জাদুর বাক্স : পরিবেশবান্ধব চাষাবাদে নতুন মাত্রা
তরিকুল ইসলাম রাহাত
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মিটাতে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে – এই সহজ সত্যটি আমাদের মেনে নিতে হয়েছে অনেক আগেই । কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে খাদ্য উৎপাদন বা সবজি চাষে বড় একটি প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দেয় ফসলের জন্য ক্ষতিকর পোঁকা বা পতঙ্গ । ফসলের ক্ষতি করতে করতে এরা উৎপাদন কমিয়ে দেয় বহুগুণ । সুতরাং উৎপাদন বাড়াতে হলে ক্ষতিকর পোঁকা, কীট বা পতঙ্গের হাত থেকে ফসলকে রক্ষা করতে হবে । আর এই চিন্তা থেকেই উদ্ভাবিত হয়েছে রাসায়নিক কীটনাশক, যা ক্ষতিকর পোঁকা থেকে ফসলকে রক্ষা করছে এবং খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণ ।
কীটনাশকের সহায়তায় ফসল উৎপাদনে যেমন এসেছে বিপ্লব, সেই সাথে পূরণ হয়েছে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার অনুপাতে খাদ্য চাহিদাও । কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য কতটা নিরাপদ এই কীটনাশক? কি হতে পারে এই কীটনাশকযুক্ত খাবার খেলে ? পরিবেশের উপর এদের প্রভাব কতটুকু? কীটনাশক প্রয়োগে পরিবেশ কতটুকু ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বা এই ক্ষতির প্রভাব কতটুকু?
অনেকেই আমরা ভাবি না এই বিষয়গুলো নিয়ে । কিন্তু কেউ কেউ ঠিকই ভাবেন । পরিবেশ, প্রাণিবৈচিত্র্য এবং মানবস্বাস্থ্যের উপর কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে ভাবেন তাঁরা । আর ভাবতে ভাবতেই রাসায়নিক কীটনাশক ছাড়া সবজি উৎপাদনের নতুন একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলেন। তারপর পদ্ধতিটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হাত ধরে ছড়িয়ে যায় কৃষকদের মাঝে । এই পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনে সফলতার গল্প ছড়িয়ে পড়লে খুব দ্রুত জনপ্রিয় হতে থাকে এটি । সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ বা ট্র্যাপ ও জৈব বালাইনাশক ব্যবহারে উৎপাদিত বিষমুক্ত এই সবজি এখন বাংলাদেশের গন্ডি পার হয়ে রপ্তানি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে ।
চলুন ঘুরে আসি বিষমুক্ত সবজির সবচেয়ে বড় খামার থেকে । ঢাকা থেকে ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে ধরে নরসিংদী জেলায় যাবো আমরা । নরসিংদী সদর উপজেলা পার হয়ে কিছুদূর সামনে গেলেই ইটাখোলা নামক জায়গাটি চোখে পড়বে আপনার । ইটাখোলা থেকে আরেকটু সামনে এগুতেই রাস্তার দু’পাশে বিস্তৃত সবজির ক্ষেত । সবজিবাগানের মাঝে মাঝেই আপনার চোখে পড়বে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সবুজ-হলুদ বা নীল-সাদা সাইনবোর্ড, যেগুলো ঘোষণা করছে রাসায়নিক কীটনাশকবিহীন সবজি উৎপাদনের কথা । নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলায় এই জমিটির মত আরো অসংখ্য জমিতে ছড়িয়ে পড়েছে এই ফেরোমেন ট্র্যাপ ও জৈব বালাইনাশকের সহায়তায় তৈরি সবজি বাগান । চলতি মৌসুমে উপজেলার ব্রাহ্মন্দী, ঘাসিরদিয়া, ভিটিপাড়া, খড়িয়াসহ বিভিন্ন স্থানে মোট ২০০ হেক্টর বা ১৪০০ বিঘা জমিতে চাষ হয়েছে এই বিষমুক্ত সবজির ।
কি এই সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ ?
স্ত্রী পোঁকার সেক্স হরমোন রাসায়নিক দ্রব্যের সাহায্যে একটি প্লাস্টিকের বক্স বা কৌটায় রাখা হয় । আর তার নিচেই রাখা থাকে সাবানের ফেনা মিশ্রিত পানি । ফাঁদ তৈরীর জন্য প্লাস্টিকের কৌটাটি একটি বাঁশের খুঁটিতে বেঁধে সবজি ক্ষেতে স্থাপন করা হয় ।
কিভাবে কাজ করে এই ফাঁদ ?
স্ত্রী পোঁকার সেক্স হরমোনে আকৃষ্ট হয়ে পুরুষ পোঁকা ফাঁদের কাছে আসে এবং সাবান –পানিতে পড়ে মারা যায় । ফলে বন্ধ হয়ে যায় স্ত্রী পোঁকার ডিমের বংশবিস্তার । আর খুব সহজেই এই পদ্ধতি ব্যবহারে ক্ষতিকর পোঁকা বা পতঙ্গমুক্ত হয় সবজি খামার ।
কৃষকরা এই ফাঁদের ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে এর নাম দিয়েছেন ‘জাদুর বাক্স’ । এই জাদুর বাক্সের সাহায্যে বর্তমানে কুমড়া, লেবু, শসা, বেগুন, কাঁকরল, বাঁধাকপি, ফুলকপি প্রভৃতি সবজি চাষে সাফল্য পাচ্ছেন তাঁরা । দেশের চাহিদা মিটানোর পর এই বিষমুক্ত সবজি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপের ৩২ টি দেশে । এই বছর জানুয়ারী থেকে জুন এবং আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৯০ টন লেবু, ১২ টন বেগুন এবং ১২ টন কাঁকরল রপ্তানী হয়েছে ।
কৃষক এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কৃষি অফিস থেকে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং বিষমুক্ত ঘোষণা করার পর বিদেশিরা সবজি নিয়ে থাকেন । লেবু রপ্তানীর ক্ষেত্রে ক্যাংকার মুক্ত থাকার নিশ্চয়তা পেলেই কেবল লেবু নিতে আগ্রহী হন তারা । আর এতে করে দামও ভালো পান কৃষকেরা । প্রতি কেজি কাঁকরল ৩৫-৪০ টাকা, বেগুন ৫০ টাকা, শসা ৮০ টাকা, করলা ৬০ টাকা, বরবটি ৩০ টাকা, জালি ১৫-৩০ টাকা এবং ৮০ টি (এক পণ বা কিয়া) লেবু ১০০০ টাকা দরে বিদেশিরা সংগ্রহ করে থাকেন ।
কেমন খরচ এই পদ্ধতির চাষাবাদে ?
