প্লাস্টিকের সাগর চাই না !
মোহাম্মদ আরজু
এই মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব মাত্রই জলজ। এ জলেই জীবনের শুরু, এ জলই জীবন বাঁচায়। পৃথিবীতে প্রাণ ধারণের উপযোগী যে পরিমাণ জায়গা আছে, তার ৯৭ শতাংশই পৃথিবীর এই মহাসাগরে। দুনিয়ায় এ বিপুল লোনা জলভাগ সম্পর্কের দিক থেকে অখণ্ড, একটিই মহাসাগর আমাদের। আমাদের বাড়ির কাছের সাগরকে আমরা জানি ‘বঙ্গোপসাগর’ ডাকনামে।
এযাবৎ যতবারই নেমেছি বঙ্গোপসাগরতলে, ততবারই এ বিপুল নীল জলরাশি আমাদের সামনে হাজির করেছে নতুন বিস্ময়, একই সঙ্গে জাগিয়েছে বিপন্নতার বোধ। মহাসমুদ্রের লোনাজল শুধু বিচিত্র জীবনের আধারই নয়, স্থলভাগে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণের জীবন কেমন হবে, তাও নির্ভর করে এর ওপর।
বর্তমানে দুনিয়ার দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ উপকূল থেকে ৪০ মাইলের মধ্যে বাস করে। যারা বাস করে দূরে, তারাও সাগরের হাতছানির বাইরে নয়। দুনিয়ার ৮৬ শতাংশেরও বেশি পানীয়জলের মূল উত্স এ সাগর। বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান কেমন হবে, অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদরা কেমন থাকবে, তা অনেকাংশেই বঙ্গোপসাগরের ওপর নির্ভর করে।
স্থলভাগে বৃষ্টির পরিমাণ ও ধরণ, অর্থাৎ আবহাওয়া অনেকাংশেই সাগরনির্ভর। বৃষ্টিপাতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কৃষি, বন ও পরিবেশের সমৃদ্ধি ও সুস্বাস্থ্য। অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ মাছের অর্থাৎ মানুষের প্রোটিন-পুষ্টির জোগান দেয় সাগর।
গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চল যেমন আমাজনের চেয়েও অনেক বেশি বিচিত্র প্রাণের বসতি এখনো সাগরতলেই। অথচ প্রায় পুরোটাই অচেনা। ”ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার ফর মেরিন স্পেসিস” এর মতে, সাগরের প্রাণবৈচিত্র্যের তিন-চতুর্থাংশ সম্পর্কে মানুষের তেমন জানা-শোনা নেই। বিশেষত বাংলাদেশে সাগরের সঙ্গে জানা-শোনার এ ঘাটতির নেতিবাচক দিক রয়েছে অনেক।
দেশের অভ্যন্তরে পানি দূষণ, সাগরে যথেচ্ছা মাছ শিকার, জলবায়ু পরিবর্তন, শিকারি প্রজাতিগুলোকে নির্বিচারে নিধন, সামুদ্রিক প্রাণী ও উদ্ভিদের বসতি নষ্ট ও সার্বিক দূষণের খারাপ প্রতিক্রিয়া ঘটতে শুরু করেছে সাগরে। যে ভিডিওচিত্র তুলে আনছি আমরা, তাতে টের পাওয়া যাচ্ছে যে, মাছসহ নানা প্রাণীর নানা প্রজাতি বিপন্ন হচ্ছে, সামুদ্রিক কচ্ছপের নানা প্রজাতি বিপন্নপ্রায়, এছাড়াও পরিষ্কার করে জানিয়ে দিচ্ছে যে কচ্ছপরা সেই প্রাচীন ডাইনোসর যুগ থেকে এ যাবৎ টিকে ছিল। বিশেষত প্রবালের নানা প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে এখান থেকে।
পৃথিবীর মহাসাগরের মাত্র এক শতাংশ জায়গাজুড়ে আছে প্রবাল। বঙ্গোপসাগরেও সে রকমই। খুবই অল্প জায়গায় গড়ে উঠেছে প্রবালবসতি। কিন্তু এ প্রবালই সমুদ্রে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ প্রাণীর বসতি ও খাবার জোগায়। প্রবাল মূলত ‘পলিপস’, অনুজীব। দেখতে চুনাপাথরের মতো এ প্রবাল জমে জমে পাচীর গড়ে তোলে। আশ্রয় দেয় সাগরতলের নানা উদ্ভিদ ও শৈবালকে। অভয়ারণ্য হয়ে থাকে মাছসহ সব প্রাণীর। এরা অক্সিজেনও জোগায় সমুদ্রে। অথচ নির্বিচার আহরণ ও দূষণের কারণে বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগামী ৩০ বছরে বিশ্বের কমপক্ষে ৩০ শতাংশ প্রবাল নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে বর্তমান অবস্থা চালু থাকলে। এছাড়া আছে সমুদ্রের ফাইটোপ্লাংকটন। আণুবীক্ষণিক এ উদ্ভিদরা একদিকে বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ অক্সিজেন জোগায়, অন্যদিকে এক-তৃতীয়াংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেয়।
বিস্ময়ের এই মহাসাগরের এখন নতুন খবর হচ্ছে, মাছেদের চেয়ে এখন এখানে বেশি জায়গা দখল করে আছে আমদের ফেলা প্লাস্টিক-বর্জ্য। অপচনশীল প্লাস্টিকের জয়জয়কারে এখন স্থলভাগের মতই আক্রান্ত আমাদের এই প্রাণসাগর।
একবার ব্যবহার করে আমারা পলি-সামগ্রী যেখানেই ফেলি না কেনো, তা সাগরেই পৌঁছায় শেষতক। যত যত ভোগ্যপণ্য সামগ্রীর মোড়ক আমরা খুলি দৈনিক, রিসাইকেল করার আয়োজন ছাড়া তা সাগরেই পৌঁছায়। যেমন, প্রবাল বসতির দ্বীপ সেন্ট মার্টিনসে ট্যুরিস্টরা যদি প্রতিদিন একটি করে প্লাস্টিকের জলের বোতল ব্যবহার করেন তবে ছয় হাজার বোতলের আবর্জনা যায় সাগরে। আর আক্রান্ত করে সাগরের পরিবেশ ও প্রাণিদের।
চোখে দেখা যায় এমন প্লাস্টিকের বাইরেও আমরা ছড়াচ্ছি অদেখা প্লাস্টিকও। প্রতিদিন লাখো মানুষের ব্যবহৃত নানা প্রসাধনী পণ্য (যেমন ফেসওয়াশ) থেকে আনুবিক্ষণীক প্লাস্টিক কনা (মাইক্রোপ্লাস্টিক, মাইক্রোবিডস) নানা জলস্রোত হয়ে এমনভাবে সাগরে ছড়াচ্ছে যে তা আর সরিয়ে নেয়া সম্ভব না।
দেখা ও অদেখা এইসব প্লাস্টিকে ভর্তি সাগর আমরা চাই না। সামুদ্রিক প্রাণিদের পেট-ভর্তি মাইক্রোপ্লাস্টিক চাই না। প্রিয় সমুদ্রবন্ধু! প্লাস্টিক পরিহার করুন যথাসম্ভব। ভ্রমণকালে অন্তত পুনঃব্যবহারযোগ্য জলের বোতল সাথে নিন। আপনার প্রসাধনীতে মাইক্রোপ্লাস্টিক নাই বলে নিশ্চিত হলেই কেবল ব্যবহার করুন।
লেখক;
প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী, সেভ আওয়ার সি।