
বাংলাদেশে জৈব কৃষিব্যবস্থাঃ পরিবেশ রক্ষায় সম্ভাবনার নতুন দুয়ার
মনিজা মনজুর
ভেবে দেখুন তো! কোন দুটো বিষয় না থাকলে আপনার জীবন–জীবিকা এবং সুস্থতায় ব্যাঘাত ঘটবে? আপনার কাছে কারণ যা ই হোক না কেন! সবকিছুর মূলে বর্তমান সময়ে যে দুটো বিষয় নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তা করা প্রয়োজন তা হলো- জলবায়ু পরিবর্তন এবং খাদ্য নিরাপত্তা। কিন্তু আমরা কয়জন ই বা এ নিয়ে ভাবি? কৃষিনির্ভর সবুজ শ্যামল ছোট্ট বাংলাদেশে এই দুটো সমস্যা মোকাবেলার জন্য সম্ভাবনার নতুন দুয়ারের নাম জৈব কৃষিব্যবস্থা বা অর্গানিক ফার্মিং।
বাংলাদেশে জৈব কৃষিব্যবস্থা বলতে শুধুমাত্র স্বল্পখরচে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করে কৃষিখাতের উন্নয়ন সাধন নয়। এটি মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, জলবায়ুর উপর ক্ষতিকর প্রভাব রোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিভাবে সাহায্য করে জৈব কৃষিব্যবস্থা?
কোনো প্রকার রাসায়নিক উপাদান এবং ক্ষতিকারক কীটনাশক ছাড়াই গোবর এবং ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার ব্যবহার করে মৌসুমী সবজি উৎপাদন করা হচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার দুল্লা ইউনিয়ন এর হরিরামপুর গ্রাম কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর এর সহায়তায় এখন কেঁচো সার উৎপাদনের একটি বড় কেন্দ্রে রূপ নিয়েছে।ধান, গম, ভূট্টা, পাট, আলু, কচু, পেঁয়াজ, মরিচ , চিচিঙ্গা, শসা, শীম, উচ্ছে, পটল, কাঁকরোল প্রভৃতি সবজি উৎপাদনে কেঁচো সার প্রয়োগ করা হয়। এখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা গোবর দিয়ে নিজেরাই তৈরী করছেন পরিবেশ বান্ধব কেঁচো সার।

অন্যদিকে পরীক্ষণীয় প্রকল্প হিসেবে যশোরের পানিগ্রাম রিসোর্টে জৈব কৃষিব্যবস্থায় উৎপাদিত হচ্ছে লালশাক,লেটুস,ব্রকোলি, টমেটো, বেগুন,গাজর, বীট সহ আরো অনেক সবজি।শুধুমাত্র সবজি নয়, অত্যন্ত নিখুঁত পরিকল্পনার মাধ্যমে সবজির পাশাপাশি সারিবদ্ধভাবে বিভিন্ন ফল,মসলা এবং ডাল জাতীয় উদ্ভিদের চাষ করা হয়েছে।

উত্তরাঞ্চলের বোদা এবং কালিগঞ্জ উপজেলায় জনপ্রিয় হচ্ছে জৈব কৃষিব্যবস্থা।এছাড়াও বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য জৈব খামার।কর্মসংস্থান হচ্ছে অনেক মানুষের।
বাংলাদেশের আবাদী জমির ৮৫% ক্রমশ এর উর্বরতা হারাচ্ছে। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইন্সটিটিউট এর মতে,বাংলাদেশের মাটি জৈব পদার্থের পরিমাণ এবং পুষ্টি উপাদানে পর্যাপ্ত নয়। ৮.৩ মিলিয়ন হেক্টর আবাদী জমির মধ্যে প্রায় ৩.৩ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে ইতিমধ্যেই ক্রমবর্ধমান হারে পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। উদ্ভিদের অপরিহার্য ১৭টি রাসায়নিক উপাদানের মধ্যে ১৪টি ই শোষণ করে মাটি থেকে, যা বর্তমানে বাংলাদেশের মাটিতে এখন আর পাওয়া যায় না।সাধারনত, মাটিতে শতকরা ৫% জৈব পদার্থ থাকলে তাকে আদর্শ মাটি বলা হয়।কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে জৈব পদার্থ আছে ১-১.৫% ।সুতরাং মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করতে সার প্রয়োগের বিকল্প নেই এবং তা হতে হবে অবশ্যই পরিবেশবান্ধব।
পরিবেশবান্ধব হতে হবে এই কারণে যে, রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক পরিবেশ- প্রাণীকূল সব ক্ষেত্রেই ক্ষতিকারক।জেনে নেই কিভাবে-
- প্রচলিত রাসায়নিক সার আসে মূলত পেট্রোলিয়াম থেকে।একটি ৪০ পাউন্ডের সারের ব্যাগে প্রায় ২.৫ গ্যালন গ্যাসোলিন থাকে, যা সাধারনত গাড়ির জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর জ্বালানী উৎপাদন মানেই গ্রীন হাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি যা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
- রাসায়নিক নাইট্রোজেন সার ব্যবহারের ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক এর পরিমাণ বৃদ্ধি পায়,সুপেয় পানির উৎস ক্ষতিগ্রস্থ করে, বাস্তুতন্ত্রের স্বাভাবিক নিয়মের ব্যাঘাত ঘটায়।অন্যদিকে, অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ মাটিস্থ অণুজীবের আকস্মিক বৃদ্ধি ঘটায়।যা মাটির জৈব পদার্থ এবং পুষ্টি উপাদান খেয়ে ফেলে উদ্ভিদের উপকারের পরিবর্তে ক্ষতি করে ফেলে।
- রাসায়নিক সার দ্রুত পানিতে মিশে যায়।প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সার উদ্ভিদ মাটি থেকে নেয়ার আগেই পানিতে দ্রবীভূত হয়ে যায়। যার কারণে পরিমাণে অধিক প্রয়োগ করতে হয়, খরচ ও বেশি হয়।
- রাসায়নিক সার লবণাক্ত হয়। অধিক পরিমাণে মাটিতে দিলে উদ্ভিদকোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পানিশূণ্যতা দেখা দেয়। জৈব সার লবণাক্ত নয়।
- অধিক কার্যকরী হওয়ার কারণে রাসায়নিক সার, উদ্ভিদ যতটুকু বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়ার তার চেয়ে অনেক বেশি ওজনের শাখা এবং পাতাযুক্ত হয়, যা উদ্ভিদের মূল কে ক্ষতিগ্রস্থ করে।অন্যদিকে, জৈব সার উদ্ভিদের অতিরিক্ত বৃদ্ধি হতে দেয়না এবং এর ফলে সহজে রোগ বালাই দেখা যায় না।
- পোল্ট্রি ফার্মের বর্জ্য থেকেও জৈব সার উৎপন্ন করা যায়। এটি এক দিক দিয়ে যেমন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ করে, তেমনি কাজ করে ফসল ফলানোর অনন্য উপাদানে।
- এছাড়া কম উৎপাদন খরচ তো আছেই।এতে উৎপাদন খরচ কমে এক-তৃতীয়াংশ আর ফলন বাড়ে ২০-৩০%।
আমাদের দেশে প্রতিটি ফসলের জন্য এক হেক্টর জমিতে ৫-৭ টন জৈব সার প্রয়োজন।আর সম্পূর্ণরূপে এই পদ্ধতি নিয়ে কাজ করতে হলে দরকার ৫-৬ কোটি টন জৈব সার।তাই পরিবেশের বন্ধু হয়ে পাশে থাকতে দ্রুত জৈব কৃষিব্যবস্থার প্রসার হওয়া প্রয়োজন।