জ়ৈব কৃষিব্যবস্থা : টেকসই কৃষিব্যবস্থার একটি অন্যতম উপকরন

তানভীর হোসেন

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কৃষি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত, যার উপর দেশেরপুরো অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে। কৃষি আমাদের গুরুত্বপূর্ণ খাত হলেও সময়ের সাথে সাথে আমরা যে এই ব্যবস্থার যথোপযুক্ত উন্নয়ন ঘটাতে পারিনি, এটা অকপটেই বলা যায়। আধুনিক প্রযুক্তি, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিসমূহ আমরা এখনো খুব সাধারন পর্যায়ের কৃষকদের কাছে পৌছাতে পারি নি যা আমাদের স্বাস্থ্য, সমাজ ও পরিবেশের উপর প্রতিনিয়ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রচলিত রাসায়নিক কৃষিব্যবস্থা যদিও আমাদের তাৎক্ষনিক ভালো ফলাফল দিচ্ছে, কিন্তু অপরদিকে এর দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল কিন্তু মারাত্নকভাবে হিতে বিপরীত হতে পারে। কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিকের ব্যবহার সংশ্লিষ্ট জমির মাটিকে দূষিত করে। সেই সাথে এর চারপাশের পানি ও পরিবেশকেওকরে তোলে বিষাক্ত।

জৈব বা অর্গানিক কৃষি ব্যবস্থা হল এমন একটি সুষ্ঠ কৃষি ব্যবস্থা, যা এসকল রাসায়নিক ব্যবহারের উর্ধ্বে থেকে ফসলের সঠিক ফলন এবং তার সাথে পরিবেশের সুস্থতা নিশ্চিত করে। জৈব কৃষিব্যবস্থা বলতে বোঝায় এমন একটি কৃষিব্যবস্থা যেখানে বিভিন্ন পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব বিবেচনায় বিভিন্ন কৃত্রিম রাসায়নিক পদার্থ যেমন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক, পশুচিকিৎসার ঔষধ, জিনগত পরিবর্তিত বীজ ও প্রজাতি, বিভিন্ন সংরক্ষনকারী রাসায়নিক ইত্যাদি ব্যবহারের বিকল্পে প্রাকৃতিকউপাদান ও পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে মাটির উর্বরতা সংরক্ষরনের পাশাপাশি কীটপতঙ্গ ও ফসলের রোগজীবানু ধ্বংস করে।

org 4

সাধারনত কৃষিক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার হয়, যার একটি অন্যতম নেতিবাচক প্রভাব হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা। যেসকল কীটনাশক ব্যবহার করা হয় তার অধিকাংশেই থাকে পরিবেশ দূষণকারী সীসা, ক্যাডমিয়াম, মার্কারী প্রভৃতি ক্ষতিকারক খনিজ ধাতু যা বিভিন্ন ভাবে বায়ুতে মিশে মারাত্নক বিষাক্ত করে ফেলে পরিবেশকে। আবার কৃষি জমিতে বিভিন্ন সার ব্যবহার করা হয় যা নানা ধরনের গ্রীন হাউজ গ্যাস যেমন কার্বন ডাই অক্সাইড, হাইড্রোফ্লুরোকার্বন, পারফ্লুরোকার্বন, সালফার হেক্সাফ্লোরাইড, মিথেন, নাইট্রোজেন ইত্যাদি নিঃসরন করে। আরএগুলো বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রধান নিয়ামক। ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরিত রশ্মি গ্রীন হাউস গ্যাস ছেদ করে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে, কিন্তু প্রতিফলিত দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের রশ্মি এই গ্রীন হাউসের দেয়াল ভেদ করতে পারেনা।  ফলেতা  বায়ুমন্ডলে থেকে যায় এবং সময়ের পরিক্রমায় বায়ুমণ্ডলকে অস্বাভাবিক উষ্ণ করে ফেলে, যাকে আমরা বৈশ্বিক উষ্ণতা বলে থাকি।

জৈব কৃষিব্যবস্থায় সাধারনত উদ্ভিজ্জ বর্জসমূহই জমিতে পুষ্টি উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সাধারনত জমির ফসল উত্তোলনের পর উচ্ছিষ্ট অংশটুকু তুলে ফেলা হয় নতুন করে চাষ দেয়ার জন্য। জৈব কৃষিব্যবস্থায় এসকল উচ্ছিষ্ট অংশ জমিতেই রেখে দেয়া হয়। যাতে করেএগুলো নানা ভাবে বিয়োজিত হয়ে মাটিতে মিশে যায়। ফলে জমির উপরিভাগের উর্বরতা বৃদ্ধি পায়।জমিতে নাইট্রোজেন সার ব্যবহারের পরিবর্তে নাইট্রোজেন সংবন্ধনকারী বিভিন্ন উদ্ভিদ লাগানো হয় যা বায়ুমন্ডলের নাইট্রোজেনকে উদ্ভিদের ব্যবহারোপযোগী করে।

Yale organic farm field

রাসায়নিকের ব্যবহার কমিয়ে জৈব কৃষিব্যবস্থা অনবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারও কমিয়ে দেয়, যা পরিবেশের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। মাটিতে কার্বন আটকে রেখে গ্রীণ হাউস গ্যাস নিঃসরন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রনেও জৈব কৃষিব্যবস্থা দারুন ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন কৃষিব্যবস্থা যেমন নুন্যতম চাষ, আবৃত ফসল এবং পর্যাবৃত ফসলব্যবস্থা, অধিক নাইট্রোজেন সংবন্ধনকারী ফসল ব্যবহার ইত্যাদি মাটিতে কার্বন ও নাইট্রোজেনের পরিমান বৃদ্ধি করে, যা জমির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। এক গবেষণায় দেখা গেছে জৈব কৃষিব্যবস্থায় মাটিতে জৈব কার্বনের পরিমান যত বৃদ্ধি পাবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কৃষির কার্যকারিতাওততটা বৃদ্ধি পাবে।

জৈব কৃষিব্যবস্থায় কৃষকরা একই সাথে সকল স্তরের জীববৈচিত্র্যের রক্ষক ও ভক্ষক। জীন স্তরের প্রেক্ষিতে উল্লেখ করা যায় জৈব কৃষিব্যবস্থায় প্রচলিত এবং অভিযোজিত বীজ এবং প্রজাতি ব্যবহার করা হয় যেগুলো অধিক রোগ প্রতিরোধক্ষম এবং জলবায়ু পরিবর্তনে সহনশীল হয়। প্রজাতি স্তরের প্রেক্ষিতে উল্লেখ করা যায় উদ্ভিদ ও প্রানীর সম্মিলনে সর্বোচ্চ কৃষি উৎপাদনের জন্য পুষ্টি ও শক্তির চক্রায়ন আরো স্থিতিশীল হয়। আর বাস্তুতান্ত্রিক প্রেক্ষিতে উল্লেখ করা যায় জমির অভ্যন্তরে এবং চারপাশের ব্যবস্থাপনা এবং রাসায়নিকের ব্যবহার না হওয়ায় উক্ত অঞ্চলে বন্যপ্রানীর জন্য একটি সুন্দর আবাসস্থল তৈরী হয়। এসকল ব্যবস্থাপনার ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় নতুন নতুন উদ্ভিদ ও প্রানী প্রজাতির আবির্ভাব হয় যেগুলো ফসলের পরাগায়ন ও বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং সেই সাথে ফসলের জন্য ক্ষতিকারক পতঙ্গভক্ষনকারী প্রানীরও আবির্ভাব ঘটে।

org 6

প্রচলিত রাসায়নিক কৃষি ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট এলাকার পানিকে চরমভাবে দূষিত করে ফেলে। কিন্তু জৈব ব্যবস্থায় এই ধরনের সমস্যা থেকে অনেকটাই মুক্তি পাওয়া যায়। রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সারের ব্যবহারের ফলে জমিতে ক্ষতিকর পদার্থের প্রসারন হ্রাস পায়। সাধারনত বিষাক্ত পদার্থ সমূহ মাটি থেকে অনুস্রবনের মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ পানিতে মিশে যায়, যা রাসায়নিক কৃষি ব্যবস্থার একটা অন্যতম ক্ষতিকর দিক। জৈব ব্যবস্থায় এই ধরনের ঝুঁকি অনেকাংশেই হ্রাস পায়। জৈব পদার্থ মাটির সুষ্ঠু গঠনে সহায়তা করে, যার ফলে মাটির গুনগত বৈশিষ্ট্যও পরিবর্তিত হয়।

বাংলাদেশের কৃষকদের মাঝে এসকল তথ্য ছড়িয়ে দেয়া হলে তাদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে, যা তাদের একই সাথে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে উপকৃত করবে। সাধারনত আমাদের দেশে কৃষকদের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রতি সরকারই সারের উপর বিশেষ ভর্তুকি দেয় নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য। তবে একটু সচেতনভাবে বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করলে আমাদের কৃষিখাতের উপর এর দারুন ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে সর্বস্তরের কৃষককে যদি জৈব কৃষি ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি ভালো ধারনা দেয়া যায় তবেই আমরা একটি টেকসই কৃষিব্যবস্থা স্থাপন করতে পারব। যা একইসাথে আমাদের খাদ্যে স্বাবলম্বী করে তুলবে এবং আমাদের পরিবেশকেও সুষ্ঠু ও সুন্দর রাখবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics