পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও জাতীয় অর্থনীতি বিবেচনায় শিল্প-কারখানার পরিবেশ ম্যাপিং জরুরী
বিভিন্ন শিল্প-কলকারখানার বর্জ্যে মহানগরী ঢাকাসহ আশপাশের জেলাসমূহে পরিবেশ দূষণ মারাত্মক পর্যায়ে পৌছেছে। এতদিন কারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য দূষণের দিকটি আলোচনায় আসলেও কারখানার অভ্যন্তরীণ পরিবেশ দূষণের (ইনডোর পলিউশন) দিকে নজর দেয়া হয়নি। অথচ ইনডোর পলিউশনে অভ্যন্তরীণ পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি আশেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় দূষণ ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে আমাদের শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হয়, শ্রমিকের স্বাস্থ্যহানির মাধ্যমে শ্রমঘন্টা নষ্ট হয়, যা জনস্বাস্থ্য, জাতীয় অর্থনীতি ও রপ্তানির উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। জনগণের জীবনমান উন্নয়নই সরকারের লক্ষ্য সেই লক্ষ্যে শিল্প কারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য দূষণের পাশাপাশি শিল্পের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ দূষণমুক্ত করতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রাথমিক কাজ হলো বিভিন্ন শিল্প-কারখানার সেক্টর অনুযায়ী ম্যাপিং করে তার পরিবেশ উন্নয়নে কৌশল নির্ধারণ করা।
আজ ০২ ডিসেম্বর ২০১৫, সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে জনউদ্যোগ, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এবং আইইডির যৌথ উদ্যোগে “শিল্প অভ্যন্তরীণ পরিবেশ ঃ উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণ” শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।
পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখেন সংসদ সদস্য নাজমুল হক প্রধান, টিইউসির সভাপতি শ্রমিক নেতা শহীদুল্লাহ চৌধুরী, পবার নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আসলাম খান, ডা: লেলিন চৌধুরী, জনউদ্যোগের সদস্য সচিব তারিক হাসান মিঠুল, আইইডির প্রকল্প সমন্বয়কারী জ্যোতি চট্রোপাধ্যায়, গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা আবুল হোসেন, রুহুল আমিন প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কর্মপরিবেশে নিরাপত্তার বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রমিক কল্যাণ ও সুস্থ শ্রম পরিবেশ নিশ্চিতের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে না পারলে আমাদের জাতীয় উন্নয়ন ব্যাহত হবে। এ দেশে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উৎপাদনমুখী, শোভন, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার, মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের সমন্বিতভাবে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
একেক ধরণের কাজে একেক ধরণের ঝুঁকি। কাজের ধরণ বুঝে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। নিরাপদ কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করা মালিকের দায়িত্ব, তবে এক্ষেত্রে শ্রমিকেরও যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। কাজের অভ্যন্তরীণ স্স্থ্যু পরিবেশের অভাবে যে ঝুঁকিসমূহ লক্ষ্য করা যায় তা হলো ১. শারীরিক ঝুঁকি : উচ্চতাপ, চাপ, বিকিরণ, শব্দ ও কম্পন, অপর্যাপ্ত আলো ও বায়ু চলাচল ব্যবস্থা, কাজের ধরণ প্রভৃতি শ্রমিকের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে। এতে শ্রমিকের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কখনো পুড়ে যায় বা হাত-পা হারিয়ে পঙ্গু হয়ে যায়। ২. কর্মপরিবেশ ঝুঁকি : অবৈজ্ঞানিক, ত্রুটিপূর্ণ ও বেআইনী অবকাঠামো, দূর্বল যন্ত্রপাতি, কর্মপরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার জন্য শ্রমিককে দীর্ঘ সময় বসে বা দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়। ফলে শ্রমিক মাংশপেশী, অস্থিসন্ধির ব্যথা ও চোখের সমস্যাসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়। ৩. রাসায়নিক (ক্যামিকেল) ঝুঁকি : রাসায়নিক দ্রব্য, এসিড, গ্যাস, বাষ্প, ধোঁয়া প্রভৃতি নিয়ে পরিচ্ছন্নতা কর্মী, কীটনাশক স্প্রে ও সার কারখানা শ্রমিক রাসায়নিক ঝুঁকির মধ্যে জীবনযাপন করেন। ৪. জীবানুঘটিত ঝুঁকি : জীবানু যেমন- ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস (এইচআইভি) ইত্যাদি কারণে শ্রমিকের স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা যায়। ৫. মানসিক ঝুঁকি : একঘেঁয়ে কাজ, কাজের ভুল পদ্ধতি প্রভৃতি কারণে শ্রমিক ক্লান্ত ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। নারী-পুরুষ সকলের জন্য সুস্থ শ্রমপরিবেশ নিশ্চিতকরণ, মালিক-শ্রমিক সমন্বয় এবং শ্রম অধিকার সুনিশ্চিত করণের লক্ষ্যে এক্ষেত্রে আইএলও কনভেনশন অনুসরণ বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫ (ঘ) শ্রমিকের নিরাপত্তা উন্নত পরিবেশের কথা বলা হয়েছে। আইন-বিধিমালা-নীতিমালা থাকা পরেও বারবার পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করা সত্যেও এখনো বহুক্ষেত্রে শ্রমিকদের বিশেষ করে নারীশ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিহীন ও নিরাপদ নয়।
গোলটেবিল বৈঠক থেকে নিন্মোক্ত সুপারিশসমূহ করা হয়:
১. পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও জাতীয় অর্থনীতি বিবেচনায় শিল্প-কারখানার ভিতরের ও বাইরের কর্মপরিবেশ উন্নয়নে শিল্পকারখানার পরিবেশ ম্যাপিং করা।
২. পরিবেশবান্ধব শিল্প, ইটিপি স্থাপনে সরকার এবং মালিকদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করা। পরিবেশ উন্নয়নে ব্যয় মনে না করে বিনিয়োগের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা।
৩. প্রয়োজনানুযায়ী শিল্প ঘন এলাকায় পরিবেশ আদালত স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৪. বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-২০০৬ অনুযায়ী অনতিবিলম্বে একটি “কোড এনফোর্সমেন্ট এজেন্সী” গঠন এবং নির্মাণ ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড নির্দেশিত বিধানাবলীর সুষ্ঠ প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ;
৫. কাজের জায়গায় নির্মল ও অবাধ বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা ও সহনীয় তাপমাত্রা বজায় রাখা, ধুলা-বালি, ধোঁয়া নিয়ন্ত্রন ও নির্গমন ও পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা রাখা ও অতিরিক্ত ভীড় রোধ করা;
৬. ঝুঁকিপূর্ণ, মেয়াদোত্তীর্ণ ভবন ও যন্ত্রপাতি থেকে শ্রমিকদের দূরে রাখা ও বয়লার ব্যবহারে প্রশিক্ষন প্রদান;
৭. শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে আমাদের গবেষণালব্ধ ফলাফল দরকার। এ ব্যাপারে গবেষণা করা;
৮. কর্মপরিবেশ নিরাপদ করতে শ্রমিকবান্ধব শ্রমনীতি প্রণয়ন করা এবং আইএলওর নীতি বাস্তবায়ন করা;
৯. ফ্যাক্টরী ও বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে জরুরী বহির্গমন সিঁড়ি ও অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা। সেই সাথে বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং, ট্রান্সমিটার, জেনারেটর এবং স্পর্শকাতর যন্ত্রপাতিগুলোর নিয়মিত পরীক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।