লাল মুনিয়ার ইতিকথা

আলী রেজা হায়দার

প্রায় ৮-১০ বছর আগের কথা। শাহবাগের মোড়ে এক পাখি বিক্রেতার সাথে দেখা। তার ছোট খাঁচায় গাদাগাদি করে রাখা অদ্ভুত সুন্দর দেখতে ছোট এক ধরনের পাখি। এরকম টকটকে লাল রঙের পাখি আগে কখনো দেখিনি। তখন পাখি তেমন একটা চিনতাম না। বিক্রেতারও পাখিটির সঠিক নাম জানা ছিল না। তাই পাখিটির অতুলনীয় সৌন্দর্য অবলোকনের পাশাপাশি এভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে বিক্রি হতে দেখে দুর্ভাগা পাখিগুলোর জন্য মন খারাপ হওয়া একটা মিশ্র অনুভূতি নিয়ে বাসায় ফিরেছিলাম।

তারপর একসময় সেই সুন্দর পাখিটির পরিচয় জানলাম। সেটি ছিল আমাদের দেশে পাওয়া মুনিয়ার ৬টি প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও অপেক্ষাকৃত বিরল প্রজাতির লাল মুনিয়া। ইংরেজি নাম Red Avadavat, Red Munia বা Strawberry Finch। বৈজ্ঞানিক নাম Amandava amandava। পাখিটির নামের Avadavat বা Amandava শব্দটি ভারতের গুজরাট প্রদেশের শহর আহমেদাবাদ-এর নামের অপভ্রংশ যেখান থেকে একসময় পেট ট্রেডের জন্য এদের ভারতের বাইরে রপ্তানি করা হত। Estrildidae পরিবারের Amandava গণভুক্ত ৩টি প্রজাতির মধ্যে শুধু এ প্রজাতিটিই বাংলাদেশে পাওয়া যায়। ৪টি উপ-প্রজাতির মধ্যে বাংলাদেশে A. a. amandava উপ-প্রজাতিটি দেখা যায়।

বাংলাদেশের বাকি ৫টি মুনিয়ার সাক্ষাৎ মিললেও এই বিরল পাখিটিকে প্রাকৃতিক পরিবেশে মুক্ত অবস্থায় দেখা আমার অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল। সত্যি বলতে কি এদেশের বেশিরভাগ পাখিপ্রেমীর কাছেই লাল মুনিয়া হচ্ছে পরম আরাধ্য। আর সে সুযোগ যে হঠাৎ করে এভাবে ঢাকা শহরেই মিলবে তা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল। যদিও ঢাকা শহরের হাতেগোণা কয়েকটা জায়গায় এ পাখি দেখা যায় বলে খবর পেয়েছিলাম। তবে আমার সে স্বপ্ন সত্যি হওয়ার পিছনে পুরো কৃতিত্ব দিতে হবে ছোট ভাই শফিকুল হক ইমন-কে। সে ঢাকা শহরের গুটিকয়েক মানুষের মধ্যে একজন যে লাল মুনিয়ার লোকেশন জানে এবং  তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে পাখিদের নিরাপত্তার স্বার্থে তা গোপন রাখে। আমার সৌভাগ্য যে ইমন আমাকে পাখিটি দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। সঙ্গত কারণেই এ লেখাতেও পাখিটির সুনির্দিষ্ট লোকেশন উল্লেখ করা হল না। red munia

সেদিন ছিল ‍বৃহস্পতিবার (১৫ জানুয়ারি, ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ)। ইমনের সাথে পূর্বালোচনার ভিত্তিতে সেদিন বিকালে তার সাথে দেখা করলাম। সঙ্গী ছিল মুনতাসির আকাশ ও হুমায়রা মাহমুদ। নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছেই চার জোড়া চোখ ব্যস্ত হয়ে পড়ল আকাঙ্ক্ষিত সেই পাখির খোঁজে। সেদিন আমরা আসলেই সৌভাগ্যবান ছিলাম। খুব বেশিক্ষণ তাই খুঁজতে হয়নি। একটা ঘাসে আচ্ছাদিত সরু রাস্তায় চড়ে বেড়াচ্ছিল এক ঝাঁক ছোট পাখি। দূরবীনে চোখ লাগিয়ে ভাল করে দেখতেই নিশ্চিত হওয়া গেল লাল মুনিয়ার উপস্থিতি সম্পর্কে। সে মুহূর্তের ভাল লাগার অনুভূতিটুকু বলে বুঝাবার নয়। সেদিন আমরা লাল মুনিয়ার দুটি আলাদা দল খুঁজে পেয়েছিলাম। যে দলে ছিল প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও মেয়ের পাশাপাশি সদ্য উড়তে শেখা বাচ্চাও। খুব কাছে থেকে উপভোগ করেছি ওদের শ্বাসরুদ্ধকর সৌন্দর্য। প্রজননকালীন পুরুষ পাখির সে রূপ দেখলে পাখি সম্পর্কে খুব একটা আগ্রহ নেই এমন কেউও দ্বিতীয়বার চোখ ফিরিয়ে তাকাতে বাধ্য হবে।

লাল মুনিয়া ছোট আকৃতির পাখি, দৈর্ঘ্য ১০ সেমি। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখিটি দেখতে হয় চোখধাঁধানো সুন্দর। তখন পুরুষটির গায়ের রঙ থাকে মূলত গাঢ় লাল। তবে চোখের পাশ, তলপেট ও লেজ কালো আর ডানা গাঢ় বাদামি রঙের হয়। সারা শরীরে বিশেষ করে বুক, ডানা আর পার্শ্বদেশে সাদা ফোঁটা থাকায় একে আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগে। ছোট ত্রিভুজাকৃতির ঠোঁট সিঁদুরে লাল রঙের, পা ও পায়ের পাতা গোলাপি। প্রজনন মৌসুমের বাইরে পুরুষ পাখির মেয়ে পাখির সাথে অনেক সাদৃশ্য আছে। তখন এদের ঊর্ধ্বাঙ্গ নিষ্প্রভ বাদামি, পুচ্ছদেশ লাল ও নিম্নাঙ্গ ফ্যাকাশে সাদা বর্ণের হয়। তবে মেয়ে পাখিটি পুরুষটির চেয়ে অপেক্ষাকৃত অনুজ্জ্বল বর্ণের হয়, গাঁয়ে সাদা ফোটাও কম থাকে। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি অনেকটা হালকা হলদেটে বাদামি, লেজ কালচে, ঠোঁট হলদেটে, পা ও পায়ের পাতা গোলাপি। পাখিটির একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে এদের ঠোঁটের রঙ পরিবর্তিত হয়। red munia pair

লাল মুনিয়া পানির কাছাকাছি ঘাসবন, চাষের জমির আশপাশের গুল্ম-ঝোপঝাড়, আখখেত ইত্যাদি জায়গায় বসবাস করে। এদেরকে সাধারণত ছোট ঝাঁকে মাটিতে, ঘাসে, নলখাগড়া বা আখখেতে বিচরণ করতে দেখা যায়। ঘাসের দানাই এদের প্রধান খাবার তবে সুযোগ পেলে উই বা অন্যান্য পোকামাকড়ও খায়। ঝাঁক বেঁধে খুব দ্রুত ডানা ঝাপটে উড়ে যাওয়ার সময় সাধারণত উচ্চগ্রামে সিপ শব্দে ডাকে। এদের প্রজননকাল মে-ফেব্রুয়ারি মাস। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখিটি ঘাসের বৃন্ত বা নলখাগড়ার ঝোপের মাথায় বসে গান গায়। সাধারণত পানির কাছাকাছি কাঁটা ঝোপে বাসা করে। ঘাসের ফালি দিয়ে তৈরি ছোট্ট গোলাকার বাসায় মেয়ে পাখি সাধারণত ৫-৬টি (ক্ষেত্রবিশেষে ১০টি পর্যন্ত) ডিম পাড়ে। মূলত মেয়ে পাখিই ডিমে তা দেয় তবে গৃহস্থালি বাকি সকল কাজে পুরুষ পাখি সহায়তা করে।

লাল মুনিয়া বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি। এরা মূলত চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের হাওর ও ঘাসবনে বাস করে। ঢাকায় আমরা যে পাখিগুলো দেখেছি সেগুলো কি প্রাকৃতিকভাবেই এখানে এসেছে নাকি খাঁচা থেকে পালানো পাখিরাই এখানে একটি ছোট পপুলেশন গড়ে তুলেছে তা এখনো স্পষ্ট নয়। পাখিটির বৈশ্বিক বিস্তৃতি দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অনেকগুলো দেশ জুড়ে হলেও বাংলাদেশে পাখিটির অবস্থা খুব একটি ভালো নয়। মূলত খাঁচায় পোষার জন্য অবৈধভাবে ধরার ফলে ও আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে আমাদের দেশে এদের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক কমেছে। ঢাকার পাখিগুলোও তীব্র আবাসস্থলের সংকটে ভুগছে। এ পাখিগুলো মূলত বিভিন্ন আবাসন প্রকল্পের যেসব প্লটে এখনো বিল্ডিং উঠেনি বিধায় ঘাসবন জন্মেছে সেসব জায়গার উপর নির্ভর করেই টিকে আছে। কিন্তু ঢাকায় এসব খালি জমির সংখ্যা খুব দ্রুত কমছে যার ফলে এ সুন্দর পাখিটির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা  তৈরি হয়েছে। এই ইট-কনক্রিটের জঙ্গলে শত প্রতিকূলতার মাঝেও কীভাবে যে এরা টিকে আছে সেটাই এক বিস্ময়। দিনকে দিন আমরা হয়ত তথাকথিত শহুরে আর সভ্য হচ্ছি কিন্তু এর বিনিময়ে আমরা হারিয়ে ফেলছি প্রকৃতির এই অপূর্ব সৃষ্টিগুলোকে। মানুষের সর্বগ্রাসী লোভের বলি হয়ে আমাদের দেশের আরো অনেক প্রজাতির পাখির ন্যায় লাল মুনিয়ার অস্তিত্বও আজ হুমকির মুখে। এখনই এদেরকে সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে চমৎকার সুন্দর এ পাখিগুলো হয়ত একদিন চিরতরে হারিয়ে যাবে আমাদের দেশ থেকে। সেরকম অশুভ দিন যত দেরিতে আসে আমাদের প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য ততই মঙ্গল।

তথ্যসূত্র: ১. http://en.wikipedia.org/wiki/Red_avadavat

২. Encyclopedia of Flora & Fauna of Bangladesh, Vol: 26: Birds

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics