জলাধার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে দ্রুত পদক্ষেপ জরুরি
জলাধার ও ভ’গর্ভস্থ পানি এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাপনায় সরকারি সংস্থাগুলো দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে না বরং পানি উত্তোলন ও ব্যবহারেই সংস্থাগুলোর অধিক মনোযোগ। ফলে পানি সম্পদ আজ হুমকির সম্মুখীন। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী দিনগুলোতে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর সুপেয় পানি চাহিদা মেটাতে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারকে কঠোর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। অবিলম্বে পানি সম্পদের উৎসগুলো সংরক্ষণ ও পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। আজ ২১ মার্চ ২০১৫ সকাল ১১টায় পবা কার্যালয়ে বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষ্যে ‘পানি সম্পদ সংরক্ষণ ও পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।
পবার নির্বাহী সদস্য প্রকৌশলী তোফায়েল আহমেদের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য মো: আলাউদ্দিন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পবার সম্পাদক ও ঢাকা সিটি কলেজের প্রফেসর ড. মশিউর রহমান। অন্যান্যের মধ্যে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন, পবার নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান, পবার সম্পাদক মনজুর হাসান দিলু, পবার সহ-সম্পাদক স্থপতি শাহীন আজিজ, পীসের মহাসচিব ইফমা হোসাইন,মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত, আইইডির সমন্বয়কারী তারিক হাসান মিঠুল প্রমুখ।
ড. মশিউর রহমান তার মূল প্রবন্ধে বলেন, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ এবং খুলনা বিভাগে কৃষিকাজের জন্য গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভ থেকে অতি মাত্রায় পানি অহরণ করা হচ্ছে। সেখানে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাওয়ার কারণে শুকনো মৌসুমে নদীর প্রবাহ দ্রুত শুকিয়ে যায়। পুকুর, জলাশয় এবং হস্তচালিত নলকূপ থেকে সাধারণ মানুষ তার প্রয়োজনিয় পানি তখন আর সংগ্রহ করতে পারে না। সেখানকার মানুষের জীবন যাপনে সৃষ্ট এই সঙ্কট নিরসনকল্পে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও এর কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা না হলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়টি অধরাই থেকে যাবে।
প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান তার বক্তব্যে বলেন, ২০১০ সালে বিশ্বে যে ১৫টি দেশ সবচেয়ে বেশী ভ’গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে তাদের মধ্যে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান , ইরান এর পরই বাংলাদেশের অবস্থান। বাংলাদেশে ২০১০ সালে ৩০.২১কিউবিক কিলোমিটার ভ’গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে ৮৬% সেচ কাজে, ১৩% গৃহস্থালী এবং ১% শিল্পে ব্যবহৃত হয় (National Ground Water Association, USA, 9/2013)। বিএডিসির তথ্যানুযায়ী ২০০৪ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে অগভীর নলক’পের সাহায্যে সেচের পরিমাণ ১৪,৪৪১ বর্গ কিলোমিটার থেকে কমে ১৩,৬৯১ বর্গ কিলোমিটারে দাড়িয়েছে। মার্চ এবং এপ্রিল মাসে ১৬ লাখ অগভীর নলক’পের মধ্যে ৪ লাখ অকেজো হয়ে পড়ে।
দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে বিগত ৩০ বছর (১৯৮১-২০১০) ধরে বার্ষিক গড় ১.৪% হারে ভ’গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ভ’গর্ভস্থ পানির স্তর সবচেয়ে বেশী নেমেছে রাজশাহীতে। প্রতি ইউনিট এলাকায় নলক’পের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে প্রতিটি নলক’পের আওতাধীন এলাকা ১৯৮৪-৮৫ হতে ২০১০-১১ অত্যন্ত কমে ১৪.৫ থেকে ২.৮ হেক্টরে দাড়িয়েছে। গড়ে নদীর পানির স্তর ১৯৮১ হতে ২০১০ এর মধ্যে ২০ মিটার থেকে কমে ১৯ মিটারে দাড়িয়েছে। এই হ্রাস প্রবণতা ভ’গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার সাথে ইতিবাচকভাবে সম্পর্কযুক্ত। ১৯৮৯ – ২০১০ সালের মধ্যে শুষ্ক মৌসুমের মোট জলাভ’মির প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ হারিয়ে গেছে। এসব সূচক থেকে ধারণা করা যায় যে দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে ভ’গর্ভস্থ পানির ব্যবহার টেকসই/দীর্ঘস্থায়ী নয়।
নীতি বিশ্লেষক এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা পানি ব্যবহার ও দুষণ করছে। কিন্তু পানি সম্পদ সংরক্ষণ বা পানি রিচার্জ করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণে সংস্থাগুলো দায়িত্বশীল নয়। অপরদিকে রাজউকের কারণে এ নগরে পানি রিচার্জের অন্যতম অধার উম্মুক্ত স্থান ও জলাধারগুলো ধ্বংশ হচ্ছে। যা পানি সংকটকে ত্বরান্বিত করবে। পানি সম্পদ সংরক্ষনের সাথে ৪০টির বেশি সংস্থা এবং প্রায় ২০টি বেশি আইন রয়েছে। তথাপিও রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর পানি সম্পদ সংরক্ষনে এ ধরনের উদাসীনতা বাংলাদেশ সংবিধানে অনুচ্ছেদ ১৮ক এর পরিপন্থি।
আলোচনা সভা থেকে নিন্মোক্ত সুপারিশ করা হয় :
নদী, খাল-বিল, হাওর-বাওড়, লেক, দিঘী-পুকুর, নিম্নাঞ্চল, জলাভ’মি দখল, ভরাট ও দূষণ বন্ধে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করা।
ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রাপ্য ন্যায্য স¤পদ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমাদের আরো অধিকতর টেকসই জীবনযাত্রার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা।
ভ’গর্ভস্থ পানির রিচার্জ এবং ভ’পৃষ্ঠস্থ ও ভ’গর্ভস্থ পানির প্যাটার্ন ও ব্যাপ্তি অনুসরণের জন্য উপযুক্ত মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা নিয়ে পানির স্তর রিচার্জের লক্ষে একটি জাতীয় প্রোগ্রাম/কৌশল গ্রহণ করা ।
পানির স্তর রিচার্জ, নিষ্কাশন, মাটির আদ্রতা পরিবর্তন ও পানি সঞ্চয়ের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পানি বাজেট প্রস্তুত করা ।
টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি যেমন আšতর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও আর ডি এ মিলিতভাবে উদ্ভাবিত সেচের পানি সাশ্রয়ী পদ্ধতি অল্টারনেট ওয়েটিং এন্ড ড্রাইয়িং-এর উপর সচেতনতা এবং এডভোকেসি প্রচারণা জোরদার করা।
বোরো ধানের পরিবর্তে উচ্চ মূল্যের ফসল উৎপাদনে জোর দেয়া উচিত। কম পানি প্রয়োজন ও ব্যয় সাশ্রয়ী ফসল আলু, ডাল, গম চাষে অগ্রাধিকার দেয়া ।
বুড়িগঙ্গা নদীকে গতিশীল রাখার জন্য এর সাথে ধলেশ্বরী-কালিগঙ্গা নদীর সংযোগ পুনপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
শুকনো ঋতুতে মজা নদীর খাতে ফসল চাষের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
পরিকল্পিত ভাবে শাখা নদী গুলোর খাত খননের কার্যক্রম গ্রহন করতে হবে।
ছোট বা বড় নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বিঘœ সৃষ্টি হয় এমন কার্যক্রম গ্রহন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
প্লাবন ভূমিতে গভীর নল স্থাপন করে ভূগর্ভস্থ পানির আধারস্তরে বৃষ্টি ও বর্ষার পানি সঞ্চালনের ব্যবস্থা করতে হবে।ঢাকা মহানগরীসহ সকল শহরে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে আনুপাতিক হারে উন্মুক্ত মাটির আঙ্গিনা রাখার বাধ্যতামুলক ভবন নির্মাণ বিধি সন্নিবেশিত করা প্রয়োজন যেন বৃষ্টির পানি মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে।
নগরের ভবন নির্মাণের বিধিমালায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষন এবং তা আবাসিক প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায় এমন অবকাঠামো ভবনের নক্সায় বাধ্যতামুলক ভাবে অন্তর্ভুক্ত রাখতে ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
মধুপুর চত্বর অঞ্চলের নদী যেমন বংশী, বানার, কাওরাইদ, সুতি, খিরু, বালু, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ প্রভৃতির অংশ বিশেষে পরিকল্পিত ভাবে রাবার ড্যাম স্থাপনের মাধ্যমে স্থানিয় বৃষ্টিপাতের পানি সংরক্ষণ এবং সেই পানি ভূগর্ভস্থ পানির আধারস্তরে (ডুপিটিলা) প্রবিষ্ট করার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
ঢাকা মহানগর এবং অন্যান্য শহরের সরকারি অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ খেলার মাঠ, উদ্যান ও বিভিন্ন উন্মুক্ত স্থানে নল বা কূপ স্থাপন করে বৃষ্টির পানি ভূগর্ভস্থ ডুপিটিলা স্তরে সঞ্চালনের ব্যবস্থা অতি জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করা প্রয়োজন।