পাম চাষ; বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় খাত অথচ এখনো দৃষ্টির আড়ালেই!

মনজুর কাদের চৌধুরী

বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়টা-পাঁচটা ক্লাসের ফাঁকে হঠাৎ ক্লাস বন্ধ ঘোষণা! হয়ে গেলো না চাইতেই অবিরাম অবসর, সময় কাটাতে কাছে কোথাও ঘুরে আসা।সেদিনও এমনই, হঠাৎ করে ক্লাস বাতিল , সাইদুলের সাথে সাথেই প্রস্তাব, চলো কোথাও ঘুরতে যাই!সাইফুল, জুনেদ, পরিতোশ, বাছিত, পপি, চামেলি, শতাব্দী, সান্দ্রা, ঊর্মি, শান্তা, প্রান্ত সহ সবাই রাজি। উদ্দ্যেশ্যহীনভাবে ইকোপার্কের দিকে হাঁটা শুরু। প্রকৃতির মাঝে হাঁটতে হাঁটতে শেভরনের পাশের পরিষ্কার পানির ছড়ায় পা ভেজালাম। উত্তরদিকে চা বাগান,সবুজের কারখানা। দু-তিনবার এদিকে সবাই গিয়েছি। এবার তাই অজানা দক্ষিনদিকে হাঁটা দিলাম। চা বাগান এ দিকেও! পাঁচ মিনিট হাঁটার পর অবাক! একি! এতো সুন্দর!

1

নাম না জানা কিসের গাছ! ভাবলাম পাহাড়ি সাইকাস মনে হয়, কিন্তু একটু হাঁটতেই দেখি বিশাল বাগান! সবুজের সমারোহ। শীতের এই শেষ সময়েও ছিল গাঢ় সবুজ। এখন আর চিনতে ভুল হল না। এ যে পাম গার্ডেন, আধুনিক মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক বিপ্লবের মূল হাতিয়ার!

এক বিজ্ঞ বৃদ্ধ লোকের মাধ্যমে জানতে পারলাম… খাদিম টি স্টেট করেছে বাগানটি। চার পাঁচ বছর হয়েছে গাছ লাগানোর। এরই মধ্যে ফল চলে এসেছে। মালয়েশিয়ায় যেখানে লাগে আট বছর, সেখানে সিলেটে মাত্র চার বছর!

সিলেটের পাহাড়ি মাটি এদের জন্য খুবই ভালো। এক পাম উৎপাদন করেই আমাদের সিলেটের তথা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিপ্লব অসম্ভব নয়। দরকার বিনিয়োগ। কানাইঘাট,গোলাপগঞ্জ , মৌলভীবাজারের পরিত্যাক্ত টিলাগুলোতে লাগানো যায় পাম গাছ। একদিকে অর্থনৈতিক উন্নতি অন্যদিকে অক্সিজেনের কারখানা স্থাপনও হল।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বর্তমান ভোজ্য তেলের চাহিদা প্রায় ১২ লক্ষ মেট্রিক টন। দেশের চাহিদার মাত্র শতকরা ১০ ভাগ তেল দেশে উৎপাদিত হয় বাকি শতকরা ৯০ ভাগ তেলের জন্য বিদেশের উপর নির্ভর করতে হয়। দেশে পাম ও সয়াবিন তেল আমদানি করে প্রতি বছর যে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করা হয় যদি পর্যাপ্ত পাম চাষ করা হয় তাহলে ১২,০০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় সম্ভব। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও প্রকৃতি পাম চাষের উপযোগি। মালয়েশিয়ায় উৎপাদিত পামের কাঁদি সাধারণত ৪০ কেজির বেশি হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে উৎপাদিত কাঁদির ওজন ৬০ কেজি থেকে ৬৫ কেজি পর্যন্ত পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে উৎপাদিত পামের ফল তুলনামূলক আকারে বড় এবং দানা তুলনামূলক ছোট। পাম থেকে তেল উৎপাদনের মাত্রার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার চেয়ে এগিয়ে। অথচ, বিশ্বের শতকারা ৮০ ভাগ পাম তেল উৎপাদন করে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া।

সদ্য আহরিত পাম তেল বিটা ক্যারোটিনের সমৃদ্ধতম উৎস। পাম তেলে টোকোফেরল ও টোকোট্রায়েনল নামক দুই ধরনের ভিটামিন ‘ই’ অধিক পরিমাণে থাকে। অন্যান্য উদ্ভিজ্জ ভোজ্য তেলের মত পাম তেলও কোলেস্টেরলমুক্ত। কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল খাদ্যে পাম তেল ব্যবহার করলে রক্তে মোট কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ে না। পাম তেল খাদ্যে ব্যবহার করলে দেহে উপকারি ‘এইচ.ডি.এল.’ কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ে এবং ক্ষতিকর ‘এল.ডি.এল.’ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে যায়। পাম তেল রক্তের জমাট বাঁধার প্রবণতা হ্রাস করে, ফলশ্রুতিতে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস পায়। লাল পাম তেলে প্রচুর পরিমাণে বিটা ক্যারোটিন এবং ভিটামিন ‘ই’ থাকে, যা গাজরের চেয়ে ১৫ গুন এবং টমেটোর চেয়ে ৩০০ গুণ বেশি। লাল পাম তেল ক্যারোটিনয়েডের উৎস হওয়ায় কয়েক ধরনের ক্যান্সারকে কার্যকরভাবে প্রতিহত করতে পারে। পাম তেল এবং একই পরিমাণ ক্যালরিযুক্ত অন্য ভোজ্য তেল সম্বলিত খাদ্যের সাথে তুলনা করে দেখা গেছে যে পরীক্ষামূলকভাবে ঘটানো স্তন ক্যান্সারের সংঘটন ও বিকাশ উভয় ক্ষেত্রেই পাম তেল প্রতিরোধমূলক ভূমিকা পালন করে। যুক্তরাষ্ট্র্য ও যুক্তরাজ্যের আদর্শ পরিমাপ অনুযায়ী ভোজ্য তেলের মধ্যে ৫০ পি.পি.এম. পর্যন্ত কোলেস্টেরল থাকলে তা ‘কোলেস্টেরল মুক্ত’ তেল হিসেবে বিবেচিত হয়। পাম তেলের কোলেস্টেরল ৫০ পি.পি.এম. এর নিচে যা (১৩-১৯) পি.পি.এম. এর মধ্যে। অপরপক্ষে সয়াবিন তেলে (২০-৩৫) পি.পি.এম. সূর্যমুখী তেলে (০৮-৪৪) পি.পি.এম.এবং সরিষার তেলে (২৫-৮০) পি.পি.এম. কোলেস্টেরল বিদ্যমান। চীনে পাম তেল, সয়াবিন তেল, পিনাট তেল এবং শুকরের চর্বি (সবগুলোই সম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত) নিয়ে এক তুলনামূলক গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে এদের মধ্যে পাম তেল দেহে উপকারি ‘এইচ.ডি.এল.’কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায় এবং ক্ষতিকর ‘এল.ডি.এল.’ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়।
 3
পরিশোধিত পাম তেল গন্ধহীন হওয়ায় এর দ্বারা ভাজা-পোড়া খাদ্যেও স্বাভাবিক গন্ধ বজায় থাকে। পাম তেল অর্ধজমাট ঘনত্বে থাকার জন্যে এমন কিছু গুণ ধারন করে যা অনেক খাদ্য প্রস্তুতিতে প্রয়োজন হয়। পাম তেল ভোজ্য তেল ছাড়াও বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়। সাবান, ডিটারজেন্ট, ফ্যাটি এসিড, ফ্যাটি এ্যলকোহল, গ্লিসারল উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। বিস্কুট, কেক, আইসক্রীমসহ বিভিন্ন প্রকার খাবার তৈরিতে পাম তেলের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। চর্বি উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে পাম তেল সকলের পছন্দনীয়। পাম তেল থেকে তৈরি হয় সলিড ফ্যাট যেমন বনস্পতি যা স্বাস্থ্যের জন্য উত্তম কারণ পাম তেলকে হাইড্রোজিনেশন করার প্রয়োজন হয় না বলে এতে ক্ষতিকর ট্রান্স ফ্যাটি এসিড থাকে না। পাম গাছের কাণ্ড, পাতা, ফলশূন্য কাঁদি ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রকার দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করা যায়।

পাম গাছের পাতা ও ফলশূন্য কাঁদির আঁশকে প্রক্রিয়াজাত করে মধ্য ঘনত্বের ফাইবার বোর্ড ও চিপবোর্ড তৈরি করা যায়। পাম গাছের গুঁড়ি থেকে চমৎকার আসবাবপত্র তৈরি করা যায়। পাম গাছের পাতা মাটিতে জৈব পদার্থ যোগ করে। ১ টন পাম গাছের পাতা মাটিতে প্রায় ৭.৫ কেজি নাইট্রোজেন, ১.০৬ কেজি ফসফরাস, ৯.৮১ কেজি পটাশিয়াম ও ২.৭৯ কেজি ম্যাগনেশিয়াম যোগ করে ।

সারা বাংলাদেশে পাম তেলের চাষ ছড়িয়ে দিতে সরকারকে প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে এবং বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে চাষাবাদ শুরু করতে হবে। গণমাধ্যমকে প্রচারের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি সবাইকে পাম গাছ চাষ সম্পর্কে ধারণা দিয়ে পাম চাষের প্রসার ঘটাতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের এবং পাবর্ত্য এলাকার উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন যে সব রস্তা আছে সে রাস্তার দু’পাশে পাম গাছ লাগানো যেতে পারে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মন্দির ও হাসপাতালের অব্যবহৃত জায়গায়ও পাম চাষ করা যায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনাবাদি পতিত জমি, পাহাড়ি অঞ্চল, চরাঞ্চল ও উপকূল অঞ্চলে বৃক্ষরোপণ অভিযানের মাধ্যমেও পাম চাষ করা যায়।

দিনাজপুরের হাজী দানেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১টি, ঘাটাইলের রামজীবনপুরে ২টি এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৩টি গাছের সবকটিতে ফল আছে। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিলেট অঞ্চলের কথা বিবেচনা করে এটা নিয়ে গবেষণা করা উচিত।

বিদেশি বিনিয়োগ হলে পাম চাষ করেই অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটাতে পারে আমাদের বাংলাদেশ। আমাদের মাটি সোনার চেয়েও খাঁটি এটা প্রমাণ তো করতে হবে!

লেখক,
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics