বিশ্বরেকর্ড হলো বাংলাদেশে; আবিষ্কৃত নতুন প্রজাতির ব্যাঙ !
শাওন চৌধুরী
মাঝে মাঝেই আমাদের মনে হয়, বিজ্ঞানের এই স্বর্ণযুগে হয়তো নতুন আবিষ্কারের কিছুই নেই, আর বিজ্ঞানের সেই শাখা যদি হয় প্রাণিজগৎ, তবে সেখানে নতুন কোনো মেরুদন্ডী প্রাণির কথা তো কল্পনাতেও আনা দুস্কর! এরপরও মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা ইতিহাস পাল্টে দেয়। আজকের এই লেখাতে থাকছে এক অসাধারণ আবিষ্কারের কথা, এক নতুন প্রজাতির ব্যাঙ ! যা কিনা আবিষ্কার করেছেন বাংলাদেশের এক গবেষক!
মানুষ বাদে প্রতিটি প্রাণির জন্যই একটি নির্দিষ্ট প্রজনন কাল রয়েছে, কারও শীতে, কারও বর্ষাতে কিংবা কারও গ্রীষ্মে! ব্যাঙের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরো সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়। আমরা সবাই-ই জানি যে, বর্ষাতে হঠাৎ করেই ব্যাঙের ডাক অনেক বেশি শোনা যায়। অন্যদিকে শীতে এদের ডাক শোনাতো দূরের কথা, দেখা প্রায় মেলে না বললেই চলে। এই অবস্থায় যদি এমন কোনো প্রজাতি পাওয়া যায়, যার প্রজনন কাল কিনা সারা বছরই (!), তাহলে কিন্তু তা নিমিষেই গবেষকের ভাববার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়!
বরিশালে সচরাচর দেখতে পাওয়া ব্যাঙের মধ্যে সম্প্রতি ড. এম. সাজিদ আলী হাওলাদার এই ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেন। তিনি খেয়াল করেন যে, এদের মধ্যে এমন ধরণের ব্যাঙ রয়েছে যার প্রজননকাল সুনির্দিষ্ট নয় বরং বছরের পুরোটা জুড়েই এদের প্রজনন ক্ষমতা রয়েছে।
প্রথম দেখাতে এদেরকে ১৭৯৯ সালে জার্মান প্রকৃতিবিদ স্নেইডার কতৃক আবিস্কৃত Euphlyctis cyanophlyctis এর মতোন মনে হলেও একটু ভাল করে খেয়াল করলে সূক্ষ্ম পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। শরীরের আকার-আকৃতি ও বাইরের গঠন একটু ভাল করে পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে এরা হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি প্রজাতি। এই নতুন প্রজাতির ব্যাঙের মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনের সাথে Euphlyctis গণের অন্যান্য প্রজাতির জিনের মধ্যে শতকরা প্রায় ৫.৫ থেকে ১৮ ভাগ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
একটু গাঢ় রঙের ধূসর বাদামী ও সবুজ পিঠ, গোল ছোপ ছোপ দাগ এবং সাদা উদরই E. cyanophlyctis থেকে এদেরকে আলাদা করেছে। এছাড়াও অন্যান্যদের থেকে এদের মিলনের পদ্ধতিও একটু অন্যরকম। আবিষ্কারক সাজিদ আলী হাওলাদার এই নতুন প্রজাতির ব্যাঙের নাম রেখেছেন Euphlyctis kalasgramensis. এদের খাবারের তালিকায় রয়েছে ছোট ছোট পোকা, ছোট শামুক, মাকড়সা, নানান ধরণের পতঙ্গ যেগুলো মূলত ফসলের ক্ষতি করে থাকে। আবিষ্কারকের মতে, পানি দূষণ এবং সচেতনতার অভাবের কারণে এদের সংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণে কমে যেতে পারে। এই নতুন ব্যাঙের আবিষ্কারের কথাটি ‘PLOS ONE’ নামক সাময়িকীতে চলতি মাসের (ফেব্রুয়ারি) ৪ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, ড. সাজিদ আলী হাওলাদার এর আগে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। অনার্স শেষ হবার পরে মাস্টার্স শেষ করার আগেই তিনি ফিনল্যান্ডের হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সুযোগ পান। ছোটবেলাতে তিনি কলসগ্রাম নামক গ্রামে বড় হয়েছেন। মাতৃভূমির প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান রেখে তিনি নতুন আবিস্কৃত ব্যাঙের প্রজাতির নাম এই গ্রামের নামেই করেছেন।
হরতাল, অবরোধ, পেট্রোল বোমার ছড়াছড়িতে ভালো খবর তো প্রায় হারিয়েই যাচ্ছে। দেশের এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতেও গবেষক সাজিদের মতোন এমন কিছু মানুষ নিষ্ঠার সাথে ভালো কাজ করে যাচ্ছেন, যা দেখে যে কেউই অনুপ্রাণিত হতে পারেন। হয়তো সেদিন আর বেশি দূরে নেই যখন এই ড. সাজিদের মতোন আরো অনেক গবেষকের কারণে বাংলাদেশ নামক এই ছোট্ট দেশের কথা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের মুখে ধ্বনিত হবে!
‘PLOS ONE’ সাময়িকীতে প্রকাশিত এই নতুন প্রজাতির ব্যাঙের আবিষ্কারের কথা জানতে এখানে ক্লিক করুন।