আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস: ফিরবে কি আবার ধূসর সুন্দর?
মনজুর কাদের চৌধুরী
শুরু করি পার্সি জাতির গল্প দিয়ে।তারা মনে করে মাটি,পানি ও আগুন পবিত্র।তাই মৃত দেহ সৎকার করে অপবিত্র করতে চায় না।তারা আত্মাকে স্বর্গে পাঠাতে চায়। নির্মাণ করল টাওয়ার।“TOWER OF SILENCE” ।। কেউ মারা গেলে মৃতদেহ রাখা হয় এই উচ্চ টাওয়ারে। শকুন তা খায়।তারা বিশ্বাস করে শকুন আকাশের মাঝে দূত হিসেবে কাজ করে।
আমাদের দেশে গত শতকের সত্তর এর দশক থেকে এ পর্যন্ত শকুনের সংখ্যা হ্রাসের পরিমাণ ৯৮ শতাংশ বলে জানিয়েছে বন অধিদপ্তর। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার (আইইউসিএন) এর ক্রিটিক্যালি এন্ডেনজার্ড এর তালিকায় রয়েছে শকুনের সব ক’টি প্রজাতি। আর এ জন্যই প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার পাশাপাশি দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন রোগ। আর এর মধ্যে অন্যতম অ্যানথ্রাক্স। এছাড়াও রয়েছে গবাদিপশুর যক্ষা, খুরা রোগ।
বাংলাদেশে শকুনের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশে মোট ৬ প্রজাতির দেখা পাওয়া যেত। শকুন, রাজ শকুন, সাদা গিদরী বা গিন্নী শকুন, লম্বা ঠোঁট শকুন আমাদের দেশীয় প্রজাতি। আর ভ্রমণকারী হিসেবে কালো শকুন আর গ্রিফন শকুন ছিল। রাজ শকুন শেষবারের মত দেখা গেছে ৮০’র দশকে। এখনও হয়ত কোথাও টিকে রয়েছে। তবে লোকচক্ষুর অন্তরালে। লম্বা ঠোঁট শকুন ১৯৯২ সালে ভৈরবে পক্ষিবিদ পল থমসন শেষবারের মতন দেখেন। গিন্নী শকুনের শেষ দেখাও ১৯৮৪ সালে পল থমসনের চোখে। কালো শকুন ১৯৮৭ সালের নভেম্বরে ধরা পড়ে চাঁদপুরে। গ্রিফন শকুন ১৮ নভেম্বর ১৯৯২ সালে শেষবারের মত দেখা যায় ভৈরবে।বাংলা শকুন টিকে রয়েছে কোন রকমে। অথচ সত্তর দশকে রাজ শকুন আর বাংলা শকুনে ছেয়ে ছিল ঢাকা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ চিত্রগুলোতে দেখা যায় দল বেধে মৃতদেহের উপর বসে আছে তারা। সত্তরের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির বুদ্ধ নারিকেল গাছের সারিতে আর পলাশী ব্যারাকের কাছের উঁচু গাছগুলোতে দেখা যেত বাংলা শকুনের। এখন বাংলা শকুন ছাড়া আর কোন শকুন কারো চোখে পড়ে না।এর বৈজ্ঞানিক নাম জেপস বেঙ্গালেনসিস (Gyps bengalensis)। এদেশে বেশী দেখা যেত বলেই তাদের নামের শেষে বাংলা শব্দটি চলে এসেছে। এখন গোটা পৃথিবীতেই এর অবস্থা খুবই ভয়াবহ। সংখ্যায় দশ হাজারের বেশী হবেনা। বাংলাদেশে বাংলা শকুন এখন বিরল প্রজাতি। সব মিলে এদেশেও এদের সংখ্যা ৫০০ এর বেশী হবে না। তাও আবার বেশীরভাগই দেখা যায় সুন্দরবন এলাকায়। এছাড়া বেশ বড় কয়েকটি দল এখন রয়েছে শ্রীমঙ্গলের কালাছড়া ও হবিগঞ্জের রেমা কালেঙ্গা এলাকায় ।আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এদেশও শকুন শূন্য হয়ে পড়বে। গোটা বাংলাদেশ জুড়ে মোট শকুনের সংখ্যা ২০০০টিও নয় বলে জানিয়েছেন বন অধিদপ্তরের ।
দেশি বা বাংলা শকুন (White-rumped vulture) :
