
প্রত্নসংস্কৃতির সংরক্ষণে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দাবি
সুপ্রাচীন সভ্যতার ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ আমাদের দেশ ও জাতি। যার প্রত্যক্ষ ইতিহাস ধারন করছে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা প্রাচীন স্থাপত্য ও প্রত্নসম্পদ। ঔপনিবেশিক আমল থেকে অবহেলার কারণে ধ্বংস বা পাচার হয়ে যাচ্ছে আমাদের অনেক মহামূল্য প্রত্নসম্পদ। পরিবেশবাদীদের আন্দোলন, সচেতন মহলের আলোচনা বা লেখালেখিতে ও প্রচার মাধ্যমের ভূমিকায় কিছূ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্ত অপ্রতুল। জাতীয় অহংকারের নিদর্শন প্রত্নসম্পদ বা প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরী। আজ ১৪ নভেম্বর শুক্রবার, সকাল ১০.৩০মিনিটে পবা কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশের প্রত্নসংস্কৃতিঃ ঐতিহ্যিক গুরুত্ব ও বর্তমান ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।
বক্তারা বলেন, প্রত্নসম্পদ বা প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের ভিতর জড়িয়ে থাকে একটি জাতির অহংকার। কোনো জাতি যখন দারিদ্র বা অন্য কোন সংকটে ম্রিয়মান হয়ে পড়ে তখন উজ্জল ঐতিহ্যই তাকে নতুন জীবনী শক্তি দিতে পারে। প্রত্ননিদর্শন প্রাপ্তির আলোকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল বাগেরহাট। বাগেরহাটের প্রত্নস্থাপনাসমূহের মধ্যে মসজিদের সংখ্যাই বেশি। বর্তমানে টিকে থাকা মসজিদের অধিকাংশই সরকারি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর পুন:নির্মাণ করেছেন। এসব নির্মাণে স্থাপত্যসমূহ সুলতানি স্থাপত্যের আদল পেলেও অনেক ক্ষেত্রে স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ না করা হয়নি হয়নি। সংস্কার সংরক্ষণ কাজ সহজ করার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ অলংকরণ শৈলীর বিলুপ্তি ঘটানো হয়েছে। কোথাও কোথাও সংস্কার দুর্বলতার কারণে ইমারত হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে।
বিশ্বের সকল সভ্য দেশই তাদের ঐতিহ্য পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উপস্থাপনের জন্য নানা প্রকার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে প্রত্ননিদর্শন অবিকৃত রেখে সংরক্ষণের চেষ্টা করে এবং পুরাকীর্তি আইন কঠোরভাবে মান্য করে। কিন্তু আমাদের দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায়িত্বশীলতার পরিচয় না দেওয়ায় এবং পুরাকীর্তি আইন মান্য না করায় আমাদের প্রত্নসম্পদসমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। যেমন- ষাট গম্বুজ ও রণবিজয়পুর মসজিদের অভ্যন্তরভাগ মোটা প্লাস্টারে ঢেকে দেয়া হয়েছে। ষাট গম্বুজ মসজিদের অন্যতম স্থাপত্যিক অহংকার পাথরের স্তম্ভগুলো প্লাস্টারের আড়ালে অভ্যন্তরীণ থাকায় এদের আর পাথর হিসেবে শনাক্ত করার উপায় নেই। এটি সরাসরি পুরাকীর্তি আইনের লঙ্ঘন। এই ভুল সংস্কারকর্ম ইতিহাসকেও বিকৃত করেছে। খানজাহান আলীর মাজারের বর্হিদেওয়াল ও ফটকে উৎকট রংয়ের ব্যবহার করা হয়েছে, মাজার সংলগ্ন মসজিদের আদি রূপে নানা ধরণের বিকৃতি সাধন করা হয়েছে, ঠাকুর দিঘির ঘাটের সিঁড়ি আধুনিকায়ন করা হয়েছে যা সুলতানি যুগের স্বাভাবিক ধারণাকে বিভ্রান্ত করবে। এমনিভাবে অবহেলা, অজ্ঞতার শিকার হচ্ছে আমাদের গর্বের প্রত্নসম্পদ।
আলোচনা সভায় নিন্মোক্ত সুপারিশসমূহ করা হয়-
১. প্রত্নসংস্কৃতির সংরক্ষণে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা
২. প্রত্নসম্পদ রক্ষায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ রাখা ও প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ দেয়া
৩. সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কাজের সমন্বয় সাধন করা
৪. প্রত্নঐতিহ্যের সাথে জনসম্পৃক্তি বৃদ্ধি করতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৫. দেশে প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণের জন্য সংরক্ষণবিদ সৃষ্টিতে গুরুত্ব দেয়া।
পবার ঐতিহ্য সংরক্ষণ কমিটির আহবায়ক বিশিষ্ট স্থপতি অধ্যাপক সামসুল ওয়ারেসের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম শাহ্নাওয়াজ। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি অধ্যাপক ড. আবু সাঈদ এম আহমেদ, স্থপতি সাজ্জাদুর রশিদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোঃ আতিয়ার রহমান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মোজাম্মেল হক প্রমুখ।