পোঁকা দমনে সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ পদ্ধতিতে চাষাবাদে খরচও অনেক কম । কীটনাশকের সাহায্যে বালাই দমনে যেখানে প্রতি বিঘাতে খরচ হচ্ছে ৩-৪ হাজার টাকা, সেখানে এই পদ্ধতির চাষাবাদে কৃষককে বিঘাপ্রতি মাত্র ১ হাজার টাকা খরচ করলেই হচ্ছে । আর এই কারণেই ফেরোমেন পদ্ধতি জনপ্রিয় হচ্ছে দ্রুত । কৃষকেরা এই পদ্ধতিকে উল্লেখ করছেন ভাগ্য উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে । একই সাথে অর্থ সাশ্রয়, বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন এবং বহির্বিশ্বে এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত সবজির চাহিদা থাকায় কৃষকরা আগ্রহী হয়ে উঠছেন । এছাড়াও জৈব বালাইনাশক ব্যবহারে মাটির গুণাগুণ বজায় থাকার পাশাপাশি পরিবেশগত ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় বলে কৃষি কর্মকর্তারা এই পদ্ধতিতে চাষাবাদকে উৎসাহিত করছেন ।
কৃষকের অভিমত
উপজেলার বাঘাব ইউনিয়নের খড়ক মাড়া গ্রামের বাশিরউদ্দিন, নাসিরউদ্দিন, সাগর মিয়া ফেরোমেন ট্র্যাপ ও জৈব-বালাইনাশকের সাহায্যে লাউ এবং কুমড়া চাষ করছেন । কুন্দার পাড়া গ্রামের আব্দুল কাইয়ুম ফুলকপি ও বাঁধাকপি এবং ব্রাহ্মন্দী গ্রামের শামিম এ পদ্ধতিতে বরবটি ও বেগুন চাষ করে সাফল্য পেয়েছেন । তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, উপজেলা কৃষি অফিসের সহযোগিতায় এই পদ্ধতিতে চাষাবাদে উৎপাদন খরচের তুলনায় তাদের আয় বেশি হচ্ছে ।
বিশেষজ্ঞ মতামত
উপজেলা উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘রপ্তানিযোগ্য লেবু ও সবজি উত্পাদন বিশেষ কর্মসূচির আওতায় উপজেলার ব্রাহ্মন্দী, ভিটিপাড়া, খড়িয়া, ঘাসিরদিয়া, পুরান্দিয়া এলাকায় ২০০ হেক্টর জমিতে চলতি মৌসুমে বিষমুক্ত সবজি চাষাবাদ করা হয়েছে। উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে আমরা কৃষকদের ফেরোমন ফাঁদ পদ্ধতির বিভিন্ন উপকরণ সরবরাহের পাশাপাশি পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করছি। বিঘাপ্রতি জমিতে ১৫-১৬টি করে ফেরোমেন ফাঁদ বসানো হয়েছে। একসময় কৃষকদের এগুলো বিনামূল্যে দেয়া হলেও এখন প্রতিটি ফেরোমেন ফাঁদ ৭০ টাকা মূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে ।’
উপজেলা কৃষি অফিসার মো. হানিফ সিকদার বলেন, ‘মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে বিষমুক্ত সবজির বিকল্প নেই। ফেরোমন ফাঁদ পদ্ধতির মাধ্যমে বিষমুক্ত সবজি উত্পাদন শিবপুরে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। এতে ভোক্তারা নিরাপদ সবজি পাওয়ায় বিদেশিরাও বিষমুক্ত সবজি ক্রয় করতে আসেন।’
মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশ
রাসায়নিক কীটনাশকের সাহায্যে চাষাবাদে জমিতে বিষপ্রয়োগের ফলে মাটির গুণাগুণ ব্যাহত হয় মারাত্মকভাবে । ফসলের উপর কীটনাশকের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের ফলে সেগুলো মানবদেহের জন্যও ক্ষতিকর । এমনকি রান্না করার পরও কীটনাশকের প্রভাব থেকে যাওয়ায় এটি মানুষের পাকস্থলীকে আক্রান্ত করে এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়ার ফলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট এবং ক্যান্সারের মত জটিল ও কঠিন রোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে । এছাড়াও বাতাসের সাথে মিশে গিয়ে কীটনাশক বাতাসকেও করে তুলছে বিষাক্ত ।
অন্যদিকে জৈব -বালাইনাশক এবং ফেরোমেন ট্র্যাপের সাহায্যে চাষাবাদে পরিবেশ বা মানবস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ কিছু নেই বলে এই পদ্ধতিতে চাষাবাদকে আরো জনপ্রিয় করে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তাই ফেরোমেন ফাঁদের সাহায্যে পুরো বাংলাদেশ একদিন বিষমুক্ত সবজির খামারে পরিণত হবে এবং বিষমুক্ত সবজি রপ্তানীখাত থেকে আরো বেশি বৈদেশিক আয়ে সমৃদ্ধ হবে বাংলাদেশ – এমন আশা আমরা করতেই পারি ।