বাস্তবচিত্রে সুন্দরবন এবং সমসাময়িক বিশ্ব; কিছু অবশ্যপালনীয় কর্তব্য !
দিব্য কান্তি দত্ত
২০০৭ এ ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’র কথা মনে আছে? কিংবা ২০০৯ এর ‘আইলা’? ‘সিডর’র বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির পুরোটাই হয়েছিল দেশের দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে যার পরিমাণ প্রায় এক দশমিক সাত বিলিয়ন ইউএস ডলার প্রায়! বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন না থাকলে ক্ষতির পরিমাণ কত দাঁড়াত সেটা ধারণারও বাইরে! ম্যানগ্রোভ বন পৃথিবীর যেকোন অঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ এবং ম্যানগ্রোভ গাছগুলো বস্তুত পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গাছ।
এবার চিন্তা করুন বাংলাদেশের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করা এই গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল যদি পানিতে তলিয়ে যায় তবে বিষয়টা কেমন হবে! ধারণার বাইরে হলেও আশ্চর্যজনকভাবে এটিই সত্যি যে, পৃথিবীর একটি বড় পরিমাণ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের পরিণতি সমু্দ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সেদিকেই অগ্রসরমান! সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি উপকূলীয় সম্প্রদায়ের দীর্ঘ সময় টিকে থাকার ক্ষমতাকে যেমন প্রভাবিত করছে তেমনি প্রভাবিত করছে প্রবালপ্রাচীর, লবণাক্ত জলাভূমিকে; যার ফলে প্রভাবিত হচ্ছে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের বাস্তুসংস্থান। বিংশ শতাব্দী থেকেই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমবৃদ্ধিমান। তবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে একুশ শতকে এই বৃদ্ধির হার ত্বরাণ্বিত হয়েছে ব্যাপক হারে এবং এই বৃদ্ধিহার এখনও অনিশ্চিত! এছাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট মূল অনিশ্চয়তার ভিতর রয়েছে গ্রীনল্যান্ডের ভূমিকা, পশ্চিম কুমেরুর বরফের স্তরের প্রভাব। এর ফলে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের উদ্ভিদগুলোর অভিযোজনের সফলতার পরিমাণ।
দ্রুত পরিবৃদ্ধির মাধ্যমে পলির স্তূপ তৈরি করার ক্ষমতা রয়েছে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের যার দ্বারা এরা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার সাথে পাল্লা দিয়ে বন্যা রোধ করতে পারে। এর ফলে সিক্তভূমিতে মাটির নিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন ঘটে যা গাছপালা জন্মানোর জন্য উপযুক্ত। ‘নেচার’ সাময়িকীতে প্রকাশিত সমীক্ষা অনুযায়ী ২০০০ সালে পুরো পৃথিবীর ১৩৭,৭৬০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে প্রায় ১১৮ টি অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ছিল। এদের ভিতর পঁচাত্তর শতাংশ বনাঞ্চলই ১৫ টি দেশে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এদের ভিতরে মাত্র ৬.৯ শতাংশ স্বীকৃত সংস্থার অধীনে সংরক্ষিত। ‘জাতিসংঘ’র ‘ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অরগানাইজেশন (ফাও)’ কর্তৃক পরিচালিত সমীক্ষায় ম্যানগ্রোভ বনের পরিমাণ ছিল পূর্বোল্লেখিত সমীক্ষার চেয়ে ১২.৫ শতাংশ বেশি। জীবভৌগলিক বিস্তার অনুযায়ী ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলগুলো সাধারণত ক্রান্তীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থিত যাদের অধিকাংশই পাওয়া যায় ৫ ডিগ্রি উত্তর থেকে ৫ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশের ভিতরে।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ম্যানগ্রোভ বন ধারণ করে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ অঞ্চল। কিন্তু নৃতাত্ত্বিক গতিবিধির কারণে এসব অঞ্চলে পলির বিতরণ খুবই অল্প পরিমাণ। বিষয়টি প্রচন্ড উদ্বেগের, কারণ এই অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার খুব বেশি বলেই ধারণা করা হয়। সমীক্ষা থেকে জানা যায়, স্তর গঠনের জন্য পললের পর্যাপ্ততা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার সাথে পাল্লা দিয়ে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলগুলোর ভূমি ক্রমন্নোনয়নের ধারাকে নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় আনতে পারে। এখানে বাজে খবরটা হল এই যে, বর্তমানে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার পলল স্তর গঠনের তুলনায় অনেক বেশি। এছাড়া যেসব ম্যানগ্রোভ বনে পলির সরবরাহ অল্প এবং জোয়ার-ভাটার পরিমাণ কম সেসব ম্যানগ্রোভ বন হয়ত ২০৭০ সাল নাগাদ তলিয়ে যাবে!
পুরো বিশ্বের ম্যানগ্রোভ বনের ওপর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। এই সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে মূলত বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং মনুষ্য উদ্ভূত দিকগুলোর কারণে। উপকূলের সাথে মানুষের হাজার বছরের সম্পর্ক। কিন্তু বর্তমান সময়ে ক্রমবর্ধমান মানুষ এবং তাদের জীবনযাত্রা উপকূলীয় অঞ্চলের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যকে হুমকির মুখে ফেলছে। এর ফলে ব্যাহত হচ্ছে সেসব এলাকার পশুপাখি ও গাছপালার অভিযোজন প্রক্রিয়া, মাটির গঠন এবং জলাভূমির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। পরিবর্তিত হচ্ছে পুষ্টির ধরণ যার ফলে প্রভাবিত হচ্ছে আবহাওয়া এবং ধ্বংস হচ্ছে পলি সরবরাহের মাধ্যম। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল খাদ্য সরবরাহ, প্রাকৃতিক দূর্যোগের মোকাবিলা এবং প্রচুর পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ ঠেকিয়ে প্রতিবছর লাখ লাখ প্রাণীর জীবন বাঁচায়। এরা প্রতিবছর হেক্টরপ্রতি প্রায় ২০০,০০০ ইউএস ডলারের সার্ভিস দেয়! বৈশ্বিক প্রকৃতি সংরক্ষণে, প্রাকৃতিক দূর্যোগের মোকাবিলা, বিভিন্ন প্রাণীর সংস্থান ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় এ বনাঞ্চলের গুরুত্ব বিশ্বের যেকোন বনাঞ্চলের চেয়ে বেশি। ম্যানগ্রোভ বনগুলোর বাস্তুসংস্থানের প্রতি যত্নশীল হওয়া এবং উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধ ব্যবহার রোধ করার মাধ্যমে সেখানকার আবহাওয়া এবং জলবায়ুর দ্রুতগতির পরিবর্তন রোধ করার মাধ্যমে বনাঞ্চলগুলো সংরক্ষণের কাজ শুরু করতে হবে। নতুবা কে জানে, বাংলাদেশ সহ অনেক দেশই হারিয়ে যাবে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে…