টেকসই সামুদ্রিক পর্যটনে গুরুত্বারোপ বিশেষজ্ঞদের
উপকূলীয় ও সামুদ্রিক পর্যটনকে টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর জন্য এই ব্যাপারে আইনি পরিকাঠামো তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে আজ শনিবার রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় এ আহ্বান জানান তারা। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন, সেভ আওয়ার সি এবং পিপলস সার্ক ওয়াটার ফোরাম এ আলোচনার আয়োজন করে।
বাপা সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিনের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় ‘বাংলাদেশে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব সামুদ্রিক পর্যটনের সম্ভাবনা’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সামুদ্রিক টেকসই অর্থনীতি বিষয়ক উদ্যোগ ‘সেভ আওয়ার সি’র প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ আরজু।
প্রবন্ধে বলা হয়, ‘উপকূলে ও সমুদ্রে যথার্থ পর্যটন পণ্য ও সেবা যেমন স্কুবা ডাইভিং, স্নরকেলিং, সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণি ও পাখি দেখা, বোটিং ও সেইলিং ইত্যাদির সুযোগ অনুপস্থিত; পর্যটন খাতে আয় সামান্য; কিন্তু দায়িত্বহীন পর্যটন ধারার কারণে খোদ প্রতিবেশগত পর্যটন স্থানগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব পর্যটনস্থানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিবেশের জন্য ক্ষতিকর উপায়ে অবকাঠামো উন্নয়ন করা হয়েছে। পরিবেশগতভাবে স্পর্শকাতর এই স্থানগুলোতে যেধরণের আচরণ করা ও না করা জরুরি, তার কোনো নির্দেশনা, আয়োজন বা বাধ্যবাধকতা- কিছুই নেই। যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই।’
এতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব পর্যটন ও পণ্য সেবার অভাব কাটিয়ে ওঠাই প্রধান চ্যালেঞ্জ। এটা উতরে গেলে দুর্বলতর শিল্পখাতটিকে টেকসই ভিত্তি দেয়া সম্ভব। বর্তমানে বিশ্বে ৪৮টি স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে ২০টিতেই পর্যটন হচ্ছে রফতানি আয়ের প্রধান বা দ্বিতীয় প্রধান উৎস। বাংলাদেশেও এটা সম্ভব।’ এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে আলোচনা সভা থেকে তিন দফা সুপারিশ করা হয়’ ‘১. সামুদ্রিক ও উপকূলীয় পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের সুরক্ষাকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় পর্যটন নীতিমালা সংশোধন করা। ২. পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে যাতে স্থানীয় জনগোষ্ঠির উন্নয়ন হয় সে লক্ষ্যে আইনি পরিকাঠামো তৈরি করা। ৩. পর্যটন খাতটিকে বর্তমান অবস্থা থেকে টেকসই ভিত্তিতে নেয়ার প্রক্রিয়ায় প্রধান নেতৃত্বের ভূমিকায় বেসরকারি খাতকে নিয়ে আসতে নীতিগত ও আইনি পরিকাঠামো তৈরি করা।’
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক ড. সুলতান আহমেদ বলেন, বেসরকারি খাত, বেসরকারি সংগঠন ও নাগরিক সংগঠনগুলো সমন্বিতভাবে কাজ করলে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই পর্যটন নিশ্চিত করা সরকারের পক্ষে সহজ হবে। একইসঙ্গে প্রাণবৈচিত্র্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে কারণ, এসব প্রাণী ও পরিবেশই প্রকৃত অর্থে প্রধান ট্যুরিজম পণ্য।
শুধু পর্যটকদের জন্য বিশেষ এলাকা, উন্মুক্ত সাধারণ পর্যটন ও ইকো-ট্যুরিজম; এই তিন শ্রেণি বিশেষায়িত করে পর্যটন পণ্য পরিকল্পনার ওপর জোর দেয়ার আহ্বান জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক এমন শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমাদের উপকূলীয় অঞ্চল নীতিমালা ২০০৫’র সঙ্গে আমাদের পর্যটন নীতিমালা সাংঘর্ষিক। পর্যটন নীতিমালায় টেকসই ও পরিবেশবান্ধব দৃষ্টিভঙ্গীর ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞাণের অধ্যাপক ড. এম নিয়ামুল নাসের বলেন, পরিবেশবান্ধব পর্যটন ও প্রাণবৈচিত্র্যের সুরক্ষায় বিশেষজ্ঞদের যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সেন্ট মার্টিনসের মত সমৃদ্ধ প্রাণবৈচিত্র্যের দ্বীপে পর্যটনের ব্যাপারে সরকারের কোনো টেকসই পরিকল্পনা না থাকার ব্যাপারে হতাশা জানান তিনি। সামুদ্রিক প্রাণসম্পদ বিশেষজ্ঞ ড. কাজী আহসান হাবীব বলেন, আমাদের মীমাংসিত সমুদ্রসীমার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে সামুদ্রিক পর্যটন কর্মকাণ্ড হিসেবে যেমন স্কুবা ডাইভিং, স্নরকেলিং, সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণি ও পাখি দেখা, বোটিং ও সেইলিংয়ের সুযোগ চালু করতে হবে। লেখক ও সমালোচক রেজাউল করিম বলেন, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী বদলাতে হবে। মানুষ প্রকৃতির বাইরে নয়, যাতে প্রকৃতির অংশ হিসেবেই প্রকৃতির কাছে যায়, সে ধরণের দৃষ্টিভঙ্গী তৈরি করতে হবে।
সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তৃতা করেন বাপার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাজাহান মৃধা বেণু, সেভ আওয়ার সি’র প্রোগ্রাম ডিরেক্টর আশিক উস সালেহীন এবং ডিরেক্টর অব এক্সপ্লোরেশন এসএম আতিকুর রহমান।
বক্তারা বলেন, মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা নিষ্পত্তির পর থেকে সামুদ্রিক সম্পদের কথা বারবার হচ্ছে। কিন্তু ঠিক কিভাবে এর সুরক্ষা ও ব্যবস্থাপনার দিকে যাওয়া যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ তেমন শুরু হয়নি এখনো। এ সম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনার বিষয়ে নীতি নির্ধারণী কর্তৃপক্ষ ও জনগণের সামনে তুলে ধরার দায়িত্ব গণমাধ্যমকে নিতে হবে।
প্রসঙ্গত, বঙ্গোপসাগরের প্রাণসম্পদ ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগ সেভ আওয়ার সি সম্প্রতি সাগরতলের প্রবাল-বসতির হাল অব্স্থা নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র সিরিজ উদ্বোধন করেছে। এর প্রচারে নানা ধরণের সহায়তা করছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।