পরাগায়নে ভ্রমর-কুঞ্জের আবশ্যকতা
জায়েদ ফরিদ
পাটা বা সিমেন্টের ওপর আমের আঁটি ঘষে ঘষে আমরা ছেলেবেলায় ভেঁপু-বাঁশি বানাতাম যার আয়ু ছিল মাত্র এক প্রহর। বেশ সময় নিয়ে এই প্রহরের ভেঁপু বানাতে কষ্ট অতিক্রম করতে গিয়ে আমরা মুখে মুখে একটি ছড়া কাটতাম…
কালা কালা ভোমরা কালা ঘাস খায়
রাত পোহালে ভোমরা শহরেতে যায়
ভোমরা রাত পোহালে শহরে যায় না আর কালো ঘাসও খায় না। ভোমরা তাহলে কি খায় আর কোথাতেই বা থাকে! ভোমরা মানে ভ্রমর, মৌমাছি নয়, দেখতেও অনেক প্রভেদ।
ভোরবেলা টমেটো আর বেগুন ক্ষেতে এদের দেখতে পাওয়া যায়। বেগুন আর টমেটো ফুলে মধু নেই, তবু কেন সেখানে ভোঁভোঁ করে উড়ে বেড়ায় বেড়ায় তারা? তাদের বাচ্চাদের জন্যে খাবার দরকার, যার সিংহভাগ হল পরাগরেণু। এই পরাগ সংগ্রহের জন্যে ভ্রমর এক অদ্ভুত উপায়ে কাজ করে,যা মৌমাছি করতে পারে না। টমেটো এবং বেগুন ফুল নিখুঁত পূর্ণাঙ্গ ফুল অর্থাৎ এদের পুংকেশর, গর্ভকেশর, দল ও বৃতি সব আছে। কুমড়ো ফুলের মতো অপূর্ণাঙ্গ নয় যাদের পুরুষ ও স্ত্রী ফুল আলাদা। বায়ু প্রবল হলে এ ধরনের উভলিঙ্গ ফুলে পরাগায়ন হয়। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়, কারণ ফুল ফোটার সময় কখনো হাওয়া থমকে থাকতে পারে। অনেক সময় পরাগায়নের জন্যে গাছ ঝাঁকানো হয় যাতে পরাগ ঝরতে পারে। কিন্তু তা যথেষ্ট নাও হতে পারে সব ক্ষেত্রে। কারণ পরাগ হয়ত আঠার মতো জমে থাকে বৃষ্টি বা আর্দ্রতার কারণে। আর সুষ্ঠু পরাগায়ন না হলে ফল দুর্বল, বিকৃত হতে পারে এবং তাদের রোগপ্রতিরোধক ক্ষমতাও কমে যেতে পারে। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় জানা গেছে, প্রাকৃতিক প্রজননে স্ট্রবেরির ফলন ৪০% বেড়ে যেতে পারে; উত্তম প্রজনন হলে ফল দ্রুত পুষ্ট হয় এবং তাতে ফ্লেভার বেড়ে যায়।
টমেটো আর বেগুনের ক্ষেত্রে ভ্রমরই সবচে ভালো পরাগায়ন করতে পারে। নিম্নমুখী ফুলের শরীর নিচে থেকে পা দিয়ে আঁকড়ে ধরে ভ্রমর। এরপর তার উড্ডয়ন পেশী বা ফ্লাইট মাসল্-কে খুব দ্রুত গতিতে ল্যাবরেটরি টিউনিং ফর্কের মতো কাঁপাতে থাকে। দেখে মনে হয়, এই বুঝি উড়লো ভ্রমর। আদতে এই কাঁপুনিতে পরাগরেণুগুলি ঝুরঝুর করে খসে পড়ে তার দেহে, যেগুলোর কিছু জমা হয় তাদের পায়ের রোমশ থলি সিটি(Setae)তে এবং কিছু পরাগ লেগে যায় গর্ভমুণ্ডের ওপরে। এতে সুষ্ঠু পরাগায়ন হয়, টমেটো ও বেগুনের ফলন বাড়ে। এ ধরনের পরাগায়নকে উদ্ভিদবিদ্যার ভাষায় বলা হয় স্পন্দন পরাগায়ন বা Buzz pollination।
বিজ্ঞানীরা যখন আবিষ্কার করলেন ভ্রমরের কম্পন থেকেই সবচে ভালো পরাগায়ন হয়, তখন গ্রিনহাউসের ভেতর ব্যবহার শুরু হলো ফ্যাক্টরির তৈরি স্পন্দন-যন্ত্র বা ভাইব্রেটরের যার একটি বিখ্যাত ব্র্যান্ড ছিল “ইলেকট্রিক বি”। বৈদ্যুতিক পাখা ঘুরিয়ে সৃষ্টি করা হলো কৃত্রিম হাওয়া, কিন্তু কিছুতেই ভাল কাজ হল না, যা সম্ভব হত ভ্রমরের উপস্থিতিতে। সব কিছু বাদ দিয়ে এখন তারা আবার ভ্রমরকেই আস্তানা করে দিচ্ছেন গ্রিনহাউসে। নরম কাঠ দিয়ে তৈরি করছেন তাদের বাড়িঘর। বর্তমানে টমেটো বেগুনের সবজি ক্ষেতে ফিলিপাইনসহ পৃথিবীর কিছু দেশে এই কালো ভ্রমরের চাষ করা হচ্ছে পরাগায়নের জন্যে।
কৃষ্ণভ্রমর দেখতে খুবই সুন্দর যার ডানাগুলো ঘণ ময়ূরী নীল, আমরা প্রায়শ যার উপমা দিয়ে থাকি ভ্রমর কালো চোখের সাথে। এসব ভ্রমর-পুরুষ এলাকার রক্ষনাবেক্ষন করে, আস্তানার আশেপাশে কোনো প্রাণিকে দেখলেই তাকে প্রহরায় রাখতে চায়। মুখের ওপর, দেহের চারদিকে সশব্দে উড়তে থাকে, এমন কি গায়েও বসতে পারে, কিন্তু হুল ফোটায় না। পুরুষদের অবশ্য হুল থাকে না, হুল থাকে স্ত্রী-ভ্রমরের। কিন্তু ভ্রমরীও বাসাবাড়ি আর মধু-পরাগ আহরণ নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকে যে কারো প্রতি দৃকপাত করার সময় তাদের থাকে না। তবে বেশি উত্যক্ত করলে হুল তো ফোটাতেই পারে, কিন্তু তার নজীর মৌমাছির চেয়ে অনেক কম।
কালো ভ্রমর লালন করা মৌমাছি পালার মতো অতোটা সহজ নয়। ভ্রমর বাস করে নরম কাঠের ভেতরে, যার বেশিরভাগ মরা কাঠ কিন্তু পচা কাঠ নয়। আমাদের দেশে জাম, কণকচূড়া, শালগজারি গাছে ভ্রমরের বাসা দেখা যায়। মেটিং-এর পরে ডিম পাড়ার সময় হলে স্ত্রী-ভ্রমর গাছের গায়ে গর্ত করে এক-দেড় ইঞ্চি ভেতরে ঢোকে তারপর বাঁয়ে ডানে কাঠের আঁশ বরাবর কয়েকটি প্রকোষ্ঠ তৈরি করে যেগুলো বেড়া দেয় পাতলা কাঠের টুকরো দিয়ে। এর ভেতরে পরাগরেণু আর একটু মধু রেখে ডিম পাড়ে, তারপর বন্ধ করে দেয় সেগুলো। বাচ্চারা বড় হলে বেরিয়ে আসে গ্রীষ্মের শেষে। অনেক ক্ষেত্রে ভ্রমরীর মেয়ে আর বোনও একই নিবাসে থেকে যায়, কিন্তু পরিবারের সদস্য সংখ্যা নগন্যই থাকে। এরা স্বতন্ত্র, যুথবদ্ধ সামাজিক নয়, কিন্তু মানুষের সমাজের জন্য অপূরণীয় কাজ করে।
কালো ভ্রমরের মতো আরেক ধরণের ভ্রমর এই সব ফুলে পরাগায়ন করতে পারে, একই প্রকার স্পন্দন-পরাগায়নের মাধ্যমে। এদের পুরো গা রোমশ, হলুদ-কালো ডোরাকাটা, কালো ভ্রমরের মতো পিঠ চকচকে নয়। এদের বলতে পারি ডোরাকাটা ভ্রমর। এসব ভ্রমর মাটিতে বাসা করে, এরাও মৌমাছিদের মতো সমাজবদ্ধ, কিন্তু মৌচাকে যেখানে ৬০-৭০ হাজার মৌমাছি থাকে সেখানের এদের চাকে পাওয়া যাবে মাত্র ৫০ থেকে ২০০ ডোরাকাটা ভ্রমর। বসন্তের শেষে মাটির খুব কাছাকাছি কিছু ডোরাকাটা ভ্রমরকে উড়তে দেখা যায় যখন তারা বাসা তৈরির জন্যে আড়াল করা জায়গা খোঁজে, যেখানে মানুষের চোখ পড়ে না, বন্যা-বৃষ্টিতে জল ওঠে না, দেখতে ফাটল বা গর্ত জাতীয়। কখনো ব্যর্থ হলে এরা নির্বাচন করতে পারে পরিত্যাক্ত ইঁদুর-ছুঁচোর বাসাও।
