মহাকাশের অনন্ত যাত্রায় এবার মাছি!

উম্মে সালমা মৌটুসি

NASA ওরফে National aeronautics and space administration খুবই পরিচিত এক নাম ।দুনিয়ার সব অদ্ভুদ আর অস্বাভাবিক বৈজ্ঞানিক খবরের সন্ধান আমরা এখান থেকেই পাই ।পৃথিবীর বাহিরে মহাজগতে গরমের ছুটি কাটানোর জন্য তারা মানুষের সাথে সাথে পাঠিয়েছেন বানর, কুকুর, শিংপাঞ্জি আর কতো কি। সে খবর আমরা কম বেশি সবাই জানি।

কিন্তু নতুন খবর তো আরও অদ্ভুত!! এবার নাকি তারা মানুষ তো নয়ই, এমনকি গরু, ছাগল, কুকুর, বিড়াল কাউকেই  না বরং এদের বদলে কিনা পাঠাবে এক ক্ষুদ্রাকার মাছিকে পৃথিবীর বাহিরে বিশাল জগতে ছুটি কাটাতে!!

এর কারণ হিসেবে নাসার এক জীববিজ্ঞানি শারমিলা ভট্টাচার্য বলেন “৭৭% বহুল পরিচিত মানুষের রোগবাহী জীন এর সাথে ফলের মাছির জেনেটিক কোড এর যথেষ্ট মিল রয়েছে এবং স্তুন্যপায়ীদের সাথে এই মাছির প্রোটিন ক্রমের ৫০% মিল রয়েছে”।

তার মানে এই দাঁড়ালো যে মানুষ নামক বুদ্ধিমান প্রাণীটির সাথে এই ক্ষুদ্রাকার মাছির আশ্চর্যজনক ভাবে অনেক মিল রয়েছে। এই দুনিয়ায় কি এও সম্ভব!!!!!!!?????

fruit-fly

এই বিস্ময়কর কিন্তু খুবই সাধারন fruit fly বা ফলের মাছি, এর বৈজ্ঞানিক নাম হল Drosophila melanoster। ছোট-খাট, চিকন-চাকন এই মাছি দেখতে কিন্তু বেশ আকর্ষণীয়। যদিও তারা পচা কলা খেতে পছন্দ করে। পিন আকারের ক্ষুদ্র মস্তকবিশিষ্ট এই মাছি দিনে প্রায় শতটি ডিম পারতে সক্ষম। স্তন্যপায়ী আর মানুষের সাথে এত মিল বলেই এরা জেনেটিক রিসার্চ ল্যাব এ বহুল পরিচিত। শুধু তাই নয় মানুষের বিকল্প এক প্রানী হিসেবে তাদের বেশ সুখ্যাতি আছে। তাছাড়া এরা খুব অল্প সময়েই বংশবিস্তার করতে সক্ষম। ফলে খুব অল্প সময়েই এদের প্রজন্ম সম্পর্কে গবেষণা করা যায়। এমনকি ইতিমধ্যে এদের জিনোমের সম্পূর্ণ ম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। তাছাড়া প্রাকিন্সন এবং হান্টিংটন সহ বেশ কিছু মানব রোগের জেনেটিক মডেল হিসেবেও এদের ব্যবহার করা হচ্ছে।fruit-fly-drosophila-npy-hunger-memory-appetitive_1

মূলত এসব কারনেই এসব ফলের মাছি হলো এবার নভোচারীদের জেনেটিক মডেল। আসুন এবার জানি কিছু ইতিহাস যা শুরু হয়েছে ২০০৪ সাল থেকে আর ঠিক কেনই নাসার বিজ্ঞানিরা মাছিকেই বেছে নিলেন মানুষের জেনেটিক মডেল।