দেশি বা বাংলা শকুন (White-rumped vulture) নামে পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম Gyps bengalensis। লম্বায় ৯০ সেমি ও ওজনে ৪ দশমিক ৩ কেজি। পালক ময়লা কালচে বাদামি। গলা লম্বা। লোমহীন মাথা ও গলা গাঢ় ধূসর। ঘাড় ও পিঠের সংযোগস্থলের ময়লা সাদা পালকগুলো দেখতে মাফলারের মতো। পশ্চাদ্দেশের পালক সাদা। ডানা, পিঠ ও লেজ কালচে বাদামি। পা কালো। স্ত্রী-পুরুষ একই রকম। বাচ্চার গাঢ় বাদামি, দেহ ও ডানার ওপরের অংশে চিকন সাদা দাগ থাকে।শকুনের দৃষ্টি অসাধারণ তীক্ষ, কিন্তু ঘ্রাণশক্তি নেই। সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ প্রজননকাল। বাসার আকার বেশ বড়। একই বাসা ঠিকঠাক করে বছরের পর বছর ব্যবহার করে। স্ত্রী শকুন সাদা রঙের একটি মাত্র ডিম পাড়ে। ডিম ফোটে ৪০-৪৫ দিনে।বর্তমানে এরা মহাবিপন্ন (Critically endangered) পাখি। ফলে দিন দিন তাদের খাবার একেবারেই কমে এসেছে এবং এরই ফলে হারিয়ে গেছে প্রায় ৯৯.৫ শতাংশ বাংলা শকুন।
শকুন বিলুপ্তির কারণ
১। শকুনের বিলুপ্তির অন্যতম প্রধান কারণ গবাদিপশুর জন্য ব্যবহৃত ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেনের ব্যবহার। এ দু’টো ওষুধের প্রভাব মৃত গবাদিপশুর দেহেও থাকে। এ ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছে এমন কোন মৃতদেহ শকুনের খাদ্য তালিকায় চলে এলে শকুনের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কেননা এর পার্শপ্রতিক্রিয়ায় শকুনের কিডনিতে পানি জমে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু ঘটে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন মাত্র ০.২২ মিলিগ্রাম ডাইক্লোফেনাক যথেষ্ট একটি শকুনের মৃত্যুর জন্য।ডাইক্লোফেনাক ৮০’র দশকের শেষদিকে বেশ সস্তায় ভারতীয় উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। মাত্র ২০ টাকায় পাওয়া যায় বলে এই ওষুধের ব্যবহার বেড়ে যায়। গবাদিপশুর যে কোন রোগেই এ ওষুধ ব্যবহার করতে থাকে সাধারণ মানুষ। অথচ পরে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের একটি গবেষণায় দেখা যায় মাত্র গবাদিপশুর চিকিৎসায় মাত্র ০.৪ শতাংশ ক্ষেত্রে ডাইক্লোফেনাকের মত কড়া ওষুধ প্রয়োজন।
২। এটাকে মূল অনুঘটক হিসেবে চিিহ্ণত করা হলেও পাশাপাশি আরো কিছু ব্যাপারকে উল্লেখ করেছে আইইউসিএন-এর সহযোগী সংগঠন বার্ডসলিস্ট অর্গানাইজেশন। তারা কীটনাশক ও সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পানির দূষণ, খাদ্য সঙ্কট, কবিরাজি ওষুধ তৈরিতে শকুনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহার, বিমান-ট্রেনের সাথে সংঘর্ষ, ঘুড়ির সূতার সাথে জড়িয়ে পড়া, ইউরিক এসিডের প্রভাবে বিভিন্ন রোগ, বাসস্থানের অভাব প্রভৃতি। শকুনের বাসা বাঁধার স্থানের অভাবের জন্য তাদের বংশবৃদ্ধির হার আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। পাখি বিজ্ঞানীদের মতে এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী পাঁচ বছরেই হারিয়ে যাবে শকুন।
৩। কীটনাশক-সারের ব্যবহার, ডাইক্লোফেনাকের পাশাপাশি আরো বড় একটি কারণ হল বাসস্থানের অভাব। শিমুল, ছাতিম, দেবদারুর মত বড় গাছগুলো এখন আর চোখে পড়ে না সেভাবে। এ গাছগুলো নির্বিচারে ব্যবহার হয়েছে চায়ের পেটি, প্যাকিং বাক্স আর দেয়াশলাইয়ের কারখানায়। ইটের ভাটা, তামাক শুকানো আর পিচ গলিয়ে রাস্তা বানানোর জন্য গায়েব হয়ে গিয়েছে রাস্তার পাশের বট, শেওড়া আর গাবের গাছ। সংরক্ষিত বনের ভেতরেও চলে নির্বিচারে বড় গাছগুলোর নিধন। শকুনগুলো বাসা বাঁধবে কোথায়?’
কেন সংরক্ষণ প্রয়োজন :
শকুন শবালী পশুপাখির মধ্যে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার অন্যতম সদস্য। প্রকৃতির ঝাড়–দার বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না। শকুন মরা গবাদিপশু খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি রোগ জীবাণুর বি¯তৃতি রোধেও সহায়তা করে। প্রশ্ন উঠতে পারে কুকুর, শেয়াল বা বেড়াল গোত্রের প্রাণীরাও মড়াখেকো। তবে কেন শকুন সংরক্ষণ প্রয়োজন। অ্যানথ্রাক্স ব্যকটেরিয়া, খুরা রোগ, গবাদি পশুর যক্ষা, হগ কলেরার জীবাণু খুব সহজেই হজম করতে পারে শকুন। যেটা কুকুর, শেয়াল বা বেড়াল গোত্রের প্রাণীরা হজম করতে পারে না, বরং ছড়িয়ে বেড়ায়।শকুনের এই ক্রমহ্রাসমান অবস্থার জন্য বিভিন্ন রোগ জীবানু সহজেই ছড়িয়ে পড়বে। এখনকার মানবদেহে অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণের ঘটনা তার প্রমাণ দিচ্ছে।
শকুন সংরক্ষণে উদ্যোগ :
দেরিতে হলেও টনক নড়েছে সরকারের। ভারত, পাকিস্তান, নেপালে বহু আগেই শকুন সংরক্ষণে উদ্যোগ নিয়েছে। নিষিদ্ধ করেছে ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেন, ব্যবহার করতে শুরু করেছে মেলোক্সিক্যান। সেখানে গবাদিপশুর জন্য ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেনের উৎপাদনই পুরোপুরি নিষিদ্ধ। গত ৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ব শকুন-সচেতনতা দিবসে বাংলাদেশে ওষুধটি নিষিদ্ধ করার আবেদন জানানো হয় এবং বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পেরে মন্ত্রিপরিষদ ডাইক্লোফেন আমদানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
একই সাথে জনসচেতনতা বাড়াতেও উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের বন বিভাগ, বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী ট্রাস্ট ও বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাব। যে সমস্ত স্থানে এখনো শকুন টিকে রয়েছে, সে সমস্ত স্থানের মানুষজনকে সচেতন করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এছাড়া মৃত প্রাণীকে সাথে সাথে সৎকার না করে শকুনের জন্য ফেলে রাখার জন্যও উৎসাহিত করা হবে। যেমনটি করা হয়েছে স্পেনে।
এ ব্যাপারে বন অধিদপ্তর জানিয়েছে গাজীপুরে প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে তৈরি করা হচ্ছে ভালচার ব্রিডিং সেন্টার। এখানে বাংলা শকুনসহ অন্যান্য প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির শকুনের বংশবৃদ্ধির জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে। অসুস্থ শকুনকে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা ও শকুনদেহের থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন জীবাণুর নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থাও থাকছে। একই সাথে দেশের শকুন অধ্যুষিত এলাকার বড় গাছগুলোকেও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।
IUCN Bangladesh প্রথমবারের মতো চুনারুঘাটের রেমাখালেঙ্গা বনে স্থাপন করেছে শকুনের খাবার স্টেশন।কোন গৃহপালিত প্রানী মারা গেলে ডাইক্লোফেনাক,কিটোপ্রোফেন টেস্ট করে যদি ভালো হয় তবে দেওয়া হবে খাবার স্টেশনে।বিশেষ করে ব্রিডিং সময়ে খাবার অবশ্যই দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন আইইউসিএন এর প্রজেক্ট ম্যানেজার সীমান্ত দিপু।
গত বছরের ন্যায় এবার সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠন প্রাধিকার আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস উপলক্ষ্যে চুনারুঘাটের একডালা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৫ই সেপ্টেম্বর IUCN এর সহযোগিতায় সেমিনার ও কুইজ প্রতিযোগিতা করবে। ৬ই সেপ্টেম্বর সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যালী হবে। বাংলাদেশ বন অধিদপ্তর , IUCN ,বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব সহ অন্যান্য পরিবেশবাদী সংগঠন দিবসটি উৎযাপন করবে।
লেখকঃ পাবলিক রিলেশন সেক্রেটারি , প্রাধিকার।