সময় নেই; চলুন না ডাইনোসরের পথ থেকে বাঘকে ফিরিয়ে আনি !
শাওন চৌধুরী
বাঘ দিবস! এটা আবার কী ! আমাদের জীবনে বাঘের আবার কী দরকার! বাঘই তো লোকালয়ে এসে মানুষ মেরে যায় আবার আমরাই তাদের নিয়ে এতো কিছু করে যাচ্ছি! এরকম হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিতেই ২০১০ সালে সেইন্ট পিটার্সবার্গে আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেই থেকে প্রতিবছর জুলাই মাসের ২৯ তারিখ সমগ্র বিশ্ববাসী বাঘ দিবস হিসাবে পালন করে আসছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাঘ দিবস কী! এটাকে দিবস বলার পেছনের কারণ কী! যখন কোন প্রাণীর সংখ্যা শংকাজনক হারে কমতে থাকে এবং এদেরকে রক্ষার জন্য কিছু অতিরিক্ত পদক্ষেপের প্রয়োজন পড়ে তখনই বিশেষজ্ঞরা এরকম একটা দিবসের অবতারণা করেন। এরকম দিবসের অবতারণা করা হয়ে থাকে আনন্দ করার জন্য নয় বরঞ্চ, আমাদের জীবনে ঐ প্রাণীর কী উপকারিতা আছে, এর সংরক্ষণ এবং পরিবেশ রক্ষায় ঐ প্রাণীটি কিভাবে সাহায্য করছে, ইত্যাদি নানান বিষয় সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করাই এই দিনের প্রধান লক্ষ্য।
বাঘ হচ্ছে একটা বনের সবথেকে উঁচু পর্যায়ের শিকারি প্রাণী, এই কথা আমাদের প্রায় সবারই জানা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শিকারি প্রাণী হবার কারণে এরা প্রতিনিয়ত অনেক প্রাণী শিকার করে থাকে, এদের আবার রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা কেন! মজার বিষয় হচ্ছে, প্রকৃতি আমাদের মতন ক্ষুদ্র বিষয় চিন্তা করেনা বরং কখন যে ঙ্কী হবে সেটা আমাদের ভাবনার অতীত। যদি, অন্যান্য প্রাণী রক্ষার জন্য বাঘ বিলুপ্ত করে দেয়া হয় তাহলে এমন এক শিকারি প্রাণী তখন ঐ স্থান দখল করে নিবে যাতে ক্ষতি আরও অনেক বেশি হবে। এজন্য বাস্তুতন্ত্রের প্রতিটি উপাদানেরই সমানভাবে গুরুত্ব রয়েছে।
বাঘ গবেষকদের মতে, ১৯১৩ সালে বাঘের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০০০০০, ২০১৩ সালে ৩২৭৪ এবং ২০১৪ সালে সেই সংখ্যা ৩০০০ এ এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ এক শতাব্দীতে বাঘের সংখ্যা শতকরা ৯৭ ভাগ কমে গেছে। গবেষকদের মতে এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৫ বছরের মধ্যেই পৃথিবী বাঘ-শূন্য হয়ে পড়বে। তখন যে কী অবস্থা হবে সেটা আমাদের চিন্তার বাইরে। প্রকৃতি থেকে যেকোনো একটি উপাদান বা অংশ যদি মুছে যায়, সেই ক্ষতির সামাল দিতে কয়েক’শ বা কয়েক হাজার বছর পার হয়ে যায়, অনেক সময় সম্ভবও হয়না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এরকম মারাত্মক হারে বাঘ কমার কারণ কী? নানাবিধ কারণ আছে যার কারণে আমাদের সবার চোখের সামনেই এক এক করে সব বাঘ হারিয়ে যাচ্ছে। এসব কারণের মধ্যে প্রধান তিনটি কারণ হচ্ছে, বাসস্থান ধ্বংস, বাঘ ও মানুষের সংঘর্ষ এবং জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন।
গবেষকদের মতে, শেষ কয়েক বছরে বাঘের বাসস্থানের শতকরা ৯৩ ভাগই ধ্বংস হয়ে গেছে যার কারণে এদেরকে খুবই অল্প এলাকা জুড়ে থাকতে হচ্ছে এবং এদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সাংঘাতিক ভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। প্রতিটি প্রাণী বা উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিবেশের প্রয়োজন পড়ে যার ভারসাম্য বজায় না থাকলে সেই উদ্ভিদ বা প্রাণীটি ঐ স্থানে আর টিকে থাকতে পারেনা, সময়ের অন্তরালে হারিয়ে যায়।
প্রতিটি বাঘের একটা নির্দিষ্ট সীমানা থাকে যা সে নানান পদ্ধতিতে নির্ধারণ করে থাকে। এই সীমানার দেয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, এখানে যেন অন্য কেও প্রবেশ না করে। সীমানা রক্ষার্থে অনেক সময় নিজেদের মধ্যেও অনেক ধরণের সংঘর্ষ হয়ে থাকে। এখন মানুষ বা অন্য প্রাণী যখনই ঐ সীমানার মধ্যে প্রবেশ করে তখনই সে আর সহ্য করতে পারেনা। যার কারণে বনের কাঠ কাটতে কিংবা গোলপাতা সংগ্রহের জন্য কিংবা মধু সংগ্রহের জন্য যখনই কোন মানুষ বনের ভেতরে ঢুকে ঐ সীমানাতে প্রবেশ করে তখনই আক্রমণের শিকার হয়ে থাকে।
আমরা আমাদের বাসস্থান কিংবা খাবারের জন্য প্রতিনিয়তই নির্বিচারে গাছ কাটছি। আগে যেখানে সুন্দরবনে গাছের কারণে বেশি ভেতরে যাওয়াই সম্ভব হতোনা এখন সেখানে জাহাজও সহজেই প্রবেশ করে। এরকম চলতে থাকার কারণে খুব সীমিত স্থানের মধ্যে থাকা ছাড়া এদের আর কোন সুযোগ নেই। সীমিত স্থানে থাকার কারণে খাবারের সংখ্যাও সীমিত থাকে একারণে একটা সময়ে স্বভাবতই খাবার শেষ হয়ে যায় এবং খাবার খোঁজার জন্য বাঘ লোকালয়ে প্রবেশ করে। আর সেই সুযোগে শিকারিরা ঐ বাঘকে শিকার করে ফেলে কিংবা গ্রামবাসীরা পিটিয়ে বাঘকে মেরে ফেলে। এরকম ঘটনা খুলনা কিংবা সাতক্ষীরা অঞ্চলে আগে প্রতিনিয়তই ঘটতো কিন্তু এখন বাঘের সংখ্যা এতোটাই কমে গেছে যে, বছরে দু’একবার এদেরকে লোকালয়ে দেখা যায়।
বিগত কয়েক বছর ধরে পৃথিবীতে জলবায়ুর পরিবর্তন অনেক দ্রুত ঘটছে যে কারণে সমগ্র পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাতের পরিমাণেরও পরিবর্তন ঘটছে। এসবের জন্য যারা মানিয়ে নিতে পারছেনা, তারাই হারিয়ে যাচ্ছে। যেকারণে ক্রমাগত সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ছে এবং এদের বাসস্থানও ধ্বংস হচ্ছে, খাবার জন্য মিঠাপানির সংকট দেখা দিচ্ছে, সাথে সাথে এদের সংখ্যাও কমছে।
বাংলাদেশ বাঘ সংরক্ষণকারী গবেষকদের মতে সুন্দরবনে প্রাপ্ত বাঘের সংখ্যা ৮৩ থেকে ১৩০ এর মধ্যে, যেটা গড় করলে দাঁড়ায় ১০৬! যেখানে শেষবার অর্থাৎ ২০০৪ সালে সুন্দরবনের বাঘের জরিপে বাঘ পাওয়া গিয়েছিল ৪৪০টি। বর্তমানে সুন্দরবনের ভারতের অংশে প্রাপ্ত বাঘের সংখ্যা ৭৪টি। অর্থাৎ, এখন সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা সর্বসাকুল্যে ১৮০! যেখানে এই ম্যানগ্রোভ বনে পৃথিবীর সবথেকে বেশি বাঘের উপস্থিতি রেকর্ড করা হয়েছিল সেখানে পৃথিবীর অন্যান্য অংশে বাঘের যে কী অবস্থা, সেটি সহজেই অনুমান করা যায়।
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বাঘ গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ড. মনিরুল খানের মতে, “সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা সম্পর্কে যা আশংকা করা হয়েছিল সেটি তা থেকেও অনেক বেশি কমে গেছে এবং সর্বসাকুল্যে তা ২০০ এর বেশি হবে না। বাসস্থান ধ্বংস ও বাঘ শিকারের কারণেই মূলত এই অবস্থা এবং এটি প্রতিরোধ করতে সরকারের আরও জোরালো পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।”
ভারতীয় বন্যপ্রাণী সংস্থার প্রফেসর ইয়াদভেন্দ্রাদেভ ভি ঝালা’র মতে, “নতুন গবেষণাতে যে তথ্য এসেছে সেটাই হচ্ছে বাস্তবতা। সুন্দরবনে যে পরিমাণ বাসস্থান ও খাবার রয়েছে তা ২০০ বাঘের জন্য যথেষ্ট কিন্তু সেখানে ৪৪০ বাঘ প্রাপ্তি অনেকটাই রূপকথার মতন!”
বাঘের সংখ্যা এরকম আশংকাজনক হারে কমে যাওয়ার জন্য অনেক কারণই রয়েছে, দ্রুত যদি এর সমাধান না করা যায় তাহলে হয়তো আমরা আমাদের অনেকদিনের ঐতিহ্য রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে অচিরেই হারিয়ে ফেলবো!