্ষণের জন্য তাই আমাদের সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে। নয়তো আমরাও একদিন হঠাৎ বিপর্যয়ে হারাতে থাকব আমাদেরই তৈরি করা বিলুপ্তির পথে।
লেখকঃ প্রাক্তন শিক্ষার্থী, বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
ছবিসত্ত্বঃ লেখক
তথ্যসূত্রঃ
- বাংলাদেশের পাখি, রেজা খান
- http://en.wikipedia.org/wiki/Spotted_Owlet