
বাংলাদেশে কৃষি বনায়ন ও সম্ভাবনা
মোঃ সাইফুল ইসলাম
বাংলাদেশের রূপ বৈচিত্র্য আলোচনা করতে গেলে যেকোন লেখক, সাহিত্যিক কিংবা কবি ফুটিয়ে তুলতেন সবুজে-শ্যামলে সুশোভিত, ছায়াঘেরা, পাখপাখালির কলকাকলি মুখরিত বাংলাদেশ। অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী বাংলাদেশের করুণ চিত্র দেখার ও লেখার আগেই তারা বাংলার ভূমিতে শায়িত হয়েছেন।
এখন বনজঙ্গল উজার করার কারণে সেই বাংলার রূপ অনেকটা হারিয়ে গেছে। জুন, ২০১৪ এর হিসেব মতে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৫,৬৪,৯৯,৬৭৩ জন। এত সংখ্যক লোকের জন্য প্রয়োজন খাদ্যের। দেশটি বর্তমানে নানা রকম আবহাওয়া ও জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের কারণে বৈরীতার স্বীকার হচ্ছে। আবার সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে থাকায় বিজ্ঞানীদের ধারণা বিশ্বের মাঝে সবার আগে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা তলিয়ে যেতে পারে। ফলে খাদ্য ঘাটতি আরও বেড়ে যেতে পারে। কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতির কথা অস্বীকার করার কোন উপায় আমাদের নেই। লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিন শহর এলাকায় বসতবাড়ি করে স্থায়ী হয়েছেন বটে, খাদ্যের জন্য এখনও আমাদের ভরসার স্থল আমাদের গ্রাম গুলো। সমতল ভূমির এ দেশে পাহাড়ি ভূমির পরিমাণ নগণ্য বলা চলে কিন্তু পাহাড়ে উৎপন্ন কৃষি জাত পণ্যের চাহিদা পাহাড় ছাড়িয়ে পৌঁছেছে সমতলের হাট বাজারে।
আবার পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী এলাকায় আরেকটি বড় সমস্যা দেখা গেছে। ১৮৮০ সালে দেশের পূর্বাঞ্চল ঘন বনজঙ্গলে ঢাকা ছিল, যার অধিকাংশই হারিয়ে গেছে। সাধারণত জমি ও বনের গাছপালা সরকারী সম্পত্তি। কৃষকরা কেবলমাত্র সেখানের বনের পরিবেশ নষ্ট না করে সেগুলো ব্যবহার করার অধিকার রাখে। তা স্বত্বেও দ্রুত বন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অরগানাইজেশনের (FAO) মতে ১৯৯০-২০০৫ সালের মধ্যে এইসব এলাকার বন ২৬০০০ হেক্টর থেকে কমে ১৬০০০ এর মত হয়েছে। বন ও বন্য পরিবেশ নষ্ট করার কারণে ভূমিধ্বস, পাহাড়ধ্বস ও ভূমির উর্বতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে শস্যের উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
যদি বন ও বনের পরিবেশ নষ্ট না করে অধিক ফসল উৎপাদন করা যায় তাহলে কেমন হয়? অবশ্যই ভাল হবে। আর সেটা সম্ভব হবে কৃষি বনায়ন তথা এগ্রোফরেস্ট্রির মাধ্যমে। এর উত্তর দিয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার Center for International Forestry Research (CIFOR)। তারা ভূমির ত্রিমাত্রিক ব্যবহারের পরামর্শ প্রদান করেছেন। অবশ্য সেখানে পূর্ব থেকেই স্থানীয় Semi-agricultural পদ্ধতিতে চাষাবাদ হতো। আলুটিলা ভ্যালিতে গবেষণার মাধ্যমে এই বনায়নের সম্ভাবনা ও পদ্ধতি নিয়ে আলোকপাত করেছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি। তারা সেখানে Multi-story পদ্ধতির কথা বলেছেন।
কৃষি-বনায়ন বলতে বোঝানো হচ্ছে শস্যের পাশে গাছ লাগানো। এই পদ্ধতি খুবই সাধারণ। এই পদ্ধিতে ফলমূল ও কাষ্ঠল উদ্ভিদ একসাথে লাগানো যাবে। কাষ্ঠল উদ্ভিদ আকাশিয়া (বাবলা) যেটা ১০ বছর পর কাঁটা যাবে। আর ফলের গাছ যেমন কাঁঠাল ও আম দীর্ঘদিন থাকবে। এসবের নিচে শাকসবজি ও কন্দ লাগানো যাবে। সাধারণত ৩ থেকে ৪ টি ধাপে লাগাতে হবে।
একেবারে নিচে ছায়াসহনশীল প্রজাতি যেমন আদা, হলুদ ও বেগুন লাগাতে হবে। পরের ধাপ একটু উঁচু হবে যেখানে কলা, পেপে ও লেবুর গাছ থাকবে। আর সর্বোপরের ধাপে থাকবে ফল ও কাষ্ঠল উদ্ভিদ। সময়ের ব্যবধানে সেখানে একটি সবুজ আচ্ছাদন তৈরি হবে। এটি খুব ঘন না হলেও প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ আচ্ছাদন তৈরি করবে।
ধারণা করা হয়েছে এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে প্রতি একর জায়গা থেকে বার্ষিক গড়ে প্রায় ২৩২৩৫০ টাকা আয় হবে। যা সনাতন পদ্ধতিতে ধান চাষের থেকে প্রায় ২৭ গুণ বেশি। তবে এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় লাভ হচ্ছে বনায়ন ধ্বংস কমে যাবে এবং সবুজ বনায়ন সৃষ্টি হবে।
তবে এই পদ্ধতি অবলম্বনে কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে আর তা হল বাংলাদেশের কৃষকদের শিক্ষা এবং এই পদ্ধতির প্রাথমিক খরচ। সরকারী সহায়তা এ পদ্ধতি বিকাশ ঘটাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
লেখক- চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়।