মৃত্তিকা- জীবন ধারণে, সংস্কৃতিতে, সৌন্দর্যে…

মনিজা মনজুর

মৃত্তিকা কারো কাছে শুধুই কাদামাটি, কারো কাছে অপরিচ্ছন্ন জায়গা, কারো কাছে সোনাফলা অমূল্য রতন, আবার কারো কাছে শিল্পের আধার! মাটির আছে নানান রূপ। সে তার বৈচিত্র্যময় রূপ নিয়ে শুধুমাত্র ফসলের যোগান দেয় তা নয়, এটি আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকেও ধারণ করে আসছে যুগ যুগ ধরে। আন্তর্জাতিক মৃত্তিকা বর্ষের অক্টোবর মাসের প্রতিপাদ্য বিষয়- মাটি ও আমাদের ব্যবহারযোগ্য পণ্য।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দা থেকে শহরাঞ্চলের বাসিন্দারা মৃত্তিকা থেকে প্রত্যক্ষভাবে বিচ্ছিন্ন। মূলত পরোক্ষভাবে তারা মাটির উপকারিতা ভোগ করেন। ক্ষেত খামার থেকে শহর-গ্রাম-মফস্বল সর্বক্ষেত্রের মানুষের পাতে খাবার তুলে দেয় মৃত্তিকা। মৃত্তিকায় বেড়ে ওঠা তাজা ফসলের বদৌলতেই শহরাঞ্চলের মানুষের পুষ্টি চাহিদা মেটে।

Improve-Soil-Quality

অন্যদিকে মৃত্তিকা হাজার বছর ধরে শিল্প-সংস্কৃতির বাহক হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ আর নতুন কিছু নয়। বাংলার ঐতিহ্য মিশে আছে মৃৎশিল্পে। কাদামাটির আঠালো ভাবের কারনে এটি মৃৎশিল্পে ব্যবহারের উপযোগী। মৃৎশিল্পে যে কাদামাটি ব্যবহার করা হয় তা একটু ভিন্ন ধরনের। সাধারণ এঁটেল মাটি, বালি, বালি মাটি, রঙ, বিটুমিন, খড় ও পানি কাঁচামাল হিসেবে উল্লেখযোগ্য। ব্যবহারযোগ্য মাটি অনেক সময় নদীর অববাহিকায় পাওয়া যায়, আবার কয়েক হাত খননের পরই এ মাটির সন্ধান পাওয়া যায়। উপরিভাগের মাটি কিছুটা কালচে, যতই নিচের দিকে যাওয়া হয় মাটির রঙ হালকা হতে থাকে। বালির স্তরের কাছাকাছি মাটির রঙ ছাই বর্ণের হয়। মৃৎশিল্পের কাদামাটিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-

১। রিফ্রাকটরি অর্থাৎ কঠিন। এটি দিয়ে ইট, ঝামা প্রভৃতি তৈরি হয় এবং তা ১৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রাতেও অবিকৃত থেকে যায়।

২। ভিট্রিফিয়েবল অর্থাৎ যে মাটি কাচে পরিনত হয়। এটি প্রায় ১৩৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় দ্রবীভূত হতে পারে এবং অধিক পরিমাণে নিঃসৃত পদার্থ ধারণ করে যা কাদা ও পানির সংমিশ্রণে ঘনীভূত হয়ে কাচের আকার ধারণ করে।

৩। ফিউজিবল অর্থাৎ দ্রবণীয়। পৃথিবীর সব জায়গাতে পাওয়া যায়। প্রায় ১২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বিকৃত হয়। এই মৃত্তিকার উপাদান হিসেবে লৌহ বিদ্যমান এবং লাল ইট তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও পানির নিচে অপেক্ষাকৃত কালো রঙের কাদামাটি পাওয়া যায়। যা পোড়ালে সাদা রং ধারণ করে।

Desktop

বাংলার মৃৎশিল্পীরা তাদের সুনিপুণ হাতের কারুকার্যে সামান্য মাটির দলা থেকে সৃষ্টি করে চলেছেন দারুন সব ঐশ্বর্য। তাদের হাত ধরেই মাটির কলস, হাঁড়ি, সরা, বাসন-কোসন, পেয়ালা, সুরাই, মটকা, জালা, পিঠে তৈরির নানা ছাঁচ  আবহমান বাংলার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।

শালবন বিহার, মহাস্থানগড়, পাহাড়পুরের বৌদ্ধস্তূপ ও দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দিরে নকশা করা পোড়ামাটির ফলক- টেরাকোটার কাজ রয়েছে। তা ছাড়া বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, নরসিংদীর উয়ারী বটেশ্বরে পাওয়া গেছে প্রায় হাজার বছর আগের সভ্যতার নিদর্শন। মাটির খুঁড়ে পাওয়া গেছে নানা ধরনের মাটির সুন্দর পাত্র আর ফলক।

দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দিরের দেয়ালে টেরাকোটার কাজ
দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দিরের দেয়ালে টেরাকোটার কাজ

সৌন্দর্য চর্চায় মৃত্তিকার অবদান কিন্তু কম নয়! ত্বককে দূষনমুক্ত এবং পরিষ্কার রাখতে রমনীরা মাটির তৈরি ফেসপ্যাক ব্যবহার করে থাকেন। মাটিতে বিভিন্ন খনিজ উপাদান এবং জৈব পদার্থের উপস্থিতির কারনে ত্বক পরিষ্কার করতে কিছু বিশেষ ধরনের মাটি ব্যবহৃত হয়। যার মধ্যে আছে-

১। বেনটোনাইট ক্লে- যাতে আছে ব্যাকটেরিয়ারোধী উপাদান

২। গ্রীন ক্লে- লৌহ এবং ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ, যা তেল শুষে নেয়

৩। হোয়াইট ক্লে- কায়োলিন নামক খনিজ সমৃদ্ধ, যা ত্বকে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমন রোধ করে, ত্বকে স্বাভাবিক আর্দ্রতা বজায় রাখে

৪। ফুলার আর্থ বা মুলতানি মাটি- ব্যাকটেরিয়া এবং বিষাক্ত পদার্থ শোষন করে, এর গঠন অনেকটা বালুর মত বলে সহজেই ত্বকের ময়লা পরিষ্কার করে

Desktop1

কী অবাক হচ্ছেন? মাটি যে সৌন্দর্যচর্চার পসরা সাজিয়ে বসেছে! তাহলে বুঝতেই পারছেন, খাদ্য যোগান থেকে শুরু করে ঐতিহ্যের ধারা এমনকি সৌন্দর্যবিকাশেও মাটির অবদান কতখানি। চলুন, মাটিকে ক্ষয়রোধ হতে বাঁচাই, কারণ মাটি জীবন ধারণ করে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics