ধরিত্রী রক্ষায় প্যারিস চুক্তি
বিশ্ব ধরিত্রী দিবসের প্রাক্কালে জাতিসংঘ সচিবালয়ে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বিশ্বের ১৫৫টি দেশ জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত বহুল প্রতীক্ষিত প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, গত ১২ ডিসেম্বর প্যারিসে বিশ্বের ১৯৫টি দেশ এ চুক্তিতে উপনীত হয়। বিশ্বের প্রধান কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো অর্থাত্ কার্বন নিঃসরণের ২০ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশের জন্য দায়ী চীন, ১৭ দশমিক ৮৯ শতাংশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ৭ দশমিক ৫৩ শতাংশের জন্য দায়ী রাশিয়া এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও বিশ্বের উদীয়মান কার্বন নিঃসরণের দেশ (৪.১%) ভারত এখনো স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত নেয়নি। প্যারিস চুক্তির শর্তানুযায়ী বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের ৫৫ শতাংশের জন্য দায়ী কমপক্ষে ৫৫টি রাষ্ট্র এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেই এটি কার্যকারিতা পাবে। তবে যেহেতু চুক্তিটি আইনি কাঠামোয় থাকবে তাই চুক্তিতে স্বাক্ষরের পর সংশ্লিষ্ট দেশের পার্লামেন্টে চুক্তি উপস্থাপন করে তার অনুমোদন নিতে হবে। তবে বিশ্বের পরিবেশবাদী সংগঠন দাবি করেছিল যে, স্বল্পোন্নত দেশগুলো যেন প্যারিস চুক্তি পরবর্তী আলোচনায় নিয়ন্ত্রণ, উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি পূরণ বিশেষ করে ২০২০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদান করার পরই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
যদিও প্যারিস চুক্তির আর্টিকেল ২-এ প্রাক-শিল্পায়ন সময়ের তুলনায় বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা এবং ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য কাজ করার কথা বলা হয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো, গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন বন্ধের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়নি। বলা হয়েছে, সব দেশ ‘গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন সর্বোচ্চ অবস্থায় নিয়ে যাবে যত দ্রুত সম্ভব (আর্টিকেল ৪.১)।’ এ অনিশ্চয়তা থেকেই বিশ্বের প্রধান বিজ্ঞানী ও নাসার সাবেক গবেষক জেমস হ্যানসেন মনে করেন, ‘এটা প্রকৃতপক্ষে প্রতারণা, একটা ভুয়া মন্তব্য; যারা বলে আমরা বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড কমানোর টার্গেট করেছি এবং প্রতি পাঁচ বছরে সামান্য পরিবর্তনের চেষ্টা করব— এটা একটি অর্থহীন মন্তব্য, কোনো ধরনের বাস্তব পদক্ষেপ নেই, শুধুমাত্র প্রতিশ্রুতি ছাড়া। যতক্ষণ পর্যন্ত জীবাশ্ম জ্বালানি সবচেয়ে সস্তা জ্বালানি হিসেবে বাজারে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার ব্যবহার হবেই।’ জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত বৈশ্বিক সচেতনতা তৈরিতে সর্বপ্রথম ১৯৮৮ সালে তিনিই যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসনাল কমিটিকে প্রায় ৯৯ শতাংশ সুনিশ্চিতভাবে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের মাধ্যমে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কথা জানান।
প্যারিস চুক্তিতে চূড়ান্তভাবে এ শতাব্দীর দ্বিতীয়ভাগের কোনো সময়ে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন ‘নেট জিরো’তে নিয়ে যাওয়ার জন্য কার্বন নির্গমনের পরিমাণ শুষে নেয়ার সক্ষমতাসম্পন্ন বনভূমি সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হলেও ফ্রেন্ডস অব দি আর্থের প্রতিনিধি লুসি ক্যাডেনা বলেছেন, ‘উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে থাকার ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি। বিস্ময়করভাবে এ চুক্তিপত্র অনুযায়ী ২০৯৯ সাল পর্যন্ত কার্বন নির্গমন চালিয়ে যাওয়া যাবে।’ চুক্তিতে দেশভিত্তিক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সময়ভিত্তিক সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ (এনডিসি) প্যারিস চুক্তিপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এমনকি চুক্তির প্রাথমিক খসড়ায় বেশ কয়েক জায়গায় দেশগুলোকে ‘করতে হবে’ (Shall) বলা হলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে ‘করা উচিত’ (Should) দিয়ে দুর্বল করা হয়েছে বাধ্যবাধকতার বিষয়টি। দুর্ভাগ্যজনক হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের দায় স্বীকার করে ১৯৯৭ সালের কিয়োটো চুক্তির মাধ্যমে এনেক্স-১ভুক্ত হিসেবে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করলেও ইউএনএফসিসির আর্টিকেল ২.২ ‘(দেশগুলো) তাদের ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় পরিস্থিতির আলোকে দায়িত্ব পালন করবে’ ব্যবহার করে প্যারিস চুক্তিতে কোনো সুস্পষ্ট সীমারেখা না দিয়ে শুধু উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ বলে সে দায় এড়িয়েছে। ফলে প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হলো, আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগও রুদ্ধ হলো। প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার একটি বৈশ্বিক কাঠামো প্রণয়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও আইনি বাধ্যবাধকতার বিষয়টি অস্পষ্ট থাকায় বৈশ্বিক তাপমাত্রা কমানো ও প্রতিশ্রুত তহবিল প্রদানের বিষয়টি উন্নত দেশগুলোর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরই নির্ভর করবে।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন যে, প্রাক-শিল্পায়ন সময়ের তুলনায় বৈশ্বিক তাপমাত্রা মাত্র ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে গেলে অবিলম্বে সব জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার ব্যাপক হারে কমিয়ে বিকল্প উত্স থেকে উত্পাদন করতে হবে। উল্লেখ্য, ময়লা জ্বালানি কয়লা ব্যাপক কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী হলেও ২০০৭ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ওইসিডিভুক্ত শিল্পোন্নত দেশগুলো বিশেষ করে জাপান, চীন, ভারত, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া শুধু কয়লাভিত্তিক শিল্পে প্রায় ৭৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে শুধু জাপান প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত জীবাশ্ম জ্বালানির দাম বিকল্প জ্বালানির চেয়ে আর্থিকভাবে সস্তা থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত বৈশ্বিক তাপমাত্রা কমানোর লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবে অর্জিত হওয়া দুরূহ হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রতি টন কার্বন নিঃসরণের বিপরীতে বাজার ব্যবস্থায় ‘দূষণ ফি’ ধার্য করে জীবাশ্ম জ্বালানি বিশেষ করে কয়লাভিত্তিক শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ রয়েছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতি বছর ‘দূষণ ফি’ ১০ ডলার করে বৃদ্ধির মাধ্যমে বছরে ৬০০ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা সম্ভব। আর বিশ্বব্যাপী উন্নত ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোয় এ ফি ধার্য করা হলে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার আদায় করা সম্ভব। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বৈশ্বিকভাবে জলবায়ু পরির্বতন মোকাবেলা করতে হলে প্রতি বছর গড়ে মাত্র ১ ট্রিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। কীভাবে প্যারিস চুক্তি-পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, তার পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। যেহেতু এ চুক্তি ২০২০ থেকে কার্যকর হবে সুতরাং এটি বাস্তবায়নের যে ভবিষ্যত্ কৌশল নির্ধারিত হবে, তাতে এ ধরনের প্রস্তাব গ্রহণের জন্য কয়েক বছর সময় থাকায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর যৌথভাবে জোরালো অবস্থান গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।
উল্লেখ্য, উপকূলীয় বন্যা, তীরভাঙন ও কৃষিতে বিপর্যয়ের প্রভাবে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের প্রায় ২ কোটি ৭ লাখসহ বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৫ কোটি মানুষ জলবায়ুতাড়িত বাস্তুচ্যুত-শরণার্থী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সর্বশেষ এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগে ১৯০০-২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে, যার ৪০ শতাংশ হয়েছে বন্যাজনিত কারণে। ক্ষতির শিকার হওয়া ও ঝুঁকির মুখে থাকা বাংলাদেশসহ দ্বীপরাষ্ট্র ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলো ক্ষতিপূরণ প্রদানের যে প্রতিশ্রুতি ১৯৯২ সালে বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলনে দিয়েছিল, প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে সে দায় এড়িয়ে গেছে। অথচ জলবায়ুতাড়িত বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীকে বিশ্ববাণিজ্য চুক্তির মোড-৪-এর আওতায় সর্বজনীন ‘প্রাকৃতিক ব্যক্তি’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের পুনর্বাসন, কল্যাণ ও উন্নয়নে কানকুন চুক্তি ২০১০-এর আলোকে নীতিমালা প্রণয়ন এবং জিসিএফ ও অন্যান্য উত্স থেকে অভিযোজন বাবদ প্রয়োজনীয় তহবিল বরাদ্দের বিশ্বব্যাপী দাবি ছিল।
কোপেনহেগেন চুক্তির আওতায় শিল্পোন্নত দেশগুলো কর্তৃক দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অভিযোজন ও প্রশমন বাবদ ২০২০ সাল নাগাদ প্রতি বছর উন্নয়ন সহায়তার ‘অতিরিক্ত’ ও ‘নতুন’ হিসেবে ১০০ বিলিয়ন ডলার, যা পরবর্তীতে ২০৩০ পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি ছিল; কিন্তু প্যারিস চুক্তিতে সে ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। শুধু তাই নয়, চুক্তির ৯.৩ অনুচ্ছেদে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হলেও শুধু কার্যকর প্রশমন ও বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যয় এবং আর্টিকেল ৯-এর প্যারা ৪-এ অভিযোজন বাবদ অনুদানভিত্তিক সরকারি অর্থায়নের কথা বলা হলেও বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর অগ্রাধিকার অভিযোজনের জন্য কী পরিমাণ তহবিল, কোন খাত থেকে কে, কখন, কীভাবে দেবে (ঋণ বা অনুদান), তা সুনির্দিষ্ট করে জলবায়ু তহবিলের কোনো সর্বজনীন সংজ্ঞা বা রূপরেখা নির্ধারণ করা হয়নি। অথচ প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী, ২০৩০ সাল পর্যন্ত শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু তহবিল বাবদ প্রায় ৩ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। ২০১৪ সালে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউনেপ) প্রকাশিত তথ্য অনুসারে বিশ্বব্যাপী শুধু অভিযোজনের জন্য ২০২৫ সাল নাগাদ প্রতি বছরে কমপক্ষে ১৫০ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ওইসিডিভুক্ত দেশগুলো ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ পর্যন্ত প্রায় ৬২ বিলিয়ন ডলার প্রদানের কথা বললেও ভারত দাবি করেছে, এর পরিমাণ মাত্র ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার; প্রতিশ্রুতির তুলনায় শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলো মাত্র ১০ শতাংশ তহবিল ছাড় করেছে। তবে এটা স্পষ্ট যে, প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে শিল্পোন্নত দেশগুলো বিকল্প জ্বালানি উত্পাদনের প্রযুক্তি ও মূলধন বাবদ ঋণ সরবরাহের মাধ্যমে তাদের অর্থনীতি চাঙ্গা করার সুযোগ পেয়েছে। উল্লেখ্য, এখন পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় যে তহবিল বরাদ্দ করা হয়েছে, তার মধ্যে প্রধান উত্স হলো, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত ঋণ (পিপিসিআর তহবিল), যা বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে মানবিক আবেদনকে প্রাধান্য না দিলে বিশ্বের প্রকৃত বিপর্যয় অনুমানের চেয়েও বেশি হবে এবং যার প্রধান শিকার হবে সমাজের দরিদ্র ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
এম. জাকির হোসেন খান
পরিবেশ, জ্বালানি ও জলবায়ু অর্থায়ন নীতি বিশ্লেষক
লেখাটি দৈনিক বণিক বার্তায় ২২-০৪-২০১৬ তে প্রকাশিত