পরিবেশের উপর যুদ্ধ ও সশস্ত্র সংঘাতের প্রভাব প্রতিরোধ দিবস
তৌকির ইসলাম
প্রাণিবিদ্যা বিভাগ,
ঢাকা কলেজ।
আজ ৬ই নভেম্বর, ‘পরিবেশের উপর যুদ্ধ ও সশস্ত্র সংঘাতের প্রভাব প্রতিরোধ দিবস’। ২০০১ সালের ৫ ই নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আজকের দিনটিকে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালন করার ঘোষণা দেয়া হয়(নভেম্বরের ৬ তারিখ)।
যুদ্ধের সাফল্য আসে অজস্র রক্তপাত, সংঘাত আর সৈনিক আহত এবং নিহত হওয়ার মাধ্যমে। কিন্তু এর সাথেই অনেক শহর এবং আবাসভূমি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। অনেক দেশে বিভিন্ন রোগ মহামারী আকারে দেখা দেয়। বাতাসে ভেসে বেড়ায় বারুদের গন্ধ, যত্রতত্র পড়ে থাকে নিরীহ মানুষ আর যোদ্ধাদের মৃতদেহ! অনেক ধরনের মিসাইল, রাইফেল, গ্রেনেড আর অত্যাধুনিক অস্ত্রের ব্যবহারে গোটা পরিবেশটাই মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। ইতিহাসে এমন নজিরও আছে যে, যুদ্ধে ব্যবহার করা পারমাণবিক বোমার ক্ষতিকর বিকিরণের ফলে চোখ, ত্বক আর ফুসফুসের ক্যান্সার নিয়ে বংশধররা বেঁচে আছে। যুদ্ধে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া এসব এলাকায় বিকলাঙ্গতাও খুবই পরিচিত । জাতিসংঘ প্রথম এর পরিবেশগত বিষয়গুলো বিবেচনায় আনে। তারা দেখিয়েছেন যে যুদ্ধের ফলে দূষিত হয়েছে পানি সরবরাহ, সামরিক সুবিধার নামে ফসল পুড়িয়ে বা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে, গাছপালা কেটে বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে, ফলে মাটি হয়েছে বিষাক্ত যার ফলশ্রুতিতে ব্যাপকহারে মারা গেছে পশু পাখি।
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP) আবিষ্কৃত একটি তথ্যে জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৪০% আভ্যন্তরীণ সংঘাত ছিল প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এগুলো পানি এবং উর্বর জমির থেকেও অপ্রতুল প্রাকৃতিক সম্পদ। এগুলয় হলঃ কাঠ, সোনা, হীরা এবং তেল। এখানেই শেষ নয়, এরূপ প্রাকৃতিক সম্পদ জড়িত দ্বন্দ্ব ভবিষ্যতেও ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।
জাতিসংঘ তাই এই বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আজ থেকে প্রায় ১৩ বছর পূর্বে, ২০০১ সালেই। পরিবেশের উপর বিধ্বংসী কাজগুলোর প্রতিরোধ নিশ্চিত করে একটি স্থায়ী শান্তির পথ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা থেকেই এ দিবসের উত্থান। যদি কোন অঞ্চলে বাস্তুতন্ত্র টিকে থাকে তাহলে সেখানে সামান্য হলেও টেকসই শান্তির আশা আছে।
রাজনীতিবিদরা যুদ্ধে যান খুব দ্রুত ন্যায্যতা পাওয়ার জন্য, কিন্তু মূল বিষয় হল ন্যায়-অন্যায় যাই হোক যুদ্ধ বরাবরই যোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষের জন্য বিপর্যয়ই বয়ে আনে। যুদ্ধ কয়েক মিনিটের মধ্যে কয়েক প্রজন্মের সভ্যতা ধ্বংস করে দিতে পারে এবং এটি সর্বদাই পরিবেশকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়।
উদাহরণস্বরূপ, ভিয়েতনামের যুদ্ধের কথা বলা যাক, ভিয়াতনামী সৈনিকরা তাদের চারপাশ ঘিরে থাকা বনের মধ্যে চলাফেরায় অনেক দক্ষ ছিল। তাই তাদের পক্ষে মার্কিন বাহিনীর সাথে গেরিলা যুদ্ধ করাটা ছিল খুবই সুবিধাজনক এবং এতে কোন ধরা পড়ারও সম্ভাবনাও ছিল না। অন্যদিকে,মার্কিন সামরিক বাহিনী বনের প্রায় ১৫০ ফুট উপর থেকে দুইটি উদ্ভিদনাশকের মিশ্রণ স্প্রে করে যা ‘এজেন্ট অরেঞ্জ’ নামে পরিচিত। এর প্রভাবে পুরো বন ধ্বংস হয়ে যায়, যা ভিয়েতনামের সৈন্যদের রক্ষা করছিল। এর সাথে ধ্বংস হয় ফসলের মাঠ এমনকি এর সংস্পর্শে আসা মানুষের জন্যও ক্ষতিকর ছিল। ১৯৭১ থেকে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু ততদিনে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে।
অনুমান করা হয় ভিয়েতনামের যুদ্ধে ৪.৯ মিলিয়ন হেক্টর বা ১৯,০০০ বর্গ মাইল বনভূমি ধ্বংস করা হয়, যা স্কটল্যান্ড এর সম্পূর্ণ আয়তনের দুই-তৃতীয়াংশ বলে ধারণা করা হয়।আরও বলা হয় এই ১৯ বছর ৫ মাসের যুদ্ধে ১৬ মিলিয়ন টন যুদ্ধ সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়, যা ৩০ মিলিয়নের বেশি খাদ সৃষ্টি করে। এই খাদ গুলো মাটির উপরের স্তর সরিয়ে ফেলে যার ফলে নিষ্কাশন ব্যবস্থা বিকল হয়ে যায় এবং বদ্ধ পানিতে বিভিন্ন রোগবাহিত ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে থাকে। বন্যপ্রাণীদের অতুলনীয় ক্ষতি হয়। শত্রুকে লক্ষ করে যে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হত তাতে শত্রু ছাড়াও হাজার হাজার নিরীহ বন্যপ্রাণী মারা যায়।
যদি মানবিক বিবেচনা থেকে দূরেও থাকা যায় তবুও এটি ছিল একটি পরিবেশগত বিপর্যয়। প্রাণি ও উদ্ভিদের অনেক প্রজাতি ব্যাপক হারে হ্রাস পায়, অনেক ক্ষেত্রে কিছু কিছু প্রজাতি বিলুপ্তও হয়।
দিবসটি প্রতিষ্ঠিত হয় সামরিক উদ্দেশ্য অনুগমনের নামে বাস্তুতন্ত্রের যে ক্ষতি করা হয়, যুদ্ধের ফলে পরিবেশের কি পরিণতি হয় তা তুলে ধরার জন্য এবং তা অনুধাবন করার জন্য।সারা বিশ্বের কর্মকর্তা, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ীসহ অনেক মানুষ জাতিসংঘের এই আন্তর্জাতিক দিবসটি পালন করে। তাঁরা বিভিন্ন সেমিনারে অংশ নেন এবং যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয় সম্পর্কে আলোচনা করে। এর ফলে ঘটিত ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনার উপায় সম্পর্কেও আলোচনা করে। বিভিন্ন কলাম, বক্তব্য, সেমিনার, লেকচার, বেতার বার্তার মাধ্যমে এর যুদ্ধ ও সংঘাতের ফলে পরিবেশে সৃষ্ট কুফল গুলো সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা হয়।
এই দিবসটি পালিত হয় মূলত নতুন প্রজন্মকে একটি শান্তিপূর্ণ ও দূষণ মুক্ত পরিবেশ উপহার দেয়ার জন্য। তাই আমাদের নতুন প্রজন্মের দায়িত্ব আমাদের পরিবেশকে দূষণমুক্ত এবং যুদ্ধ ও সংঘাতের ফলে সৃষ্ট পরিবেশগত বিপর্যয়গুলো থেকে রক্ষা করা। একই সাথে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
চমৎকার একটি লেখা , অনেক কিছু জানা গেল এজন্য লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ। জলবায়ু সংক্রান্ত সম্মেলনে আজ পর্যন্ত ইউএসএ বা তার সহযোগী রাষ্ট্রগুলো কার্বন নিঃসরণ থেকে শুরু করে বৈশ্বিক উষ্নতা বৃদ্ধির বিষয়টি কখনই গণনার মধ্যে নেয়নি বরং একে সরাসরি অস্বীকার করে এসেছে। ফলে এখনও পর্যন্ত ২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা হ্রাসের বিষয়ে একমত হতে পারেনি উন্নত বিশ্ব মূলত যারা হচ্ছে এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির মূল হোতা । তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে আমেরিকা জলবায়ু জনিত এই সব সম্মেলনে ভিন্নমত পোষন করলেও তার প্রতিরক্ষা বিভাগ এই বিষয়টিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে বর্তমানে কাজ করে চলেছে। যেখানে জলবায়ু জনিত কারনে আমেরিকার সমুদ্র উপকূলীয় সব ঘাঁটিসমূহ স্থানান্তরের জন্য বিশাল বাজেটের এক কর্মপরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছে। এন্টার্টিকা মহাদেশের বিশাল আইসবার্গ গুলো বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত কারনে গলে যাওয়ায় এই অন্চলে চীন, রাশিয়ার মত দেশের তেল এবং গ্যাস আহরণের বিষয়টি প্রাধান্য পেতে পারে বলে এই অন্চলে আমেরিকার নেভাল বেস স্থাপনের কাজ চলছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের যুদ্ধউপকরণ, রনকৌশলের ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। অর্থাৎ যুদ্ধজনিত কারনে পরিবেশের ক্ষতিকর প্রভাব যতই বৃদ্ধি পাক না কেন তাতে এই যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রের কোন কিছুই যায় আসেনা। তারা চলছে তাদের নিজস্ব গতিতে এবং বেপড়োয়া ভাবে ।