নেপালের কান্নাঃ আসুন বাড়াই বন্ধুত্বের হাত…
সামস জামান রাফি
দিনটি শুরু হয়েছিল অন্যান্য দিনের মতই। শান্ত শহরে কর্মব্যস্ত মানুষের আনাগোনা শুরু হয়েছিল। দল বেঁধে স্কুলে যাচ্ছিল ছেলেমেয়ের দল। বাড়ির কাজ গুছিয়ে রাখছিলেন ব্যস্ত গৃহিণী। অফিসগামী লোকটি ব্যস্ত পায়ে ছুটে চলেছিলেন। হিমালয়ের কোল ঘেষে বেড়ে ওঠা, শান্ত ছিমছাম শহরটি কাউকে কিছু জানান না দিয়েই হঠাৎই দুলে উঠলো ভীষণ ভাবে। হিমালয় দেখে যাদের ঘুম ভাঙে, হিমালয়ের হাওয়া যাদের আগলে রাখে বার মাস- সেই হিমালয় কন্যা নেপাল দুলে উঠলো স্মরণ কালের অন্যতম ভয়াবহ ভূমিকম্পে, রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৭.৯ এবং মুহুর্তের মধ্যেই শান্ত নিরুপদ্রব শহরটি পরিণত হল মৃত্যুপুরীতে, ধ্বংসস্তূপে।
এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে লামজুং-এ। এই ভূমিকম্পের ধাক্কা এসে লাগে বাংলাদেশ এবং ভারতেও। তবে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু। এর আগে নেপালে ১৯৩৪ সালে ৮.১ মাত্রার ভূমিকম্পে নিহত হয় প্রায় ১০ হাজার মানুষ। সেবারের তুলনায় মাত্রাটা একটু কম হলেও মৃতের সংখ্যা হয়তো ‘৩৪ এর সংখ্যাটিকেও ছাড়িয়ে যাবে। বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার তথ্য মতে সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৫০০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে, দেশটির প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এই সংখ্যা ১০,০০০ ছাড়িয়ে যাবে। বলাই বাহুল্য, এখনও অনেক মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। আহত হয়েছে ১০ হাজারেরও অধিক মানুষ। এছাড়া পুরো দেশটিই এখন ধ্বংসস্তূপ।এই ধ্বংসস্তূপের ভিতর থেকে হিমালয় কন্যা নেপাল আবার কবে উঠে দাঁড়াবে – সেটা আমাদের কারোরই জানা নেই।
নেপালের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর একটিই এবং সেটিও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তাই বাইরে থেকে সাহায্য আসতে যথেষ্ট বাঁধার মুখে পড়তে হচ্ছে। ভূমিকম্পের পরপরই বারংবার ‘আফটার শক’ এর কারণে উদ্ধারকাজও বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। দেশটিতে খাবার পানি,খাবার,ওষুধ,সার্জিকাল সরঞ্জাম সহ সব রকম দরকারী জিনিসের অভাব এখন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সাহায্য এলেও নেপালের বিশাল ক্ষয়-ক্ষতির কাছে সেটা পর্যাপ্ত নয়। তাৎক্ষনিক ভাবে তাঁদের দরকার আরও অনেক সাহায্য। বাংলাদেশে অবস্থিত নেপাল দূতাবাসে সাহায্য গ্রহণের জন্য ‘হেল্প ডেস্ক’ খোলা হয়েছে। এছাড়াও ভূমিকম্পের পর উদ্ধারকাজে অংশ নিতে নেপালে গমন করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
ত্রাণ হিসেবে এখন দরকার প্রচুর পরিমাণে মেডিকেল সরঞ্জাম,শুকনো খাবার,বিশুদ্ধ পানি,গজ,সার্জিকাল সরঞ্জাম,তাবু,টর্চ,কম্বল,পোশাক সহ অন্যান্য দরকারী জিনিস। এছাড়াও তাঁদের আবাসনের বিষয়টিও মাথায় রাখা দরকার কারণ এই মুহুর্তে তাঁদের অধিকাংশই খোলা আকাশের নিচে বাস করছে।আবাসনের এই সমস্যা সমাধানের একটি চমৎকার উপায় কিন্তু আছে যা একই সাথে সাশ্রয়ী,সহজ এবং নিরাপদ। নেপালের আক্রান্তদের জন্য বিশেষ ধরণের অস্থায়ী শেলটারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে যাকে বলা হয় “Emergency Sandbag Shelter.” প্লাস্টিক আর বালি দিয়ে তৈরি এই স্যান্ডব্যাগ গুলো দিয়ে যে বাড়ি বানানো যায় তা একই সাথে সাশ্রয়ী,কম খরচেই তৈরি করা সম্ভব এবং নিরাপদ,যা এই দুর্যোগ প্রবণ সময়ে খুব বেশি দরকারী। বাংলাদেশের কয়েকজন আর্কিটেক্ট এবং বাংলাদেশে অধ্যয়নরত কয়েকজন নেপালী শিক্ষার্থী এই স্যান্ডব্যাগ নিয়ে খুব শীঘ্রই নেপালে যাচ্ছেন, সেগুলো ক্ষতিগ্রস্থ দের মধ্যে বন্টন করতে এবং কিভাবে বাড়ি তৈরি করতে হয় সেই প্রশিক্ষণ দিতে।
বন্ধু রাষ্ট্র নেপালের এই চরম বিপর্যয়কর মুহুর্তে তাদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের মানবিক দায়িত্ব। নেপাল দূতাবাস থেকে জারি করা এক বিজ্ঞপ্তি তে সাহায্য পাঠানোর দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সরাসরি আর্থিক সাহায্য করতে হলে ছবিতে উল্লেখিত ব্যাংক একাউন্টে এবং অন্য কোন ত্রাণ সামগ্রী দিতে হলে সেটা সরাসরি নেপাল দূতাবাসে পৌছে দিতে অনুরোধ করা হয়েছে।
এছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন নেপালের ক্ষতিগ্রস্থ দের জন্য সাহায্য সংগ্রহ করছে যা বাংলাদেশে অধ্যয়নরত নেপালী শিক্ষার্থী এবং নেপাল দূতাবাসের মাধ্যমে নেপালে পাঠিয়ে দেয়া হবে। এর মধ্যে Emergency Sandbag Shelter নিয়ে কাজ করছে যে সংগঠনটি তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে, তাদের মাধ্যমে নেপালে আপনার সাহায্য পৌঁছে দিতে আপনি ঘুরে আসতে পারেন তাঁদের ফেসবুক পেইজ থেকে।
https://www.facebook.com/events/1594125247497221/
প্রশ্ন আসতে পারে ‘আমি কেন অন্য দেশের জন্য সাহায্য করব যেখানে আমার নিজের দেশেই সাহায্য দরকার অনেকের?’ হুম ভাল প্রশ্নই বটে। তবে উত্তরটাও সোজা। উত্তর টা খুঁজতে আপনাকে যেতে হবে একটু পিছনে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, একদল ছেলেমেয়ে রাস্তায় ভিক্ষা করছে, সাহায্য তুলছে, সালটা ১৯৭১। ওরা বাংলাদেশী শরণার্থীদের জন্য সাহায্য তুলছিল। জর্জ হ্যারিসন মেডিসন স্কয়ারে কনসার্ট করেছিলেন, এই কনসার্ট হতে সংগৃহীত ২,৫০,০০০ ডলার বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের জন্য দেয়া হয়েছিল। ঐ বিদেশীরা এই কাজ গুলো না করলেও আমরা স্বাধীন হতাম। কিন্তু আমরা তাঁদের হৃদয়ে স্থান দিয়েছি কারণ মানুষ গুলো আমাদের জন্মের সেই কঠিন সময়টিতে আমাদের পাশে ছিলেন।
মানবিকতার খাতিরেই বন্ধু হিসেবে বন্ধুর পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক কর্তব্য। ধ্বংসস্তূপ হতে আবার জেগে উঠবে নেপাল, তাদের নিজেদের শক্তিতেই।কিন্তু এই চরম বিপর্যয়ের মুহুর্তে আমরা যদি তাদের পাশে না দাঁড়াই তাহলে ‘মানবিকতার’ সংজ্ঞাই মিথ্যা হয়ে যাবে। যারা মৃত্যু বরণ করেছে তাঁদের জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই। কিন্তু যারা আহত হয়েছেন এবং মানবেতর জীবন যাপন করছে্ন তাঁদের জন্য আমাদের করার আছে অনেক কিছুই। কাজটি খুব কঠিন নয়, দরকার কেবল মানবিক সদিচ্ছা…
আজ থেকে ৫০ বছর পর নেপালের কোন মা হয়তো তার সন্তান কে বলবে- “বাংলাদেশ, বাংলাদেশের নাম শোননি? সেবার যখন প্রবল ভূমিকম্পে আমরা মাটির সাথে মিশে গিয়েছিলাম, ওরা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল…”