নদীকে তার তীর ফিরিয়ে দিতেই হবে
ডঃ মোঃ আবদুল মতিন
আজ বিশ্ব নদী দিবস। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, দেশ বা অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হতে পারে। দিবসটির সূচনা হয়েছিল আশির দশকে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া রাজ্যে। ‘রিভার হিরো’ মার্ক অ্যাঞ্জেলোর উদ্যোগে। তিনি তার গোটা জীবন নদীর জন্য ব্যয় করেছেন। নদী উদ্ধার, সুরক্ষা, সংরক্ষণ ও নদী বিষয়ক তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্য পরিভ্রমণ করেছেন বিশ্বের এক হাজারেরও বেশি নদী। বাংলাদেশেও এসেছিলেন। তার প্রচেষ্টায় সেপ্টেম্বরের শেষ রোববার উদযাপিত নদী দিবস ছড়িয়ে গেছে কানাডা ও আমেরিকা মহাদেশের বাইরেও। ২০০৫ সাল থেকে সূচিত জাতিসংঘ ‘ওয়াটার ফর লাইফ ডিকেইড’ কর্মসূচি গ্রহণের সময় তাকেও যুক্ত করা হয়। জাতিসংঘ অনুসমর্থন করে দিবসটি। এখন বিশ্বের ৭০টিরও বেশি দেশে পালিত হয় ‘বিশ্ব নদী দিবস’।
বাংলাদেশে দিবসটি প্রথম পালিত হয় ২০১০ সালে। নদী বিষয়ক অলাভজনক ও অপেক্ষাকৃত তরুণদের উদ্যোগ ‘রিভারাইন পিপল’ ছিল এর নেপথ্যে। তারা সেই বছর থেকে বাংলাদেশ প্রতিপাদ্যও ঘোষণা করতে থাকে। ২০১৩ সালে আমরা বাপা থেকে দিবসটি উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিই। এবার বাংলাদেশে পরিবেশ বিষয়ক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ৩৬টি সংগঠন দিবসটি যৌথভাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রতিপাদ্য ঘোষণাও করা হয় পারস্পরিক মতবিনিময়ের মাধ্যমে। ইংরেজি বর্ণানুক্রমে_ অঙ্গীকার বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলন, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা, বংশী নদী সুরক্ষা আন্দোলন, বড়াল রক্ষা আন্দোলন, বারসিক, বায়াসড, বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলন, বুড়িগঙ্গা ক্যাম্প, বুড়িগঙ্গা রিভারকিপার, ক্লিন, সিএসআরএল, ডাকাতিয়া সুরক্ষা আন্দোলন, ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরাম, গ্রিন ম্যাগাজিন, গ্রিন ভয়েস, হালদা নদী রক্ষা কমিটি, হাওর অঞ্চলবাসী, আইডিএমভিএস, জঙ্গলবাড়ি, জল পরিবেশ ইনস্টিটিউট, নদীপক্ষ, নাগরিক সংহতি, ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্স, নোঙর, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবা, রেল নৌ-যোগাযোগ উন্নয়ন গণকমিটি, রিড্র দ্য লাইন, রিভারাইন পিপল, সেভ আওয়ার সি, সবুজপাতা, তিস্তা নদী রক্ষা সংগ্রাম কমিটি, তরুপল্লব, তুরাগ বাঁচাও আন্দোলন, ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ, ওয়াটার কমনস ফোরাম।
এ বছর নদী দিবসে বাংলাদেশের জন্য যে প্রতিপাদ্য আমরা নির্ধারণ করেছি, ‘নদীকে তার তীর ফিরিয়ে দাও’_ তা খুবই সময়োচিত ও জরুরি।
সামান্য সচেতন নাগরিক মাত্রই জানে, দেশের নদীর অবস্থা কতটা সঙ্গিন। দ্রুতই আমাদের সব নদী হারিয়ে যাচ্ছে_ দখল, অবকাঠামো নির্মাণ ও দূষণ তার প্রধান কারণ। বিশেষ করে দখল আর দখলের কাজটি শুরু হয় তীর থেকেই। সেই দখল উচ্ছেদ করা বা নদীর ভূমি মুক্ত রাখা কতটা কঠিন কাজ, একটি উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে।
নদী রক্ষায় ক্রমবর্ধমান জনমত সৃষ্টির কারণে একটি রিট মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালে মহামান্য হাইকোর্ট নদী রক্ষায় যুগান্তকারী রায় দেন। এতে প্রাথমিক কাজ হিসেবে নদীর সীমানা নির্ধারণের কথা বলা হয়। তারা নদীর একটি সংজ্ঞাও প্রদান করেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর নদী বিষয়ক হাইকোর্টের এই রায় বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে। প্রধানমন্ত্রীর নদী রক্ষায় একান্ত আগ্রহ ও আন্তরিকতার প্রকাশ হিসেবে জাতীয় নদী টাস্কফোর্স গঠন করা হয়, নদী কমিশন গঠন হয়েছে। নদী টাস্কফোর্সের পক্ষ থেকে হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়নের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে নদীর সীমানা নির্ধারণকল্পে বিআইডবি্লউটিএর তত্ত্বাবধানে জেলা প্রশাসনের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। চার নদীর মধ্যে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের সীমানা পিলার সম্পন্ন হয়েছে_ বাপার পক্ষ থেকে তা পরিদর্শনে গিয়ে তাদের কাজ হাইকোর্টের রায়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে টাস্কফোর্সকে ২০১২ সালেই জানানো হয়।
দেখা গেছে, সব পিলারই নদীর পাড়ের ভেতরে বা ফোরশোরে (নদীতট) বসানো হয়েছে। অনেক স্থানে ফোরশোরের ভেতরে বা একেবারে নদীর তলের পানির পাশে পিলার বসানো হয়েছে। ফলে হাইকোর্টের রায় গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে। নদীর জমি দখলদারদের বেআইনি দখলিস্বত্বের পরোক্ষভাবে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। হাইকোর্টের রায়ের মূল কথাটি বাস্তবায়নে না গিয়ে টাস্কফোর্স নানাবিধ প্রশাসনিক কমিটি, পরিদর্শন টিম ইত্যাদি করে সময় নষ্ট করছে। জেলা প্রশাসনের স্থাপিত ভুল পিলার কোনোভাবেই অপসারিত হচ্ছে না, সঠিকভাবে হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।
অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের মানুষ তাদের প্রবহমান স্বাভাবিক নদী ফেরত চায়। জননেত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী নদীরক্ষায় তার আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যয় একাধিকবার ঘোষণা করেছেন, দেশের উচ্চ আদালত নদী রক্ষায় নির্দেশ প্রদান করেছেন, নদীর পাড় রক্ষায় ও পানি সংরক্ষণে আইনও রয়েছে, নদী টাস্কফোর্স আদালতের রায় অনুযায়ী নদী রক্ষায় BIWTAকে প্রশাসনিক নির্দেশ প্রদান করেছে, BIWTA তাদের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনকে দায়িত্ব দিয়েছে, কিন্তু জেলা প্রশাসন সে কাজটি সঠিকভাবে করছে না বা পারছে না। এটিই নদী রক্ষার প্রধান সংকট।
সে জন্যই আমরা এবার বিশ্ব নদী দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে নদীকে তীর ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলেছি। আমরা দখলমুক্ত নদীতীর দেখতে চাই। এর বিকল্পও নেই। নদীকে তার তীর ফিরিয়ে দিতেই হবে।
লেখাটি ২৮/০৯/২০১৪ তারিখে বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে দৈনিক সমকাল এ প্রকাশিত ।