অরূপ রতন নিবিড় বর্ষাবন
জায়েদ ফরিদ
নিবিড় বর্ষাবনের ওপর দিয়ে যতদিন পর্যন্ত উড়োজাহাজ উড়ে না গেছে ততদিন পর্যন্ত আমরা এর ওপরের চেহারাটুকু ভালমতো দেখতে পাইনি। যতোটুকু আবছায়া দেখা তার কিছুটা হয়তো দূর পাহাড়ের ওপর থেকেই। এই বনের মুকুটের শ্রী দেখার জন্যে দেড়শো ফুট লম্বা গাছের মাথায় সহজে বেয়ে ওঠার কোনো কৌশল বনের আদিবাসীদেরও জানা ছিল না এবং প্রয়োজনও ছিল না। আমরা নিকট থেকে দেখতে পারিনি এর ঝাঁকড়া সবুজ কেশবিন্যাসের রূপ এবং এই রূপের সঙ্গে ওতপ্রোত মিশে থাকা জীববৈচিত্র্যও।
ভাবতে অবাক লাগে, এমন নিবিড় বনে ১৫ তলা দালানের সমান উঁচু জায়গায় বাস করে বহু প্রজাতির ব্যাং যারা কোনো দিন মাটি ছোঁয় না। এরা বংশপরম্পরায় গাছে গাছে লাফিয়ে বেড়ায়, পদস্খলন হয়ে নিচে পড়ে যায় না কখনো। সারা বন জুড়ে গাছের কাণ্ড থেকে পাতা পর্যন্ত, অর্কিড ছাড়াও দেখা যায় বহু প্রজাতির আনারস জাতীয় গাছ, ব্রোমেলিয়াড। এই গাছের ঢেউ খেলানো পাতার খাঁজে গ্যালন গ্যালন বর্ষার জল জমে থাকে আর তার ভেতরেই বড় হয় ব্যাঙাচি, শামুক। এ ছাড়াও গাছের মুকুটে বাস করে শ্লথ বানর সালামান্ডার পাখি ইঁদুর সাপ ছোটো বিড়াল প্রজাপতি, এমনই অসংখ্য প্রাণী।
বর্ষাবন বলতে আমরা সহজভাবে অনুমান করি, যে বনে বৃষ্টিপাতের আধিক্য রয়েছে। এ ধরনের বনে বাৎসরিক বৃষ্টিপাত হওয়া চাই কমপক্ষে ৬০ ইঞ্চি, বেশির পক্ষে ধরে নেয়া যায় ৫০০ ইঞ্চিরও বেশি। আমাদের উপমহাদেশের কিছু অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৮০ ইঞ্চির কম নয়। অতএব এ দিক দিয়ে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের বনাঞ্চলও বর্ষাবনের অন্তর্গত, যাতে রয়েছে সিলেট ও পার্বত্য চটগ্রামের বনাঞ্চল, সুন্দরবন এবং রাতারগুল জলাবন বা সোয়াম্প ফরেস্ট। বর্ষাবন প্রধানত পৃথিবীর বিষুবীয় অঞ্চল জুড়েই অধিক বিস্তৃত। ব্রাজিলের আমাজন, আফ্রিকার কঙ্গো, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপাঞ্চল এবং মাদাগাস্কার ছাড়াও এতে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার কিছু বনাঞ্চল।
বর্ষাবন, বিশেষত বৃহৎ নিবিড় বর্ষাবনগুলো বিক্ষিপ্তভাবে সৃষ্ট সাধারণ বন থেকে অনেক স্বতন্ত্র। এই জটিল এবং অসাধারণ বন সম্পর্কে জানবার একটা সহজ উপায় হলো এর কাঠামোর স্তবক বিভাজনগুলো খতিয়ে দেখা।
এই স্তবকগুলির মধ্যে প্রধানতম হল শামিয়ানা বা চন্দ্রাতপ স্তবক (Canopy layer)। এর গাছগুলির মুকুটের উচ্চতা গড়ে ১০০ ফুটের মতো। মেহগনি সেগুন বলসা এই স্তবকের গাছ। এখানেই দেখা যায় সবচে বেশি জীববৈচিত্র। আকাশ থেকে এর ছবি নিলে এই চন্দ্রাতপের সাদৃশ্য পাওয়া যাবে হাল আমলের সবুজ কপি ব্রোকলির সাথে। এই স্তবকের অধিকাংশ গাছ সালোকসংশ্লেষণের ওপরেই নির্ভর করে বেশি যে কারণে পাতার আকৃতি হয় বড়। অধিকাংশ পাতাই দেখা যায় ডিম্বাকৃতির যা চক্রাকারে সাজালে এক বিন্দুতে এসে মেশে এবং সে কারণে ঘণ সন্নিবিষ্ট পাতার ভেতর দিয়ে বনতল-এ ২% এর বেশি আলো পৌঁছুতে পারে না, অর্থাৎ বলতে গেলে বর্ষাবনে বিরাজ করে কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার।
নিরেট বনের মধ্যে গাছের মৃত্যুর কারণে, কাঠামোগত বা অন্য কোনো কারণে কিছু জায়গা ফাঁকা হয়ে থাকে। এতে কিছু প্রাণীর চলাচলে বাধা সৃষ্টি হলেও কিছু সাপ, কাঠবিড়ালি জাতীয় প্রাণী লাফিয়ে বা উড়ে জায়গাটা অতিক্রম করতে সমর্থ হয়। ঘন বনে দৃষ্টি চলে না তাই এই স্তবকে পারস্পরিক যোগাযোগের জন্যে পাখপাখালি ও প্রাণীদের আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায় যে কারণে পুরো চন্দ্রাতপ এলাকাই বেশ সরব থাকে। এখন হেলিকপ্টার ছাড়াও নিবিড় অরণ্যের উপরিভাগ দেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, বিজ্ঞানীরা গবেষণা ও আবিষ্কারের জন্যে ব্যবহার করছেন ক্রেন, রোপ ব্রিজ এবং আধুনিক মই।
পক্ষীচোখে দেখা যায়, ক্যানপি লেয়ারের ওপরে প্রায় ২০০ ফুটের মতো লম্বা কিছু বড় গাছ গলা বাড়িয়ে থাকে আকাশের দিকে। এই অতিউচ্চ বা Emergent Layer-এর গাছে বাস করে বানর ঈগল বাদুড় জাতীয় প্রাণী আর ছোটো প্রাণীর মধ্যে দেখা যায় প্রজাপতিকে। বর্ষাবনের দুর্বল বেলে মাটিতে পোক্ত আস্তানার জন্যে এসব গাছের গোড়ায় প্রায়ই বাট্রেস দেখা যায় প্রায় ১৫ ফুট ব্যাসের যার উচ্চতাও ১৫ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। ক্যাপক এ ধরনের এক প্রকার তুলা গাছ। এছাড়া দেখা যায় দীর্ঘ ব্রাজিল নাট গাছও।
ইমার্জেন্ট এবং ক্যানপি লেয়ারের নিচে থাকে আন্ডারস্টোরি (Understory) লেয়ার যেখানে এতো কম আলোক পৌঁছায় যে আলো থেকে খাদ্য সংগ্রহের জন্যে গাছের পাতা হয় আরো অনেক বড়। ফার্ণ সমৃদ্ধ এসব গুল্ম জাতীয় গাছের উচ্চতা সীমিত থাকে ১২ ফুটের মধ্যেই।
নিবিড় বর্ষাবনে বনতল বা ফরেস্ট ফ্লোর (Forest Floor)এর মাটি থাকে অনুর্বর। এতোটাই অনুর্বর যে কোনো কৃষিবিদকে যদি এই মাটির নিউট্রিশান রিপোর্ট দেখানো হয় তবে তিনি হয়ত বলবেন, এমন মাটিতে বড়জোড় কোনো ক্যাকটাস জন্মাতে পারে। এ কারণে বর্ষাবনের বনতলকে বলা যায় ভেজা মরুভূমি। সূর্যালোক থাকে না বলে এখানে একটি গাছের পাতা অপকৃষ্ট বা বায়োডিগ্রেডেড হয়ে মাটিতে মিশে যেতে সময় লাগে মাত্র ৬ সপ্তাহ যা স্বাভাবিকভাবে লাগতে পারতো এক বছর। ছত্রাক জাতীয় উদ্ভিদ, শামুক স্লাগ ইত্যাদি প্রাণী খুব দ্রুত উদ্ভিদ ও মৃত প্রাণীদেহকে বিশ্লিষ্ট করে কিছুটা নিউট্রিশান ফিরিয়ে দেয় জমিতে যা খুব দ্রুত শোষণ করে নিতে হয় গাছকে, কারণ বৃষ্টির জলে এই পুষ্টি দ্রুত ধুয়ে যেতে পারে।
উষ্ণ, হাওয়া চলাচল বন্ধ, স্যাঁৎসেতে অন্ধকার বর্ষাবনের অনেক গাছ আমরা ইন্ডোর প্ল্যান্ট হিশেবে ব্যবহার করি যার মধ্যে রয়েছে ফিলোডেন্ড্রন, পিস্ লিলি, প্রেয়ার প্ল্যান্ট ইত্যাদি। এই বৈরী বনতলেও দেখা যায় কিছু প্রাণী। এশিয়ার বনে দেখা যায় হাতী এবং বাঘ, কঙ্গোতে দেখা যায় গরিলা ও চিতাবাঘ এবং আমাজন অরণ্যে ট্যাপির ও ফুলচিতা।
বর্ষাবনে স্থান, খাদ্য ও বংশবিস্তার নিয়ে দারুণ প্রতিযোগিতা চলে বৃক্ষকূলে এবং প্রাণীকূলে। মাটিতে পুষ্টির অভাবে এখানকার অনেক গাছ মাংসাশী হয়ে পড়েছে যাদের মধ্যে দেখা যায় ভিনাস ফ্লাই ট্র্যাপ এবং কলসি উদ্ভিদ। বায়ু থেকে খাবার সংগ্রহ করার জন্যে বড় গাছের শরীরে, শেকড় থেকে পাতা পর্যন্ত আস্তানা নেয় অসংখ্য পরগাছা, অর্কিড। বড় গাছের গা বেয়ে ওঠে অগণিত লিয়ানা বা কাষ্ঠল লতা যারা ক্যানপিতে ওঠার পর পত্রপুষ্প ধারণ করে, এক গাছ থেকে আরেক গাছে গিয়ে বংশ বিস্তারে উদ্যত হয়। ইঁদুর বানর গেছোব্যাংসহ অনেক প্রাণীই এই কাষ্ঠল লতা বেয়ে গাছের চাঁদোয়ায় উঠে যায়।
পৃথিবীর সমস্ত ভূভাগের ৬ শতাংশ বর্ষাবন। তাপ নিয়ন্ত্রণের কার্যকরী ভূমিকা আছে বলে বর্ষাবনকে বলা হয় দুনিয়ার শীতাতপ নিয়ন্ত্রক। বায়ুমণ্ডল থেকে দূষিত কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে তা দেহে সংরক্ষণ করে গাছ, ফিরিয়ে দেয় বিশুদ্ধ অক্সিজেন, যেন এরা কাজ করে পৃথিবীর প্রাণীকূলের ফুসফুস হিশেবে। বর্ষাবন থেকে আসবাব, বনজ খাবার ইত্যাদি ছাড়াও ২৫% ওষুধ আসে মানুষের কল্যাণে যার ভেতরে আছে ক্যান্সার ও এইডস্ জাতীয় অনেক দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধও।
কোনো কোনো বর্ষাবনের বয়স প্রায় ১০ কোটি বছরের মতো, অর্থাৎ ডাইনোসররাও এই বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে গেছে এক সময়। ১০ হাজার বছর আগের বরফ যুগের প্রলয় ঘটানো হিমবাহ বিষুবীয় অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছুতে পারেনি। তাই এই বনে ইভোলিউশান চলেছে অব্যাহতভাবে। অথচ এই বন এখন ধ্বংশের পথে। কৃষিজমি নির্মাণ, রমরমা কাঠের ব্যবসা, গবাদি পশুর প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ইত্যাদির কারণে এই সব বর্ষাবন দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রতি মিনিটে কাটা পড়ছে ২০০০টি গাছ, প্রতি সেকেণ্ডে নষ্ট হচ্ছে ফুটবল মাঠের সমান বনাঞ্চল, প্রতিদিন হারাচ্ছি আমরা গাছ ও প্রাণীর ৫০ টি প্রজাতি। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত এই বিশ বছরে এশিয়ায় বর্ষাবন উজাড় হয়েছে শতকরা ৩৩ ভাগ যা পৃথিবীর অরণ্যবিনাশের শীর্ষ রেকর্ড।
এভাবে অপ্রতিহত গতিতে নির্বনায়ন চলতে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ পৃথিবীর সমগ্র বনাঞ্চলের ৯০% উজাড় হয়ে যাবে। বন উজাড় হলে তাপমাত্রা বেড়ে যাবে, পর্বতপৃষ্ঠের বরফ গলে সমুদ্রবক্ষে জলের উচ্চতা বাড়বে, তলিয়ে যাবে অনেক দেশ। এই বন রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর হয়েছে মানুষ, নতুন করে বনায়ন করছে তারা, কিন্তু ১০ টি গাছের বদলে লাগাচ্ছে মাত্র ১ টি গাছ।