নগর সৌন্দর্যে লতাবট ও টোপিয়ারি

জায়েদ ফরিদ

ভোরবেলা পিচঢালা কালো সড়কের ওপর দিয়ে আয়েশি গতিতে এগিয়ে চলেছে ধোয়ামোছা চকচকে ট্যুরিস্ট বাস। যাত্রীরা দুপাশের জানালা দিয়ে দৃষ্টি প্রসারিত করে রেখেছে আশেপাশের সবুজ সৌন্দর্যে। বেশ ঝাঁঝা করা একটা শব্দ আসছে রাস্তার পাশ থেকে। ঘাস কাটা মেশিনের আওয়াজ। ঘুম ভাঙা শহরের প্রথম কাজ হল বাগান পরিচর্যা। কখনো বনের পাশ দিয়ে চলেছে বাস, যতদূর চোখ যাচ্ছে বনের গভীরে দেখা যাচ্ছে আগাছামুক্ত গাছ। গাছের কাণ্ডগুলি এত স্পষ্ট সাদা রঙ করা যে একটি একটি করে গোনা যায়। নগরের এতসব নান্দনিক সবুজ চর্চার ভেতর একটি বিষয় কিন্তু সকলের মনে পরম বিস্ময় সৃষ্টি করছে। রাস্তার ওপরে যে সব সেতু আর উড়ালপোল রয়েছে সেগুলোর অবয়বে কংক্রিটের চিহ্নমাত্র নেই, মনে হচ্ছে সবুজ লতার ওপর ভেসে আছে তারা।

পঞ্চাশ বছর আগে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা লাভের পর সিঙ্গাপুরের প্রধান মন্ত্রী লি কুয়ান ইউ দেশ গড়ার কাজে নামলেন গার্ডেন-সিটির মতাদর্শ নিয়ে। তার ধারণায় ইট-পাথর-সিমেন্ট-কংক্রিটের রূক্ষ্ম পরিবেশ মানুষের আত্মিক উন্নতির পক্ষে অন্তরায়, এর জন্যে চাই সবুজের সমারোহ। এক চিলতে কংক্রিট আর সিমেন্ট যেন কারো চোখে না পড়ে সেজন্যে তিনি খুঁজে বের করলেন অদ্ভুত এক মোড়ক-লতা, যার নাম লতাবট।

লতাবটের প্রাথমিক চলন
লতাবটের প্রাথমিক চলন

ডুমুর শ্রেণীর এই লতাবট টিকটিকির মতো দেয়াল বেয়ে ওঠে দু’তিন তলা পর্যন্ত। এদের শরীরে ঝিঙ্গে-ধুঁধুলের মতো কোনো আঁকশি নেই, নেই করুণভাবে অন্যকে ধরপাকড় করে বেড়ে ওঠার সীমাবদ্ধতা। লতাবটের সন্ধি-শেকড় থেকে নিঃসৃত হয় পলিস্যাকারাইড আর প্রোটিনের একপ্রকার দারুণ আঠা যা প্রায় যে কোনো পৃষ্ঠেই লতাকে আটকে রাখতে পারে। এর একটি সঙ্গত কারণও আছে। অন্যান্য মহীরুহ বটের ডুমুর হয় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যা পাখিদের খাবার জন্যেই নির্ধারিত, যে কারণে দেখি পাশাপাশি অনেক বটের গাছে এক সঙ্গে ডুমুর ধরে না, সারা বছর যাতে এগাছ ওগাছ করে পাখিরা খাবার সংগ্রহ করতে পারে। এদিকে এক ইঞ্চি পাতার লতাবটের ফল হয় ৩-৪ ইঞ্চি লম্বা। এর ভার বহন করার জন্যে বেশ খানিকটা শক্তও হতে হয় আঠাকে। আর এ কারণে কাঠ বা কাঠের তৈরি ট্রেলিসের ওপর দিয়ে এ গাছ না চড়ানোই ভাল।

লতাবটের কার্পেট
লতাবটের কার্পেট

এই ফল এত বড় হয় কেন এ নিয়ে আমাদের চিন্তা রয়েছে অনেককাল আগে থেকে। হয়তো মানুষের জন্যেই এদের আকৃতিটা বড়, যাতে অন্তর্নিহিত আছে কিছু কল্যাণের ইঙ্গিত। এর ফলের আকার-আকৃতি থেকে ধারণা করেই হয়ত প্রাচীন মানুষ একে প্রয়োগ করেছে জরায়ুর নানাবিধ ভেষজ চিকিৎস্যায়। এ ছাড়া খুব সুন্দর এক ধরণের হলুদ রঙের জেলি তৈরি হয় এর বীজ থেকে, সিঙ্গাপুরে যার নাম আইস জেলি, কিন্তু বাজারে এসব পাওয়া যায় না একমাত্র জাপান ছাড়া। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ থাকে, এ গাছের আদি নিবাস চীন জাপান ভিয়েৎনাম। কিন্তু এখন এই লতা পৃথিবী বিস্তৃত এবং আমাদের দেশেও চোখে পড়ে মাঝে মাঝে।

৩-৪ ইঞ্চি লম্বা লতাবটের ডুমুর
৩-৪ ইঞ্চি লম্বা লতাবটের ডুমুর

লতাবট ইনডোর প্ল্যান্ট হিসেবে টবে ও ঝুলন্ত পাত্রেও লাগানো যায় কিন্তু খেয়াল রাখতে হয় জলের প্রতি। জল জমে থাকলে শেকড় পচে যায়, কম হলে পাতা শুকিয়ে মরে যায়। অনেকে সবুজের মধ্যে কিছুটা সাদা মেশানো ভ্যারিয়েগেটা বা বিচিত্র প্রজাতির লতাবটও গৃহসজ্জায় ব্যবহার করে থাকেন। বাইরে একে বেশ কাজে লাগানো হয় ল্যান্ডস্কেপিং-এ। এতে অবশ্য লতাটির দেয়াল বেয়ে ওঠার অনুপম রূপটি প্রকাশিত হয় না। শূন্যে ঝুলন্ত অবস্থায় এদের দেহ নিঃসৃত ফুট-প্যাড আঠা শুকিয়ে যায়, আবার মাটিতে বেয়ে গেলে সন্ধি থেকে জমিনে শেকড় প্রবেশ করে। হরিণ বা গবাদি পশু এর পাতা খায় না, তাই বেড়া দিয়ে সাবধান হবার প্রয়োজন পড়ে না।

এই ক্ষুদে বট ছায়া ভালবাসে। উত্তর দিকের দেয়ালে এরা সুস্বাস্থ্যে বিস্তার লাভ করে। প্রখর সূর্যালোকে এর চিরসবুজ চরিত্র নষ্ট হয়, পাতা রূক্ষ্ম হয়ে ঝরে যায়। দেয়ালে চড়ানো লতাবট বেশ কিছদূর পর্যন্ত এক মনে ওপরে উঠতে থাকে, যা প্রায় ছবির মতো লেপ্টে থাকে দেয়ালের সাথে। এক সময় এই উল্লম্ব গাছের পাশের দিকে ডাল গজায়। প্রাথমিক অবস্থায় পাতাগুলি থাকে বেশ ছোট, এক ইঞ্চির মতো লম্বা, হার্ট আকৃতির, কচি পাতা তামাটে রঙের। গাছ পুষ্ট হলে পাশাপাশি ছড়ানো ডালগুলিতে পাতার আকার হয় ৩-৪ গুণ বড় এবং তখন গাছে ফলও ধরা শুরু হয়। অতএব; ফল ধরা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে গাছের সরল কার্পেটপ্রতীম সৌন্দর্য নষ্ট হতে পারে, যে কারণে ছেঁটে রাখার প্রয়োজন দেখা দেয়। ইনডোরে অবশ্য এ গাছের ফল ধরে না পুষ্টি ও বৃদ্ধির নিয়ন্ত্রণের কারণে।

হাইওয়ের দু’পাশের দেয়ালে লতাবট লাগালে শব্দদূষণ কমে যায় অনেক, কারণ এর পাতার বিন্যাস শব্দতরঙ্গ ভেঙে দিতে পারে অনায়াসে। পুরনো কদর্য প্রাচীরকে নান্দনিক জীবন্ত রূপ দিতে এই লতার ভূমিকা অপরিসীম। অনেকে পুরনো গৃহের দেয়ালেও একে লাগিয়ে থাকেন তবে সেক্ষেত্রে জানালা এবং ঘুলঘুলির প্রতি খেয়াল রাখতে হয়, কারণ ছাঁটকাটে অমনোযোগী হলে দ্রুত বর্ধনশীল এই লতা এগুলো দারুণভাবে ছেয়ে ফেলতে পারে যা পরে নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। এই লতার আরেকটি নান্দনিক ব্যবহার আছে টোপিয়ারি শিল্পে যা আমাদের দেশে বিক্ষিপ্তভাবে দেখা গেলেও অদ্যাবধি গুরুত্ব পায়নি।

টোপিয়ারি এক ধরনের বাগান শিল্প যাতে গাছ গুল্ম লতা ইত্যাদির বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করে সৃজনশীল কোনো আকার দেয়া হয়। এর মধ্যে দেবদেবী, দৈত্য-দানব, জ্যামিতিক আকার ইত্যাদি থাকলেও সবচে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে জীবজন্তূর আকৃতিসমূহ। ২০০০ বছর আগে রোমান সভ্যতায় প্রথম টোপিয়ারি শিল্পের উল্লেখ দেখা যায়। তৎকালীন রোমে বাগানের শিল্পীরা কৃতদাসগোত্রীয় হলেও তাদের নাম কিন্তু বাগানের কোথাও না কোথাও প্রস্তরফলকে খোদিত অবস্থায় থাকতো যা থেকে অনুমান করা যায়, মানুষ তখন এই শিল্পকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতো। এরপর অষ্টাদশ শতকের শুরুতে এই শিল্প দারুণ উৎকর্ষতা লাভ করে যখন টোপিয়ারি টেকনিকগুলি হল্যান্ড থেকে ইংল্যান্ডে চলে যায়। কিন্তু চরম বিকাশের পর এর বিপক্ষে মতামত চালু হয়। বিখ্যাত কবি আলেকজান্ডার পোপ এর বিরোধিতা করেন। তিনি মনে করতেন, মানুষ প্রকৃতি থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে, গাছের শরীরে ঢুকে পড়ছে জীবজন্তু, তারা পূর্ণ গাছের স্বাধীন মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারছে না।

পেনসিলভানিয়ার নিকটে লংউড গার্ডেন-এ টোপিয়ারি শিল্প (ইউ গাছের জ্যামিতিক আকার যা ৪০০-৬০০ বছর বেঁচে থাকে
পেনসিলভানিয়ার নিকটে লংউড গার্ডেন-এ টোপিয়ারি শিল্প (ইউ গাছের জ্যামিতিক
আকার যা ৪০০-৬০০ বছর বেঁচে থাকে

এখন টোপিয়ারি শিল্পকে দেখা হচ্ছে জড়রূপী বিল্ডিং এবং প্রকৃতির মধ্যেকার একটি অন্তর্বর্তীকালীন জ্যামিতিক যোগসূত্র হিসেবে। রোডস্‌ আয়ল্যান্ড, পেন্সিলভানিয়া এবং মেরিল্যান্ডে যে সব টোপিয়ারি বাগান দেখা যায় তাতে বেশি মনোযোগ দেয়া হয়েছে তারজাল নির্মিত খাঁচার ওপর, যাতে লতাবট বা আইভি জাতীয় কোনো লতার ছাউনিতে কোনো আকৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়। ডিজনি ওয়ার্ল্ড ও ডিজনি ল্যান্ডে মিকিমাউস ও অন্যান্য কিছু কারটুন চরিত্রও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে টোপিয়ারি শিল্পের মাধ্যমে।

লতাবট দিয়ে নির্মিত জীবাকৃতি
লতাবট দিয়ে নির্মিত জীবাকৃতি

তারজাল নির্মাণ করে আকার তৈরিতে এখন যে প্রাধান্য এসেছে এই শিল্পে তাতে ব্যবহার করা হচ্ছে মাটি মেশানো স্ফ্যাগনাম মস্‌ যার জল ধারণ ক্ষমতা খুব বেশি। এসব মসের দেহে ছিদ্র করে লতাবট, আইভি ইত্যাদির চারা রোপন করা হয়, যাতে নিশ্চিত করা থাকে নিয়ন্ত্রিত জলধারা।

নোটঃ

লতাবট = Ficus pumila
জেলি তৈরির লতাবট = Ficus pumila var awkeotsang
স্ফ্যাগনাম মস্‌ = Sphagnum cymbifolium etc.

লেখকঃ কিউরেটর (টেক) সায়েন্স ওয়েসিস মিউজিয়াম, রিয়াদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics