আবর্জনা থেকে খাবার, বিদায় বলুন খাদ্য অপচয়কে !
সিফাত তাহজিবা
পড়াশোনার জন্য ৫ বছর হয়ে গেল ব্রিটেনে থাকে রাফসান, প্রতিদিনই এলার্মের সাউন্ডে ঘুম ভাঙা আর নাস্তা না করেই কোনরকমে কাপড়টা গায়ে চাপিয়ে দৌঁড়তে দৌঁড়তে ক্লাসে যাওয়া অভ্যাস হয়ে গেছে। এখানে তো আর মা নেই যে নাস্তা না করার জন্য বকবে বা হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলবে ক্যান্টিন থেকে খেয়ে নিস!
ব্রিটেনের ব্যস্ত রাস্তার ফুটপাত দিয়ে রাফসান হাঁটছে, যানজট বিহীন ফাঁকা রাস্তা সাথে হালকা বাতাস, হুডিটা আরেকটু উঠিয়ে নিল সে, হেডফোনে চলতে থাকা তার প্রিয় লিনকিন পার্কের ‘হোয়াট আই হ্যাভ ডান’ এর সুরের তালে তালে পা ফেলছে। হঠাৎ করেই একটা দৃশ্য চোখে পড়ল তার। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। এরপর আর সেদিন তার ক্লাসে যাওয়া হল না। মন খারাপ করে ডর্মে ফিরে এল,বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে বাংলাদেশে থাকা তার বন্ধু তালহাকে ফোনে পেল। জানতে পারল সেখানেও একই অবস্থা ! রাফসানের আজ মন ভাল নেই। নাহ ! কিছুই ভাল লাগছে না।
পাঠক, নিশ্চয়ই আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করছেন রাফসান কী দেখেছিল?
হ্যাঁ, সে দেখেছিল কিভাবে খাদ্য অপচয় করা হচ্ছে, ক্ষুধার বিশ্বে এক টুকরো রুটি কিংবা এক মুঠো ভাতের জন্য যেখানে হাহাকার, সেখানে একই বিশ্বের এক প্রান্তে কিভাবে একটার পর একটা বড় ঝুড়িতে করে ফেলে দেওয়া হচ্ছে আপেল, কমলা, ইয়গার্ট, পনির। সারা বিশ্বে প্রতি বছর খাদ্যদ্রব্যের এক তৃতীয়াংশ আস্তাকুড়ে এভাবেই নিক্ষেপ করা হয়, সেই সাথে হয় পরিবেশ দূষণ! পাইকারি বাজারগুলো থেকে প্রতিদিনই পচনশীল খাদ্য সবজি, ফলমূল যা অবিক্রীত রয়ে যায় তা ছুঁড়ে ফেলা হয় ডাস্টবিনে।
কেননা, সেগুলো সংরক্ষণের জন্য অত্যাধুনিক কোন পদ্ধতি এখনো আবিষ্কার হয়নি। শুধু কি পাইকারী বাজার? আমাদের প্রায় সব বাসা-বাড়িতেই আধ খাওয়া খাদ্যদ্রব্য ফেলে দেওয়া হয়। আর আমার, আপনার সেই আধ খাওয়া রুটির টুকরো কিংবা ফেলে দেওয়া ভাতের সন্ধানে কুকুর, বিড়ালের সাথে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের দেখা যায় ডাস্টবিনে আশেপাশে। এটি খুবই পরিচিত একটা দৃশ্য আমাদের দেশে। ব্রিটেন, জার্মানী, ফ্রান্সের মত উন্নত দেশগুলোতে এই দৃশ্য দেখা না গেলেও মানুষের অপচয়ের এই উদ্ভট গুণটি কিন্তু আছে! উপরের গল্পটা কাল্পনিক হলেও এই রাফসানের মত অনেকেই আছে যারা খাদ্য অপচয়ের বিরুদ্ধে কিছু একটা করে দেখাতে চান।
যেমনটা করে দেখালেন অ্যাডাম স্মিথ, যিনি কিনা অস্ট্রেলিয়ার একটি ফার্মে ১ বছর কাজ করেছিলেন। খাদ্য অপচয়টা একদম কাছে থেকে দেখার পর আর থাকতে পারলেন না, সেখানেই ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে মেলবোর্নে ফেলে দেওয়া এরুপ ফলমূল আর সবজি, রুটি দিয়ে বিনামূল্যে খাবার তৈরি করে খাওয়ালেন পথের মানুষদের ! এই চমৎকার ভাবনা নিয়েই চলে এলেন ব্রিটেনের নিজ শহর লীডস এ, যোগাযোগ করলেন দু’জন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের সাথে; স্যাম যোসেফ ও কোনর ওয়ালশ, যারা কিনা সুপারমার্কেটগুলোর খাদ্যদ্রব্য অপচয় রোধে বেশ কয়েক বছর ধরেই কাজ করে আসছিলেন। ৩ জন মিলে একটি প্রজেক্ট দাঁড় করালেন এবং নাম দিলেন ‘The real junk food project’ । সাথে স্থানীয় বাসিন্দা, পরিবার আর বন্ধু-বান্ধবের সহযোগিতাও যোগাড় করে ফেললেন।
তাঁদের অনবদ্য শ্রম, নিষ্ঠা আর মেধার ফসল ‘PAYF café’ যেটি চালু করা হয় ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে। ক্যাফের অনেকগুলো ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ঠ্য রয়েছে, একটিতো ক্যাফের নামেই শোভা পাচ্ছে! ‘PAYF café ‘র মানে হলো ‘Pay as you feel’! Pay as you feel -এই ধারণাটি অবশ্য তিনি নিয়েছেন মেলবোর্নের ‘Soul Kitchen’ যেটির মালিক বিশ্ব বিখ্যাত গায়ক জন বন জোভি!
ক্যাফেটির খাবারগুলো সবই তৈরি করা হয় ব্রিটেনের বিভিন্ন বাসাবাড়ি, রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে, পাইকারী বাজার, সুপারমার্কেট থেকে বিশাল বিশাল ট্রাকে করে ফেলে দেওয়া খাদ্যদ্রব্য থেকেই! ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল, এর মধ্যেই এ প্রজেক্টটির অধীনে কর্মরত স্বেচ্ছাসেবকরা শুধুমাত্র ব্রিটেনেই ৪৭টি ক্যাফে দিয়েছেন, যার সবগুলোর খাবার তালিকা তৈরি হচ্ছে অপচয় করা বা ফেলে দেওয়া সবজি, ফলমূল থেকে উদ্ধারকৃত খাবার থেকেই! আমেরিকার MUNCHIES ওয়েবসাইটে দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্মিথ বলেন প্রথমে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল শুধুমাত্র মানুষকে খাওয়ানো কিন্তু এখন সেটার সাথে যুক্ত হয়েছে পরিবেশ সংক্রান্ত কিছু কাজও! নামকরা রেস্টুরেন্টগুলোও এখন তাঁদের খাবার সরবরাহ করছে, প্রতি সোমবার তারা Nando’s এ গিয়ে মুরগি নিয়ে আসেন যেগুলো হয়তো Nando’s থেকে ফেলে দেওয়া হত!
ক্যাফের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল এখানে এসে যে কেউ চাইলেই নিজ হাতে নিজের পছন্দমত খাবার বানাতে পারবে।
আল-জাজিরার পরিবেশবিষয়ক টিভি শো ‘Earthrise’ এর প্রযোজক রাসেল বিয়ার্ড ব্রিটেনের এই তরুণ উদ্যোক্তার ক্যাফেটির উপর একটি ভিডিও ক্লিপ প্রকাশ করেন। পাঠক দেখে নিন ক্লিপটি, আপনার মূল্যবান ৮ মিনিট সময় ব্যয় হবে। হয়তোবা আমাদের দেশেও খাদ্য অপচয়ের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদী কন্ঠ জেগে উঠবে খুব শীঘ্রই।