বিপন্ন-প্রায় সাদা বাদুড়!!
মোঃ সাইফুল ইসলাম
বাদুড় পৃথিবীর একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী, যা উড়তে সক্ষম। এরা Chiroptera বর্গের অন্তর্ভূক্ত। পৃথিবীতে প্রায় ১১০০ প্রজাতির বাদুড় রয়েছে। এদের প্রজাতির সংখ্যা স্তন্যপায়ী প্রাণিদের মোট প্রজাতির শতকরা প্রায় ২০ ভাগ। প্রায় ৭০ ভাগ বাদুড় পতঙ্গভূক। আর বাকিরা ফলমূল খায়। এরা নিশাচর প্রাণী। দিনের বেলায় অন্ধকার স্থানে, উঁচু গাছের ডালে, গুহায় কিংবা গাছের ফোঁকরে ঝুলে থাকে।
রাতের আঁধারে উড়তে অথবা গাছের ডালে ঝুলতে থাকা বাদুড়, যা আমরা সচরাচর দেখে থাকি তা কিন্তু সাধারণত বাদামী, ধূসর কিংবা কালো রঙের হয়ে থাকে। কিন্তু সাদা রঙের বাদুড়!! সত্যিই অবাক হবার মত কথা। হ্যাঁ, সাদা রঙের বাদুড়ের কথাই বলছি।
হন্ডুরান হোয়াইট ব্যাট (হন্ডুরাসের সাদা বাদুড়) যার বৈজ্ঞানিক নাম Ectophylla alba. এদের সাদা পশম, হলুদ নাক এবং কান রয়েছে। এরা খুবই ছোট এবং দৈর্ঘ্যে ৩.৭-৪.৫ সে.মি. পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। অদ্বিতীয় সাদা বাদুড়ের দুইটি প্রজাতির মধ্যে হন্ডুরান হোয়াইট ব্যাট একটি। ১৮৯২ সালে আমেরিকার প্রাণি ও পক্ষীবিদ ড. জোয়েল আসাফ অ্যালেন হন্ডুরাস এবং পানামায় বাদুড়টি প্রথম সনাক্ত করেছিলেন। তাছাড়াও এদের আদিবাস হচ্ছে কোস্টারিকা ও নিকারাগুয়া। সম্প্রতি এই প্রাণিটি বিপন্ন প্রাণিদের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ Speak up for voiceless নামক একটি আন্তর্জাতিক অ্যানিম্যাল রেসকিউ ফাউণ্ডেশন এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
কোস্টারিকায় এদের সংখ্যা কমার পিছনে খাদ্য ও বাসস্থানের সংকটকেই দায়ী করা হয়েছে। এরা সাধারণত সম্পূর্ণ ফল না খেয়ে আংশিক খেয়ে থাকে। এই বাদুড়গুলো সাধারণত হেলিকোনিয়া (Heliconia) গাছের পাতার পার্শ্বশিরা কেটে তাবু কিংবা উল্টানো নৌকা আকৃতির রুস্ট (বাদুড়ের বাসাকে রুস্ট বলে) তৈরী করে। প্রতিটি বাসায় কলোনী আকারে ছয়টি বা তারও বেশি বাদুড় ঝুলে থাকে। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক অ্যানিম্যাল রেসকিউ ফাউণ্ডেশনটি ব্রাজিলে পর্যবেক্ষণ করে দেখেন প্রধানত বনজঙ্গল উজার, কাঠের ব্যবসা এবং সেই সাথে ফলদ বৃক্ষ কাঁটার কারণে সেখান থেকে এই বাদুড়ের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে।
সাদা রঙের পশম থাকায় যখন সূর্যের আলো পাতায় পড়ে তখন এটি সবুজ দেখায়। এভাবে এরা শিকারীর হাত রক্ষা পায়। এটি একটি অদ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য। কারণ অন্য কোন বাদুড় অথবা পাখীরা তাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে তাদের নিজেদের রং বদলাতে পারে না। তথাপিও এই বাদুড়ের সংখ্যা বিগত ১০ বছরে ৩০% কমে গেছে। সোমবার ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ তে প্রকাশিত নিবন্ধে এক লক্ষ লোকের চোখে এই সাদা বাদুড়ের অস্তিত্ব ধরা পড়েনি বলে জানান সংগঠনটি।
বনজঙ্গল উজার, খাদ্যের সংকট, বাসস্থান ধ্বংস, কাঠ ব্যবসা, কাঠ কাটার শব্দ কিংবা পোড়ানো প্রাণিগুলোর বিলুপ্তির পথকে ত্বরান্বিত করছে। এবার সাদা বাদুড়গুলোর বিলুপ্তির কারণ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি:
বনজঙ্গল উজার: কোস্টারিকায় জীববৈচিত্র ও পরিবেশ ধ্বংসের প্রধান কারণ হল বনজঙ্গল উজার। দেশটিতেই প্রায় অধিকাংশ সাদা বাদুড়ের বাস। সেখানে প্রায় ১২০০০ প্রজাতির গাছপালা, ১২৩৯ প্রজাতির প্রজাপতি, ৮৩৮ প্রজাতির পাখি, ৪৪০ প্রজাতির সরীসৃপ ও উভচর প্রাণি এবং ২৩২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণি রয়েছে। এরা সবাই এখন বনজঙ্গল উজারের ফলে হুমকীর মুখে পড়েছে।
খাদ্য সংকট ও জলবায়ুর পরিবর্তন: বাদুড় সাধারণত ৫-৩০ বছর বাঁচতে পারে। এরা জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজেদের দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে। উষ্ণমণ্ডলীয় প্রজাতির বাদুড় সাধারণত নেকটার বা ফুলের মধু, পরাগরেণু, ফলমূল খেয়ে বাঁচে। উদ্ভিদের বংশবিস্তারে সহায়তা করে। কিন্তু গাছপালা ধ্বংসের কারণে ও খাদ্যের অভাবে অনেক প্রাণিই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
আলোক দূষণ: আলোক দূষণ উষ্ণমণ্ডলীয় রেইনফরেস্টের বৃদ্ধি ব্যহত করছে। সাধারণত আমরা জানি গাছপালার জন্ম ও বৃদ্ধিতে আলোর ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু আলোক দূষণের ফলে বাদুড়রা উদ্ভিদের বীজ ছড়ানোতে সহায়তা করতে পারে না। তাছাড়া গবেষণায় জানা যায় কৃত্রিম আলো বাদুড়ের খাদ্যের জন্য সহায়ক পরিবেশ নয়।
অন্যান্য: অন্যান্য কারণের মধ্যে আছে প্রাকৃতিক শিকারী যেমন অপোসাম (আমেরিকার এক জাতীয় বৃক্ষবাসী স্তন্যপায়ী প্রাণি), সাপ ও মাংসাশী প্রাণি ইত্যাদি।
পরিশেষ, যেহেতু হন্ডুরান সাদা বাদুড় হেলিকোনিয়া পাতায় বাসা বাঁধে তাই আমেরিকার রেইনফরেস্ট ধ্বংস এদের জন্য বড় হুমকী। এই প্রজাতির বেঁচে থাকার জন্য রেইনফরেস্ট তথা হেলিকোনিয়াকে বাঁচাতে হবে। সাধারণত দিনের আলোয় এরা তাবুর নিচের রুস্টে থাকে এবং রাতের বেলায় খাবারের সন্ধানে বের হয়। ভয়ের কারণ নেই! হন্ডুরান সাদা বাদুড়েরা আপনার রক্ত চুষে খাবেনা! এরাতো শুধুমাত্র ফলমূল ও সবুজপাতা খায়!!
লেখক: শিক্ষার্থী- চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়
ভাল লাগল লেখাটি।