বাংলাদেশের পর এবার ভারতেও নতুন প্রজাতির ব্যাঙের খোঁজ !
দিব্য কান্তি দত্ত
আপনার আশেপাশে নিশ্চয়ই প্রায়ই আপনি ব্যাঙ দেখে থাকেন? এবং স্বাভাবিকভাবেই পাত্তা দেননা। এরকম কুনোব্যাঙ তো চারপাশে কত দেখা যায়। একই ব্যাঙ চারপাশে বারবার দেখতে দেখতে আপনার ভিতর ব্যাঙ দেখে অবাক হওয়ার মত কোন অনুভূতি অবশিষ্ট না থাকাটাই স্বাভাবিক বটে। কিন্তু শহরে যারা থাকেন, তাদের চারপাশে ব্যাঙ একদম চোখে পড়েনা বললেই চলে। তারমানে ব্যাঙের সংখ্যা দিন দিন আশংকাজনক হারে কমে যাচ্ছে! শুধু কুনোব্যাঙ দেখে অভ্যস্ত আপনার হয়ত ধারণাই নেই যে বাংলাদেশে ২১ টি গণের প্রায় ৫০ এর কাছাকাছি ব্যাঙের প্রজাতি রয়েছে এবং এদের মধ্যে প্রায় ২৫ টির বেশি প্রজাতি বিলুপ্তির হুমকির সম্মুখীন! বাংলাদেশে ব্যাঙের প্রজাতির সংখ্যাটা হয়ত আরো বেশি এবং অনেক প্রজাতিই এখনও দৃষ্টিগোচর নয়! পুরো বিশ্বে এই প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৪৮০০ এর কাছাকাছি। এদের মধ্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রজাতি এখন বিলুপ্তপ্রায়। এত খারাপ খবরের মধ্যেও ভাল খবর হল, এখনও প্রতিনিয়ত ব্যাঙের নতুন নতুন প্রজাতির সন্ধান মিলছে। তেমনই এক নতুন প্রজাতির ব্যাঙের সন্ধান দিতেই এতক্ষণ ব্যাঙ নিয়ে এত বকবক করা… নতুন প্রজাতির এই ব্যাঙের দেখা মিলেছে আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে। ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর’ এবং ভারতের একদল গবেষক দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের উরুপী জেলার মনিপালের উপকূলীয় এলাকায় এ প্রজাতির ব্যাঙের সন্ধান পেয়েছেন।
ব্যাঙটি Microhyla গণের অন্তর্ভূক্ত এবং বাসস্থান অনুযায়ী এর নামকরণ করা হয়েছে Microhyla laterite. অর্থাৎ, প্রাপ্ত অঞ্চলের মাটির গঠনে ‘ল্যাটেরাইট’র প্রাধান্য রয়েছে। ল্যাটেরাইটভিত্তিক মাটির গঠন দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ‘ল্যাটেরাইট’ এর বাংলা পরিভাষা করলে দাঁড়ায় ‘মোরাম’। এটি একধরণের লাল রঙবিশিষ্ট পাথর যা থেকে দ্রবণীয় খনিজগুলো পরিস্রুত হওয়ার পর তার ভিতর অদ্রবণীয় লৌহ এবং অ্যালুমিনিয়ামের বিভিন্ন অক্সাইড ও হাইড্রোক্সাইড উপাদান হিসেবে রয়ে গেছে। লৌহের আধিক্যের কারণেই এতে লাল রঙের প্রাধান্য দেখা যায়। এই পাথরগুলো সাধারণত ইট কিংবা রাস্তা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। গাছপালার অনাধিক্যের কারণে ভারতের এই অঞ্চলটিকে পাথুরে এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং পতিত ভূমির শ্রেণিতে সন্নিবেশিত করা হয়। এই এলাকাগুলো সাধারণত আস্তাকুঁড় হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং নির্মান কাজের উপাদান যোগানের জন্য প্রচুর পরিমাণে খনন করা হয়।
‘আমার মোরাম, আমার বাসস্থান’ নামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশের জন্য জরিপের অংশ হিসেবে ওই এলাকায় গিয়েছিলেন রমিত সিংগাল। সেখানে তিনি তথ্য সংগ্রহের জন্য মাটি পরীক্ষা করতে গিয়ে এ প্রজাতির ব্যাঙ তার নজরে আসে এবং পরবর্তীতে তিনি তা তার গবেষণা দলের প্রধান কে. এস. শেষাদ্রীর নজরে আনেন। এরপর তারা একসাথে ব্যাঙটি সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে শুরু করেন। ধূসর বাদামী রঙের ব্যাঙটির দৈর্ঘ্য ১.৬ সেন্টিমিটার। এর পৃষ্ঠদেশ, হাত, পা এবং পার্শ্বদেশে বিশেষ ধরনের কালো দাগ রয়েছে যার কারণে খুব সহজেই একে ঝিঁঝিপোকা ভেবে ভুল হতে পারে। যেহেতু, অন্যান্য গণের ব্যাঙের চেয়ে Microhyla গণের ব্যাঙের মুখ তুলনামূলক সংকীর্ণ হয়, সেহেতু গবেষক দল ‘সংকীর্ণ মুখের মোরাম’ নামটি এর সাধারণ নাম হিসেবে সুপারিশ করে। গবেষক দলের প্রধান এবং গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক জনাব শেষাদ্রী বলেন, “বাসস্থানের ওপর ব্যাঙটির নামকরণ করে আমরা বিপন্ন কিন্তু বাস্তুসংস্থানিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তর গঠনের ওপর সবার দৃষ্টি আনতে চাইছি। উক্ত প্রজাতিকে মাসকট হিসবে ব্যবহার করে আমরা এ ধরনের এলাকা সম্পর্কে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন করতে পারি”। এই প্রজাতির টিকে থাকা নিশ্চিত করতে শেষাদ্রী এবং তার দলের সদস্যরা প্রজাতিটির জিন এবং শারীরিক গঠন, রঙ এবং কণ্ঠস্বরের ধরন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। এছাড়া এ থেকে প্রাপ্ত তথ্য তারা এর সাথে সম্পর্কিত প্রজাতির সাথে মিলিয়ে দেখেছেন। তাদের মতে অনেকেই এ ব্যাঙকে Microhyla ornata ভেবে বিভ্রান্ত হতে পারে যা কিনা পুরো ভারতজুড়েই পাওয়া যায়। কিন্তু এ প্রজাতিটি শুধুমাত্র ভারতের পশ্চিমেই বিদ্যমান। যেহেতু ব্যাঙটির ভৌগলিক বাসস্থান অত্যন্ত সংকীর্ণ (দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের মাত্র ১৫০ কিলোমিটার এলাকা), সেহেতু প্রাথমিক মূল্যায়নের ওপর নির্ভর করে গবেষণা দল Microhyla laterite কে বিপন্ন হিসেবে ‘আইইউসিএন’র রেড লিস্টে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য সুপারিশ করেছেন। রমিত বলেন, “ভৌগলিক ঐতিহ্য হওয়া সত্ত্বেও ভারতে মোরাম এলাকাগুলো আইনের ভিত্তিতে খুব একটা সংরক্ষিত নয় বললেই চলে। এখনও পর্যন্ত এসব বাসস্থানগুলো যতটা হুমকি সম্মুখীন হচ্ছে তার ভিত্তিতে এলাকাগুলো সংরক্ষণের জন্য বিশেষ উদ্যেগ নেয়ার অনুরোধ রইল”।
শেষাদ্রীর ভাষ্য অনুযায়ী, “অরক্ষিত এলাকাগুলোতে উভচরেরা কিভাবে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকে তা আমাদের অজানা। মারাত্মকভাবে বিপন্ন এই ব্যাঙের প্রজাতির কথা মাথায় রেখে মোরাম এলাকাগুলো ‘সংরক্ষিত এলাকা’ অথবা ‘জীববৈজ্ঞানিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা’ হিসেবে ভারতীয় আইনের আওতায় আনা যেতে পারে, যাতে আমরা উভচর সম্পর্কে আরো বিস্তৃত গবেষণার সুযোগ পাই”।
ব্যাঙটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এবং জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা পত্রটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক,
শিক্ষার্থী;
মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ (সম্মান ৩য় বর্ষ)
শিক্ষার্থী;
মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ (সম্মান ৩য় বর্ষ)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়