কীটনাশক বনাম মৌমাছি

দিব্য কান্তি দত্ত

মধু কিন্তু অনেকেরই প্রিয়। তবে ইদানিং এই মধু সংগ্রহ করতে মৌমাছিকে কি পরিমাণ সংগ্রাম করতে হচ্ছে সে খোঁজ কিন্তু আমরা কেউই রাখিনা বললেই চলে। গত ফেব্রুয়ারীতেই “বিষাক্ত গ্যাসের কাছে হেরে যাবে মৌমাছি?” শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল এনভায়রনমেন্টমুভের ওয়েবসাইটে। সেখানে বিভিন্ন জীবাশ্ম জ্বালানী বিশেষভাবে ডিজেলের কথা বলা হয়েছিল, যাদের দহনের ফলে নির্গত গ্যাস ফুলের গন্ধ বিশ্লেষণ করে মৌমাছির ফুল চিহ্নিত করার ক্ষমতা ধ্বংস করে দিচ্ছে। এর ফলে প্রভাবিত হচ্ছে পরাগায়ন যা কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনের মাত্রা আশংকাজনক হারে কমিয়ে দিচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার গবেষণায় বের হয়ে এসেছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। ইউরোপে কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত ৫৭ টি কীটনাশক নির্ণয় করা হয়েছে যা মৌমাছির শরীরে বিষক্রিয়া ঘটাচ্ছে! ‘জার্নাল অব ক্রোমাটোগ্রাফি’তে প্রকাশিত এক নিবন্ধ থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রে অনেকটা আচমকাই মৌমাছির সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে ‘বসতি পতন বিশৃঙ্খলা (সিসিডি)’ নামক একটি সমস্যাকে। এর ফলে সেখানে ফসলের উৎপাদন আশংকাজনক হারে কমে গেছে এবং কৃষকেরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। ‘সিসিডি’ এর পূর্ণরুপ হল ‘কলোনী কোল্যাপস ডিসঅর্ডার’। যখন একটি কলোনীর অধিকাংশ কর্মী মৌমাছি রাণী মৌমাছি এবং অপরিণত মৌমাছিগুলোর প্রতিপালনের জন্য পর্যাপ্ত খাবার ও কিছুসংখ্যক পরিচর্যাকারী মৌমাছি রেখে বাসস্থান ত্যাগ করে তখন তাকে ‘কলোনী কোল্যাপস ডিসঅর্ডার’ বলে। গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে কীটনাশকের সাথে মৌমাছির মৃত্যুর সম্পর্ক। এর ফলে ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন’ নিওনিকোটিনয়েড কীটনাশকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।

bee_2628849b

তবে শুধুমাত্র দুই-একটি কীটনাশক নিষিদ্ধ করার দ্বারা মৌমাছির সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কীটনাশকের সাথে মৌমাছির জীবনচক্রের সম্পর্ক অনেক জটিল এবং আসলে কীটনাশকের কোন দিক মৌমাছির জীবনচক্রকে প্রভাবিত করছে তা নির্ণয় করার জন্য বিজ্ঞানীরা এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। নতুন এ সমীক্ষার জন্য পোল্যান্ডের ‘জাতীয় পশুচিকিৎসা গবেষণা প্রতিষ্ঠান’ একইসাথে ২০০ টি কীটনাশক বিশ্লেষণ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে, যাতে করে মৌমাছিদের আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণটি নির্ণয় করা যায়। পোল্যান্ডের ‘জাতীয় পশুচিকিৎসা গবেষণা প্রতিষ্ঠান’ থেকে প্রকাশিত গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক থমাজ কিলজানেক বলেন, “মৌমাছির স্বাস্থ্য একটি জনউদ্বেগের বিষয়। মৌমাছিকে পরিবেশ এবং কৃষির জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় কারণ, ইউরোপে প্রায় ৮০ শতাংশ শস্য এবং বন্য গাছপালার পরাগায়ন হয়ে থাকে মৌমাছির দ্বারা”। বৈশ্বিকভাবে পরাগায়নের আর্থিক মূল্য ধরা হয় প্রায় ১৫৩ বিলিয়ন ইউরো! তিনি আরও বলেন, “আমরা ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন’ কর্তৃক বর্তমানে অনুমোদিত কীটনাশকগুলো পরীক্ষা করে দেখার জন্য একটি পদ্ধতি প্রণয়ন করেছি যার দ্বারা আমরা নিশ্চিত হতে পারব, আসলে কোন উপাদান মৌমাছির শরীরে বিষক্রিয়া ঘটাচ্ছে”।

bee

বর্তমানে ব্যবহৃত সব কীটনাশকের ভিতর এটা খুঁজে বের করা সত্যিই দুঃসাধ্য যে কোনটি মৌমাছিকে প্রভাবিত করছে- কিছু রাসায়নিক উপাদানের মিশ্রণ নাকি দীর্ঘ সময় ধরে এর ব্যবহার। আসলে কি ঘটছে তা বোঝার জন্য মৌমাছির শরীরে কোন কীটনাশকের কোন উপাদান কত ঘনমাত্রায় রয়েছে তা জানা প্রয়োজন। কিলজানেক এবং তার দল ‘QuEChERS’ নামের একটি পদ্ধতি ব্যবহার করছেন যা বর্তমানে খাবারে কীটনাশক নির্ণয় করতে ব্যবহৃত হচ্ছে।  এই পদ্ধতি ব্যবহার করে তারা একইসাথে মৌমাছির শরীরে ২০০ টি পর্যন্ত কীটনাশকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সক্ষম এবং একইসাথে কীটনাশক ভেঙে নতুন কোন যৌগ প্রস্তুত হলে তা নির্ণয় করতেও সক্ষম। ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন’ অন্তর্ভূক্ত দেশগুলোতে ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত কীটনাশকগুলোর ৯৮ শতাংশ তারা এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা করেছেন। এছাড়া তারা ৭০ টি মৌমাছির বিষক্রিয়ার ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। এর মাধ্যমে তারা মৌমাছির শরীরে ৫৭ টি কীটনাশকের উপস্থিতি সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের মতে, বিষক্রিয়ার ধরন একটি গোলকধাঁধার সৃষ্টি করেছে। তারা আশা করছেন এই পদ্ধতির মাধ্যমে তারা এই সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হবেন।

কিলজানেক বলেন, “মৌমাছির স্বাস্থ্যের ওপর কীটনাশকের প্রভাব নিয়ে এটি আমাদের গবেষণার শুরু মাত্র। অল্প পরিমাণে হলেও কীটনাশকগুলো মৌমাছির সুরক্ষা ব্যবস্থাকে নষ্ট করে দিতে পারে। এর ফলে অন্যান্য পরজীবি অথবা ভাইরাস মৌমাছির জোটকে ধ্বংস করে ফেলবে। আমাদের গবেষণা মৌমাছির ওপর কীটনাশকের প্রভাবের মাত্রা বুঝতে সাহায্য করবে এবং পরবর্তীতে কীটনাশকে রাসায়নিক পদার্থের মাত্রা কতখানি হলে কিংবা তা কত মাত্রায় ব্যবহৃত হলে মৌমাছির জন্য ক্ষতিকর হবে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে সাহায্য করবে”।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics