বিষাক্ত গ্যাসের কাছে মৌমাছি হেরে যাবে?
দিব্য কান্তি দত্ত
“মৌমাছি, মৌমাছি,
কোথা যাও নাচি’ নাচি’
দাঁড়াও না একবার ভাই।”
“ওই ফুল ফোঁটে বনে,
যাই মধু আহরণে,
দাঁড়াবার সময় তো নাই।”
খুব চেনা লাগছে ছড়াটা? হুম, লাগারই কথা। আমরা যেসব ছড়া পড়ে শৈশব থেকে কৈশোরের দিকে এগিয়েছি তার তালিকা করলে নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের লেখা এই ছড়াটা তো অবশ্যই থাকবে। এখন ঘটনা হল, এই মৌমাছি যদি মধু আহরণ ছেড়ে দেয়; তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে? “ওমা, এ কি অলক্ষুণে কথা! মৌমাছি মধু আহরণ ছাড়তে যাবে কেন?”-এটাই ভাবছেন তো? বিশ্বায়নের ফলে পৃথিবী অনেক এগিয়েছে, তবে এই এগোনো পরিবেশগত দিক থেকে আমাদের পিছে ফেলে দিচ্ছে সে খেয়াল কি আমাদের আছে? শিশুদের জগৎটা তো কবেই খেলার মাঠ ছেড়ে বোকাবাক্স আর কম্পিউটারে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে, তবে কি এখন মৌমাছিও এর কবল থেকে রেহাই পাচ্ছেনা !
আচ্ছা অনেক ভূমিকা তো হল, এবার আসল কথায় আসি। মৌমাছি কিন্তু মধু আহরণ বাদ দিতে চায়নি। এখন যদি সে ফুলই চিনতে না পারে তাহলে মধু আহরণ করবে কিভাবে? আর মৌমাছির এই ফুল চিনতে পারার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করছে কিংবা আরও সূক্ষ্মভাবে বললে, নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে ডিজেলের অতিরিক্ত নিঃসরণ। অর্থাৎ ডিজেল পোড়ার ফলে নির্গত গ্যাসগুলো। মৌমাছি যখন খাদ্যের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায় তখন তারা সঠিক ফুল খুঁজে পেতে কাজে লাগায় ফুলের ঘ্রাণকে। ডিজেল নিঃসরণ ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করছে। প্রতিটি ফুলের সুগন্ধ কিছু রাসায়নিক দ্রব্যের সমন্বয়। ডিজেল পোড়ানোর ফলে নিঃসরিত গ্যাসগুলো সেই রাসায়নিক দ্রব্যগুলোর সাথে বিক্রিয়া করে নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে ফুলের সুগন্ধকে।
রাসায়নিক দ্রব্যের ঘ্রাণই পরিবেশের সাথে কীটপতঙ্গের সংযোগ ও মিথষ্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করে। ফুল উৎপাদী গাছগুলো সুগন্ধ তৈরির দ্বারা কীটপতঙ্গদের প্রভাবিত করে এবং পরাগায়ন ফলপ্রসূ করে। যদিও প্রতিবছর লক্ষণীয় পরিমাণ মৌমাছির বসতি ধ্বংস হয় এবং প্রচুর পরিমাণ মৌমাছি মারা যায় তথাপি মৌমাছিগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরাগবহনকারী হিসেবে বিবেচিত হয়। বৈশ্বিকভাবে পরাগায়নের আর্থিক মূল্য ধরা হয় প্রায় ১৫৩ বিলিয়ন ইউরো! বিশ্বের প্রধান শস্যগুলোর সত্তর শতাংশই নির্ভর করে সফল পরাগায়নের ওপর যা বিশ্বে মোট উৎপাদিত খাদ্যের পঁয়ত্রিশ শতাংশ। পরাগবাহীদের পরিমাণ বৈশ্বিক মাপকাঠিতে খুবই অল্প। কৃত্রিম কীটনাশককে বন্য এবং নিত্য পরাগবাহীদের বিলুপ্তির ক্ষেত্রে প্রধান বস্তু হিসেবে গণ্য করা হয়। মৌমাছির সংখ্যার এমন অপ্রত্যাশিত হ্রাস বিজ্ঞানীদের সমীক্ষা চালাতে বাধ্য করেছে। এতে দেখা গেছে পরিবেশ এবং মৌমাছির মিথষ্ক্রিয়ায় বিভিন্ন উপাদান বিঘ্ন ঘটাচ্ছে যার ফলে মৌমাছির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে।
দুঃখজনকভাবে এটাও সত্যি যে, এই প্রভাব প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। বায়ুদূষণ মৌমাছির ওপর মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলছে তবে প্রভাবগুলো কী কী তা এখনো অজানা। মৌমাছিদের ফুল সনাক্ত করার জন্য রয়েছে বিশেষ ক্ষমতা। এই ক্ষমতার দ্বারা তারা দূর থেকে ফুলের গন্ধ শুকেও ফুল চিহ্নিত করতে পারে এবং সেইসাথে চিহ্নিত করতে পারে সুগন্ধের উৎপত্তিস্থল। রাসায়নিক উপাদানের ভিন্নতার কারণে ফুলের সুগন্ধের দিক দিয়ে থাকে প্রচুর বৈচিত্র্য। রাসায়নিক উপাদানগুলোর মিশ্রনে যদি বাইরে থেকে কোন উপাদান মিশে ফুলের ঘ্রাণ পরিবর্তিত করে দেয় তবে তা পরাগবাহীদের সাথে তাদের যোগাযোগ দূরূহ করে দেয়। তাত্ত্বিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে যে, ওজোন, হাইড্রোক্সিল এবং নাইট্রেট মূলক সমৃদ্ধ গ্যাসের নিঃসরণের ফলে দূরবর্তী জায়গা থেকে সুগন্ধ দ্বারা পরাগবাহীদের ফুল চিহ্নিতকরণ দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে। গবেষণামূলক তথ্য নিশ্চিত করেছে যে, এ ধরনের গ্যাসের নিঃসরণ ফুল থেকে ফুলে তাদের নিজস্ব ঘ্রাণ দ্বারা যে যোগাযোগ থাকে তা ব্যাহত করছে।
পরিশোধন প্রযুক্তির উন্নতি এবং বায়ুতে গ্যাস নির্গমনের ওপর কিছু বাধ্যবাধকতা থাকার পরও এখন ডিজেলের নিঃসরণ প্রধান পরিবেশ দূষকের একটি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডিজেল এবং জীবাশ্ম জ্বালানীর দহনের ফলে বিষাক্ত গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে অনেক দেশেরই নীতিমালা ও নির্দেশিকা রয়েছে। নিঃসরিত গ্যাসগুলোর ভিতর নাইট্রোজেন অক্সাইড অংশগুলো বেশি ক্রিয়াশীল যা একইসাথে মানুষের স্বাস্থ্য এবং উদ্ভিদের পরিবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করছে। যদিও এখন পুরো ইউরোপে জুড়েই নাইট্রিক অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইডের নিঃসরণ কমের দিকে। তবে চীনের মত দ্রুত অর্থনৈতিক প্রগতি লাভ করা দেশগুলোতে এই নিঃসরণের পরিমাণ লক্ষণীয়ভাবে বেশি।
সরিষা গাছ আটটি রাসায়নিক উপাদানের মিশ্রণে সুগন্ধ তৈরি করে। পরীক্ষার জন্য এই রাসায়নিক উপাদানগুলোকে ডিজেল নিঃসরণের ফলে সৃষ্ট দূষণে রাখা হয়। দূষণের এক মিনিটের মধ্যে চারটি উপাদানের পরিমাণ কমে যায় এবং এদের মধ্যে দুটোকে চিহ্নিত করা যায়নি। অর্থাৎ, এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে ফুলের গন্ধ পরিবর্তন মৌমাছিদের ফুল নির্ণয় করার ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে।
মৌমাছির দ্বারা পরাগায়ন শস্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মৌমাছি বিভিন্ন ফুলের সুগন্ধের মাত্রা এবং ধরণ থেকে তাদের পার্থক্য করে। সঠিক গাছ খুঁজে পাবার জন্য তাদের ঘ্রাণের দ্বারা গাছ চিহ্নিত করার ক্ষমতা থাকা জরুরী। মৌমাছি এক ফুল থেকে পরাগ সংগ্রহ করার পর সুগন্ধের রাসায়নিক পরিবর্তন চিহ্নিত করতে পারছে না। গন্ধ পরিবর্তনের ফলে একই প্রজাতির গাছ চিহ্নিত করতে না পারায় ভুল জায়গায় পরাগ পৌঁছে দিচ্ছে তারা। সুগন্ধ দ্বারা ফুল চিহ্নিত করতে পারার ক্ষমতা বিনষ্ট হওয়ায় তাদের হয়ত এই ক্ষতিপূরণের জন্য অন্য প্রত্যঙ্গ ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়বে। ঘ্রাণ সংযোগ বিনষ্ট হওয়ার ফলে তা বিভিন্ন কীটপতঙ্গের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। পরাগবাহীদের জন্য উদ্ভূত এই পরিস্থিতি ব্যহত করবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বাস্তুসংস্থানিক বৈচিত্র্য এবং এদের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য পরিবেশগত বৈশিষ্ট্যগুলোকে। এছাড়াও খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাবে যা পুরো বিশ্বে ফেলবে বিরূপ প্রভাব। বিষাক্ত গ্যাসগুলোর এই নিঃসরণ অতিসত্ত্বর ঠেকানো না গেলে ভবিষ্যতে হয়তবা গুরুতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে আমাদের।