বাংলাদেশে কালোভ্রমর আর ডোরাকাটা ভ্রমর উভয়েরই দুটি করে প্রজাতি আছে যা আমরা সচরাচর দেখে থাকি। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এদের সংখ্যা দিনদিন লোপ পেয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ দূষণ, বসতবাটি নির্মাণের জায়গার অভাব, কীটনাশকের ব্যবহার এর প্রধান কারণ। ভবিষ্যতে অনাহূত বিটি-বেগুনের মতো বায়ো-ইন্সেক্টিসাইড সন্নিবেশিত ফুলের বিষাক্ত পরাগও ভ্রমরের বেঁচে থাকার জন্যে হুমকি স্বরূপ দেখা দিতে পারে।
এদের রক্ষা করার চিন্তায় আমেরিকার একজন শিল্পী ও প্রকৃতিবিদ সারাহ বার্গম্যান কাজ শুরু করেছেন ২০০৮ সাল থেকে। তৈরি হয়েছে ১২ ফুট চওড়া আর এক মাইল লম্বা একটি “পলিনেটর পাথওয়ে”, যেখানে ঘাসের পরিবর্তে প্রাধান্য পেয়েছে মৌমাছি ও ভ্রমরের উপযোগী পরাগ ও মধুসমৃদ্ধ গাছ। এদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার ওপরে নির্ভর করে এতদঞ্চলের এক তৃতীয়াংশ খাদ্য সরবরাহ। এই দীর্ঘ করিডোর বাগানের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী এবং স্বেচ্ছাসেবকরা অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন, কাজ করছেন বেশ কিছু পতঙ্গবিদ। সিয়েটল্ এবং ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যাল্যের ক্লাসরুমের সঙ্গেও এই বাগানকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
আমাদের দেশে টমেটো-বেগুন এবং এই জাতীয় আরো কিছু সবজি সফল পরাগায়নে তথা অধিক ফলনের জন্যে ভ্রমরের প্রয়োজন অপরিহার্য। এর জন্যে দুটি বা চারটি বড় ক্ষেতের মাঝখানে নির্মাণ করা যেতে পারে এক ধরনের ভ্রমর-কুঞ্জ, যাতে ভ্রমরের বাসোপযোগী নরম কাঠের মৃত গাছ, মাটির ঢিপি এবং খাদ্যের জন্য মধু ও পরাগপ্রধান কিছু ক্ষুপ ও লতা জাতীয় গাছ থাকতে পারে। আমাদের খাদ্যের ফলন ও গুণসম্পন্নতার জন্যে ভ্রমর ও মৌমাছির অবদান আমরা অস্বীকার করতে পারি না আর।
বাংলাদেশে যে কয়েকরকম ভ্রমর দেখা যায় যাদের সংখ্যা সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলেই বেশি।
কালো ভ্রমর – (Carpenter bee) Xylocopa violacea, Xylocopa latipes
ডোরাকাটা ভ্রমর – (Bumblebee) Bombus eximius, Bombus montivagus