ভট্টাচার্য বলেন- “আমরা International Space Station এ ফলের মাছিদের পাঠাচ্ছি। তারা নভোচারীদের পাশাপাশি পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরবে এবং মানুষের উপর দীর্ঘমেয়াদী স্পেস ফ্লাইট এর প্রভাব অন্বেষণে আমাদের সাহায্য করবে”।

Rice University এর প্রফেসর ক্যাটি বেকিংহাম (Kate Beckingham) যিনি ভট্টাচার্য এবং বোগলাস আর্মস্ট্রং (Bouglas Armstrong) এর সাথে Edinburgh University তে একসাথে কাজ করেন, তারা ISS এ ফলের মাছি পাঠানোর গবেষণার নাম দেন Drosophila Behavior and Gene Expression in Microgravity। এই গবেষণার মাধ্যমে Drosophila এবং মানুষের জীনের উপর মহাকাশ ভ্রমনের প্রভাব জানা সম্ভব হবে। এটা NASA-র কাছে খুবই আগ্রহের বিষয়।কেননা মহাকাশ ভ্রমনের সময় নভোচারীরা মহাকর্ষ বলের বাহিরে চলে যায়। যেমন মঙ্গল গ্রহ ভ্রমনের সময়- একজন নভোচারী যাত্রার শুরুতে নিজের ওজন কয়েক গ্রাম অনুভব করবে, পরে Interplanetary space এ ওজন শূন্য গ্রাম, মঙ্গলে নামার সময় আবার ওজন কয়েক গ্রাম এবং Red Planet এর ওপর থাকাকালে ওজন .০.৩৮ গ্রাম অনুভব করবে। কিন্তু এই সব পরিবর্তনের সাথে সাথে জীনরা ঠিক কি রকম প্রতিক্রিয়া করবে? তারা কি কোন নতুন বা অপ্রত্যাশিত ভাবে নিজেদের প্রকাশিত করবে?science-042012-006-617x416

বেকিংহাম বলেন “ জীনরা কোষকে প্রোটিন তৈরির নির্দেশ দেয়।মানবদেহে ৫০০০০ এর মতো বিভিন্ন রকমের প্রোটিন আছে এবং এরাই মূলত সব কাজ করে থাকে।এরা আমাদের খাদ্য হজমে, রক্ত জমাট বাধা, ক্ষত নিরাময়সহ অনেক কাজেই সাহায্য করে থাকে।এরা আমাদের কোষ ও টিস্যু গঠন করে।তাই মহাকাশে কম মহাকর্ষণের জন্য জীনরা যদি ভিন্ন গঠনের প্রোটিন তৈরির নির্দেশ দেয়, তাহলে আমাদের শরীরে অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটতে পারে”।

তিনি আরও বলেছিলেন “ওজনহীনতায় জেনেটিক আচরণের পরিবর্তনের প্রমাণ আমরা আগেই পেয়েছি”।যেমনটি ঘটেছিল ১৯৯৯ সালে, মহাকাশে স্পেস শাটলে থাকার সময় বিজ্ঞানীদের কিডনির কোষ বৃদ্ধি পেয়েছিল।এক হাজারেরও বেশি কোষের জীন ভিন্ন আচরন করেছিল।এদের মধ্যে একটি ছিল যা অতিরিক্ত ভিটামিন ডি তৈরি করেছিল। ভিটামিন ডি প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার প্রতিরোধে মানুষকে সাহায্য করে। এরা হয়ত মহাকাশে দীর্ঘ ভ্রমনের একটি ভাল দিক।

বাকি পরিবর্তন গুলো তেমন ভাল কিছু নয়। নভোচারীদের রোগ প্রতিরোধকারী কোষগুলো কম কার্যকর হয়ে পড়েছিল। দীর্ঘ যাত্রাপথে তাদের হাড় দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং প্রচুর ব্যায়াম ছাড়াই মাংসপেশির অবনতি ঘটেছিল। “ আর এসবই ঘটেছিল মূলত ভিন্ন জেনেটিক আচরণের কারনে” বেকিংহাম বলেন।

মহাকাশ ভ্রমন জেনেটিক কাজে প্রভাব ফেলে এ ব্যাপারে গবেষকরা নিশ্চিত হলেও, আসলে ঠিক কোন কোন জীনে বা কীভাবে প্রভাব ফেলে তা এখনও তারা বের করতে পারেননি।

আর এ জন্যই ‘Fruit Fly’। বেকিংহামের টিম মহাকাশে ISS এ থাকাকালে Drosophila র ৯টি প্রজন্ম পর্যন্ত প্রজনন ঘটাবেন এবং প্রতি প্রজন্মে প্রায় ১২০ টি করে মাছি থাকবে। প্রতি ব্যাচ থেকে ৩টি করে মাছি সংগ্রহ করে হিমায়িত করা হবে। পৃথিবীতে ফিরে এসে তারা এইসব সংগৃহীত মাছির RNA এবং প্রোটিন পরীক্ষা করবেন এবং দেখবেন কোন জীনগুলো অরবিটে বেশি বা কম সক্রিয় ছিল।

মহাকাশে ISS এ থাকার জন্য এই সব মাছিদের একটি বিশেষ ঘর থাকবে এবং তারা এদের সর্বক্ষণ পর্যবেক্ষণ করবেন। এইসব মাছিরা তাদের মহাকাশ যাত্রা শুরু করবে ডিমরূপে এবং স্পেস ষ্টেশন এ পৌছবে লার্ভার আকারে। বেকিংহাম আশা করেন পৃথিবীর ৯০ দিনের মধ্যেই এইসব বাচ্চা মাছিরা বড় হবে, প্রজনন করবে এবং এক জাঁক মাছিতে পরিণত হবে।international_space_station_by_mcsdaver-d46to94

একদিন মানুষও হয়ত এভাবে মহাকাশে বা মঙ্গলে যাবে এবং দীর্ঘকাল সেখানে বসবাস করবে। তখন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তাদের কী পরিবর্তন ঘটতে পারে তারই এক অগ্রিম উদাহরণ হয়তবা এই ফলের মাছিরা আমাদের দিতে পারবে।

ভট্টাচার্য  সতর্কবাণী হিসেবে এও বলেছিলেন যে মহাকাশে Drosophila র ৯ টি প্রজন্ম হয়তো খুব বেশি কিছু নয় একটা সঠিক উত্তর পাবার জন্য। কিন্তু এই ৯০ দিনের পরীক্ষায় মহাকাশ ভ্রমনে কোন জীনগুলো বেশি প্রভাবিত হয় তা জানা যাবে এবং এ থেকে কোন আবাসে বেশি প্রজন্মের মাছি বেঁচে থাকতে পারবে তা নিয়ে গবেষণা করা যাবে।মহাকাশে genetic evolution নিয়ে পরীক্ষা করার জন্য হয়তবা ১০০টি প্রজন্মের দরকার ছিল। কিন্তু তা ভবিষ্যতের জন্য- তিনি এও বলেছিলেন।

আর এসব চিন্তা থেকেই fruit fly mission এর সূত্রপাত, যা শুরু হয়েছে এ বছর থেকে। তৈরি করা হয়েছে অত্যাধুনিক fruit fly lab এর যেখানে পৃথিবীর বিখ্যাত বিজ্ঞানিরা এই সব মাছিদের ওপর নজর রাখবেন।

তাহলে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন পচা কলা যাদের খাদ্য সেসব মাছিরাও কততা মূল্যবান!! তাই আর মাছিদের অবহেলা না করে তাদের বেশি করে পচা কলা খেতে দেয়া উচিত আর পারলে কিছু রিষ্ট পুষ্ট মাছিকে পারলে ISS parcel করে পাঠালেও কিন্তু মন্দ হয় না…।।

ref- http://www.nasa.gov/vision/earth/livingthings/03feb_fruitfly_prt.htm

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics