ঘাগরা শাকে মৃত্যুর হাতছানি

জায়েদ ফরিদ

ঘাগরা গাছ যত্রতত্র জন্মে। জলের ধারে, রেল সড়কের পাশে, পতিত, মাঠান সব জায়গাতেই এর বিস্তার কম বেশি। বংশবিস্তারের জন্যে এর বীজ বিসরণ প্রক্রিয়া বেশ মজার। শুধু যে কাপড়ে আর রোমশ পশুর গায়ে লেগে যায় তার কাঁটাফল তা নয়, বিভিন্ন কৃষিযন্ত্র, লাঙ্গল জোয়াল মইতেও লেগে থাকে এরা। শুকনো বীজ জলে ভেসে চলে যায় দূর দূরান্তরে। আর এভাবে এক জমি থেকে আরেক জমি, এক দেশ থেকে আরেক দেশে দর্পে নেচে নেচে চলে যায় ঘাগরা।

অনায়াশে ঘাগড়ায় লেগে যায় বলে হয়তো ঘাগরা নাম হয়েছে অথবা হয়তো এর বীজের ভেতর ঘাগরার রূপ কল্পনা করেছে মানুষ। যাই হোক এর আরেকটি যুক্তি সঙ্গত নাম হল, ছোট গোক্ষুর। গোক্ষুর সাপের নাম, কারণ তার ফণায় গোরুর ক্ষুরের ন্যায় চিহ্ন দেখা যায়। পুষ্ট ঘাগরা বীজের মুখটা ফারা, দ্বিখণ্ডিত ক্ষুরের মতো মনে হয়, সেই হেতু এই নাম। ইংরাজিতে একে বলা হয় ককল্‌বার (Cocklebar)। বৈজ্ঞানিক নাম- Xanthium strumarium, Xanthium indicum। বার্‌ হল ফলটা।

ঘাগরা শাকের ফল
ঘাগরা শাকের ফল

গাছটির আদিবাস উত্তর আমেরিকা কিন্তু সারা দুনিয়ায় এখন উইড হিসেবে এর পরিচিতি। কিছু দেশে এর পাতা আর কচি ডাঁটা খায় মানুষ। আমাদের দেশেও কখনও মাছের ঝোলের সঙ্গে রান্না করে এবং স্বাদটাও বেশ। কিন্তু এই খাওয়াটা হয় সন্তর্পণে, কারণ এর যে বিষক্রিয়া হতে পারে তা মানুষ জানে কবিরাজদের মাধ্যমে। আয়ুর্বেদ এই গাছ ভেষজ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে বহুকাল কিন্তু আমি তার কিছুই উল্লেখ করছি না কারণ পশ্চাৎপটে রয়েছে সিলেটের এক দুঃখজনক ঘটনা।

সেবার সিলেটে অসময়ে বন্যা হয়েছে, ২০০৭ এর অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে। বর্ডার এলাকার কিছু নিরীহ মানুষ পাথর কুড়িয়ে, খনন কাজ করে কোনো রকমে দিনাতিপাত করে। বন্যার কারণে তারা শহর থেকে বিচ্ছিন্ন বেশ দূরে। খাবার শেষ হয়ে গেলেও পরিমাণ মতো রিলিফ আসছে না। আর রিলিফ মানে চাল, কিন্তু খাবে কী দিয়ে?। নিকটবর্তী ডাঙ্গা থেকে এলাকাবাসী শাকপাতা কচুঘেচু সংগ্রহ করে খেতে লাগলো কিন্তু তাও শেষ হয়ে গেল দ্রুত। এবার তারা ঘাগরা শাক খেতে শুরু করলো প্রায় একযোগে। এই ঘাগরা তারা আগে থেকেও খেতো, কিন্তু বীজ হবার আগে। কারণ তারা জানতো ফুল থেকে বীজ হতে হতে গাছে বিষ হয়, পাতাও বিস্বাদ হয়ে পড়ে। আমরুল, হেলেঞ্চা মালঞ্চও একই রকম, ফল ধরলেই বেড়ে যায় অকজ্যালিক। কিন্তু মনকে প্রবোধ দিল তারা, কী আর হবে এমন, প্রাণে তো বেঁচে থাকা চাই। এর ফল হল, কয়েক দিনেই ৮০ জন হাসপাতালে, ২০ জন মারা গেল সুচিকিৎসার আগেই। cocklebar
এই ঘটনা থেকে অনুমান করি ঘাগরা শাকের পাতা ‘এলিলোরসায়ন—এ বিষাক্ত হয়ে পড়েছিল। আফ্রিকার কুডু প্রাণিরাও মারা গিয়েছিল এভাবে। একবার খরার কারণে বাবলা গাছের পাতা এমনভাবে মুড়ে খেল তারা যে বাবলার জীবন সংশয় দেখা দিলো আর ঠিক তখনই বিষাক্ত করে ফেললো তারা পাতা “এলিলোকেমিকেল” নিঃসরণ করে। এক বাবলা গাছ বিষ তৈরি করে আরেক গাছকে জানালো বাতাসের গতিপথে ইথিলিন গ্যাস ছড়িয়ে। কুডুরা সেটা বুঝতে পারার আগেই ঝাড়ে বংশে মরা শুরু করলো। কিন্তু জিরাফ মরলো না।

জিরাফ এই বিষের অস্বিত্ব টের পেয়ে দক্ষিণ থেকে বাতাস এলে উত্তর গিয়ে পাতা খেতে শুরু করলো কারণ তখন বাতাসের উলটো দিকে কেমিকেল রিলিজের ইঙ্গিত পৌছাতে পারেনি। কিন্তু মানুষ তো আর জিরাফ নয়, বুঝতে পারেনি ঘাগরাতে বিষের আধিক্য জমেছে। শাদামাটা কুডুর মতো না বুঝে প্রাণ হারালো একগাদা মানুষ।

লেখকঃ কিউরেটর (টেক) সায়েন্স ওয়েসিস মিউজিয়াম, রিয়াদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics