জিকা ভাইরাসের আদ্যপান্ত!
দিব্য কান্তি দত্ত
‘জিকা’ ভাইরাস বেশ কিছুদিন হল একটি বহুল আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্রাজিলে এই ভাইরাস বেশ গুরুতর প্রভাব ফেলেছে। ইতোমধ্যে আমেরিকা ছাড়িয়ে ইউরোপেও এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। হুমকির মুখে রয়েছে এশিয়াও! এই ভাইরাস যে শুধু রোগ সৃষ্টি করছে তা নয়, জনমানুষে বেশ ভালভাবেই আতঙ্ক ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। অসুখের তুলনায় আতঙ্ক বেশি ছড়ানো এই ভাইরাস নিয়ে কিছু কথা বলে ফেলা যাক তাহলে…
‘জিকা ভাইরাস’ ‘Flaviviridae’ গোত্রের ‘Flavivirus’ গণের অন্তর্ভূক্ত। এই ভাইরাস সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯৪৭ সালে ‘উগান্ডা’র ‘জিকা’ বনের এক বানরের দেহে এবং পরবর্তীতে ওই বনের নামানুসারেই এই ভাইরাসের নামকরণ করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাধারণত ‘এডিস মশা’র ‘ইজিপটি’ প্রজাতি এই ভাইরাস বহন করে থাকে। ডেঙ্গু, ইয়োলো ফিভার, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস এবং জাপানিজ এনসেফালাইটিসের সাথে এর সাদৃশ্য রয়েছে। এই ভাইরাসটি আবৃত, অবিচ্ছিন্ন, একসূত্রক, পজিটিভ সেন্স(একটি ডি-অক্সি রাইবোজ সুগারের পঞ্চম কার্বন পরবর্তী সুগারের তৃতীয় কার্বনের সাথে যুক্ত) ‘আরএনএ’ ভাইরাস। ভাইরাসটির আকৃতি ‘ইকোসাহেড্রাল’ অর্থাৎ এর তল বিশটি, ধার ত্রিশটি এবং শীর্ষ বারোটি। ১৯৪৭ সালে ‘রেসাস ম্যাকাক’ প্রজাতির বানরের দেহে এই ভাইরাস আবিষ্কৃত হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে ‘Aedes africanus’ মশাকে এর বাহক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৫৪ সালে নাইজেরিয়ায় সর্বপ্রথম মানবদেহে এই ভাইরাস ধরা পড়ে। তথ্য এবং উপযুক্ত প্রমাণসহ এই ভাইরাস সম্পর্কে জানা যায় সে বছরই এবং বিস্তারিত বর্ণনা প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে।
‘জিকা ভাইরাস’ আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে সাধারণত গুরুতর ধরনের কোন লক্ষণ দেখা যায়না। তবে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃদু মাথাব্যাথা, হালকা জ্বর, দেহে র্যাশ ওঠা, চোখের প্রদাহ, অস্থিরতাবোধ, হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যাথা প্রভৃতি লক্ষণ দেখা যেতে পারে। এই জ্বর সাধারণত ৫-৭ দিন স্থায়ী হয় এবং এতে মৃত্যু ঝুঁকি প্রায় নেই বললেই চলে। এখনও পর্যন্ত এর কোন প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। তবে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য প্যারাসিটামল, অ্যাসপিরিন, প্রদাহরোধক ওষুধ ব্যবহৃত হয়। এছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য বিশ্রাম নেয়া অত্যন্ত জরুরী এবং প্রচুর পানীয় জাতীয় খাবার গ্রহনীয়।
তবে গর্ভবতী নারীদের জন্য এই ভাইরাস চিন্তার বিষয়ই বটে। এই ভাইরাসের প্রভাবে ব্রাজিলে গত অক্টোবর মাস থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্তই জন্ম নিয়েছে প্রায় ৩৫০০ ছোট মাথার শিশু। অর্থাৎ, ‘জিকা ভাইরাস’এ আক্রান্ত হলে গর্ভস্থ শিশুর স্বাভাবিক বিকাশে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ রোগ ‘মাইক্রোসেফালি’ নামে পরিচিত যা শিশুর মস্তিস্কের পরিপূর্ণ বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে এবং শিশু স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট মাথা নিয়ে জন্মায়। ‘জিকা ভাইরাস’র কারণেই এমনটি হচ্ছে এ বিষয়ে গবেষণালব্ধ সুনির্দিষ্ট কোন প্রমাণ নেই। তবে ‘জিকা ভাইরাস’ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে এমন শিশুর জন্মহার ত্বরাণ্বিত হওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে যে, ‘জিকা ভাইরাস’ই এর জন্য দায়ী।
বর্তমানে এ রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে সারাবিশ্বের মানুষের ভাইরাস আক্রান্ত এলাকায় যাতায়াতের ফলে। ‘জিকা ভাইরাস’র প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)’ জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছে। এই ভাইরাসটি উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার ২৪ টি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে ‘দি প্যান হেলথ অর্গানাইজেশন’। শুধু ব্রাজিলেই এই ভাইরাসের কারণে ৪০০০০ বুদ্ধি প্রতিবন্ধী জন্ম নিয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানে আরও ধারণা করা হচ্ছে যে, শুধু উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকাতেই এ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা চল্লিশ লাখে গিয়ে ঠেকতে পারে। ‘জিকা ভাইরাস’ ঠেকাতে প্রায় ২২০,০০০ সেনা মোতায়েন করতে যাচ্ছে ব্রাজিল সরকার। ব্রাজিলের পরিবেশ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মার্কাস ভিনিশাস ফেরেইরার ভাষায়, “জিকা ভাইরাসের ঝুঁকি অতীতের তুলনায় বড় কিছু নয়। চার বছর আগে এর সংক্রমণের হার ছিল ২.৯ শতাংশ। এ বছর তা কমে এক শতাংশে এসেছে।”
তবে বর্তমানে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী এ ভাইরাস শারীরিক সম্পর্কের দ্বারা ছড়িয়ে পড়ছে। টেক্সাসে এই ভাইরাসে আক্রান্ত এক ব্যক্তির চিকিৎসা করতে গিয়ে চিকিৎসকেরা বিষয়টি আবিষ্কার করেছেন। তার সঙ্গিনী ‘জিকা ভাইরাস’ আক্রান্ত এলাকা ভেনেজুয়েলা থেকে আসার পর তিনি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হন। এদিকে সতর্কতার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে ভাইরাস আক্রান্ত এলাকা থেকে আগত ব্যক্তিকে বিমানবন্দরে প্রয়োজনবোধে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র জরুরী অবস্থা জারির পর কুর্মিটোলা হাসপাতালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. দীন মো. নূরুল হকের সভাপতিত্বে আয়োজিত বৈঠকের পর এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এখনো পর্যন্ত ‘জিকা ভাইরাস’র কোন প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। গবেষকদের মতে সঠিক প্রতিষেধক তৈরি করতে তাদের কমপক্ষে দুই বছর লাগবে। তবে ব্যবহারের উপযোগী করে বাজারজাতকরণের জন্য তাদের কমপক্ষে দশ থেকে বারো বছর লেগে যাবে। হায়দ্রাবাদের ‘ভারত বায়োটেক’ নামক এক ওষুধ কোম্পানি দাবি করেছে যে, তারা এই ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছে। কিছুদিনের মধ্যেই তারা তা বাজারজাতকরণ করতে পারবে।
নির্দিষ্ট ওষুধ আবিষ্কৃত না হওয়ায় ‘জিকা ভাইরাস’এ আক্রান্ত রোগীর ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহন করতে হবে। বিশ্রামে থাকতে হবে এবং প্রচুর পরিমাণে পানি ও পানীয় জাতীয় খাবার খেতে হবে। গর্ভবতীদের জন্য বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ঘর-বাড়ি মশামুক্ত রাখার জন্য আশেপাশের ঝোপঝাড়, নালা, পুকুর পরিস্কার রাখতে হবে। মশারী এবং মশানাশক ক্রীম ব্যবহার করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে নিরাপদে থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রয়োজনীয় সতর্কতাই এই রোগ থেকে সবাইকে মুক্ত রাখতে পারবে।
‘স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়’র অধ্যাপক এবং গবেষক রউফুল আলম এ সম্পর্কে বলেন, “বাংলাদেশে প্রায়শই কোন রোগ সম্পর্কে সঠিক তথ্য না দিয়ে ভয় জাগিয়ে দেয়া হয়। অযথা ভীতি নিয়ে না থেকে সঠিকভাবে জানুন। নিজে সচেতন হয়ে অন্যকে জানান এবং সে অনুযায়ী সতর্কতা অবলম্বন করুন। মানব সভ্যতায় রোগ নতুন কিছু নয়। রোগ লড়াইয়ে প্রয়োজন সঠিক জ্ঞান ও সাবধানতা। বাংলাদেশ হোক ‘জিকা ভাইরাস’ মুক্ত এই কামনা।”