প্রকৃতির জন্য গান; কোল্ডপ্লেঃ পর্ব-১
ফারজানা হালিম নির্জন
“And the tears come streaming down your face
When you lose something you can’t replace
When you love someone, but it goes to waste
Could it be worse?
Lights will guide you home
And ignite your bones
And I will try to fix you…”
চোখ বুজলে,এমনই শীতল অনুভূতির অন্তরালে ডুবে যেতে হয়। জীবনানন্দের কবিতার মত তখন,পৃথিবীকে মায়াবী নদীর পাড়ের দেশের মতো মনে হয়। যত অবসাদ, ক্লান্তি সব দূর হয়ে যায় এক নিমিষেই। হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা অব্যাক্ত কথা, অপ্রকাশিত অনুভূতি গুলোর দরজা খুলে যেতে থাকে এক এক করে। সুর আর ছন্দের ভাজে ভাজে বার্তা ভেসে বেড়ায়, সুরেলা কথার মাঝে লুকিয়ে থাকে অদম্য শক্তি। জীবনকে নতুন করে আবিষ্কারের নেশায় বিভোর হয়ে যেতে হয়। মেলোডি ধাচের গান যেসব শ্রোতাদের নিত্যদিনের সঙ্গী আর বেঁচে থাকার প্রেরণা, তাঁরা বুঝতে একদমই ভুল করেন নি। কোল্ডপ্লে(Coldplay) ব্যান্ডের অসাধারণ একটি গানের কিছু পংক্তি তুলে দেয়া হয়েছে এখানে।
জীবনকে ভালোবাসতে পারা, আর জীবনকে ভালো বাসাতে পারা- এই দুইয়ের মিশ্রণেই যাদের গোটা অস্তিত্ব, সেই কোল্ডপ্লে(Coldplay) ব্যান্ডের কিছু জানা এবং অজানা কথা থাকছে আজকের ‘প্রকৃতির জন্য গান’ সিরিজের প্রথম পর্বে।
১৯৯৮ সালে, ভোকালিস্ট ক্রিস মার্টিন এর নেতৃত্বে কোল্ডপ্লে(Coldplay) নাম এবং সর্বমোট ৪ জনের দল হয়ে শ্রোতাদের সামনে হাজির হয় এই বৃটিশ রক ব্যান্ডটি। ২০০০ সালে হুট করেই একটি গানের মাধ্যমে গোটা বিশ্বে আলোড়ন তুলে শ্রোতাদের হৃদয়ের অনেক কাছাকাছি চলে যায় সদ্য জন্ম নেয়া এই ব্যান্ডটি। ‘Yellow’ গানটি ছিলো সেই সাফল্যের হাতিয়ার…
“Look at the stars,
Look how they shine for you,
And everything you do
Yeah,they were all yellow…”
প্রিয় মানুষেরা যখন ভালো কিছু করে, তখন ভালো লাগার সীমা মনে হয় ছাড়িয়েই যায়। কোল্ডপ্লে(Coldplay) ব্যান্ডের সদস্যরা অসাধারণ গানের সাথে সাথে বিশ্বকে প্রাণ ঢেলে দিয়ে যাচ্ছেন আরো অনেক কিছু, যা হয়তো আমরা জানিনা। মানুষকে ভালোবেসে, বিশ্বকে ভালোবেসে তাঁদের এই আত্মত্যাগের কথা শুনলে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা আরো বহুগুণ বেড়ে যাবে। শুনে আসি তাঁদের সুরের সেই গভীর বার্তা…যেখানে স্পর্শ আছে প্রকৃতির, স্পর্শ আছে ভ্রাতৃত্ববো্ধের, স্পর্শ আছে জীবনের…
জন্মলগ্নের শুরু থেকেই কোল্ডপ্লে, তাঁদের লাভের ১০ শতাংশ দান করে আসছে বিভিন্ন সাহায্য সংস্থায়। এখন পর্যন্ত তাঁরা সেই পথ থেকে সরে আসেন নি। বরং দিনের পর দিন উদারতার পরিধি যেন একটু একটু করে বাড়িয়েই চলেছেন । ক্রিস মার্টিন জানেন, যেকোনো সমস্যা দূর করতে সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র হলো মানুষের কন্ঠ। আর সেই উপলব্ধিকেই লক্ষ্য ধরে এগিয়ে যাওয়া কোল্ডপ্লে’র এবং নিত্য নতুন গান উপহার দেয়া গোটা বিশ্বকে। তাঁদের প্রত্যেকটি কনসার্ট এ যাওয়া মানে, শুধুই গান শোনা নয়, বরং নিজেকে পুনরায় নতুন করে আবিষ্কার করতে পারা। বুঝতে পারা, পৃথিবীর ক্ষুধার্ত মানুষদের পাশে থাকা কতটা জরুরী…
আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান অক্সফাম এর সাথে যুক্ত হয়ে তাঁরা ২০১২ সালে GROW ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে সহযোগীতার হাত বাড়াবার কথা ছড়িয়ে দেন। এছাড়াও এমোনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল (Amnesty International) এর সাথে সরাসরি যুক্ত হয় কোল্ডপ্লে। তাঁরা কঠিন সেই সত্য অনুধাবন করতে পেরেছিলেন…যেসব মানুষেরা আমাদের জন্য ক্ষেতে-খামারে দিন-রাত পরিশ্রম করে খাবার উৎপাদন করেন, তাঁরা নিজেদের পরিবার নিয়ে কতটা অসহায়, কতটা ক্ষুধার্ত ! ক্ষুধার্ত মানুষ বিহীন একটি পৃথিবীর কল্পনা, এই একইরকম ভাবনা ব্যান্ডের প্রত্যেক সদস্যকে এক করে রেখেছে সবসময়।
শুধু তাই নয়, সচেতন মানুষ হিসেবে তাঁরা যুগান্তকারী সাক্ষর রেখে গেছেন কার্বন নির্গমন রোধ কিংবা ‘কার্বন নিউট্রালিটি’ অর্জনের ক্ষেত্রে। ২০০৯ সালে নিউজিল্যান্ডের ‘এমিরেটস প্যালেস হোটেল’-এ বিশাল পরিসরে তাঁদের একটি কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছিলো, যেখানে বৈদ্যুতিক শক্তি প্রদান করা হয়েছিলো ‘উইন্ড ফার্ম’ থেকে! উইন্ড ফার্ম পরিবেশ বান্ধব নবায়নযোগ্য এক মাধ্যম, যা টারবাইনের সাহায্যে বাতাসের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত এনার্জি উৎপাদন করে। উইন্ড ফার্ম বেশ ব্যায়সাপেক্ষ হওয়া স্বত্তেও মিউজিশিয়ান হিসেবে, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলার এক অসাধারণ প্রক্রিয়া ব্যাবহার করে কোল্ডপ্লে। এছাড়াও পরিবেশে কার্বন এর ভারসাম্য আনার জন্য কোল্ডপ্লে সহ অনেক শিল্পীই নিয়মিত গাছের চাড়া রোপন করে আসছেন, যা পরবর্তিতে ‘ট্রি হাগিং কমিউনিটি’ নামে একটি সংগঠন হিসেবে গড়ে উঠে।
ক্ষুধার্ত মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আর প্রাণের পৃথিবীতে নির্মল বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য Coldplay-এর চেষ্টা, এগিয়ে আসা মাইলফলকের মত। যাদের প্রাণ বিশুদ্ধতায় ভরপুর, তাঁদের পথচলা কি কখনো থেমে থাকে? তাঁরাও থামেন নি। ভবিষ্যতের স্বপ্নঘেরা কচি মনের শিশুদের ছোট ছোট হাত তাঁরা নানাভাবে ধরেছেন, হাত ধরে একটু সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য। ‘Children with AIDS’, ‘Keep A Child Alive’, ‘St. Jude Children’s Research Hospital’, ‘Make A Child Smile Appeal’ এর মত সংস্থাগুলোর সাথে কোল্ডপ্লে সবসময় জড়িত রেখেছে নিজেকে। ‘A Message’ গানটিতে ক্ষানিকটা পরিবর্তন এনে হাইতি ভূমিকম্পের শিকার হওয়া মানুষদের জন্য অর্থ জোগানের উদ্দেশ্যে ২০১০ সালে ‘A Message 2010’ তাঁদের কন্ঠে নতুনভাবে আওয়াজ তোলে। ২০১১ সালে তাঁরা ‘OneWorld’ নির্মিত ‘Freedom For Palestine’ গানটি শোনার আহ্বান জানিয়ে তাঁদের ফেসবুক ওয়ালে একটি পোস্ট দেন। এতে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। পোস্ট মুছে ফেলার আহ্বান জানিয়ে কেউ কেউ এই কারণে ব্যান্ডটিকে নিষিদ্ধ করার হুমকীও দেয়। কিছুদিন পর পোস্টটি আর দেখা যায়না। কিন্তু OneWorld এর ফ্র্যাংক বারাত নিশ্চিত করে জানান, ফেসবুক থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই পোস্ট মুছে গেছে, যেহেতু কিছু মানুষ অবমাননাকর পোস্ট হিসেবে এটিকে রিপোর্ট করেছিলো। কিন্তু কোল্ডপ্লে এটিকে মুছে ফেলেননি। এভাবে নির্ভয়ভাবে ন্যায়ের পাশেই কোল্ডপ্লে-এর অবস্থান সবসময়।
বাণিজ্য আর গান বোধ হয় কখনো একসাথে হয়না। তারই প্রমাণ কোল্ডপ্লে। গান কিনে নেয়ার বিনিময়ে মিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁরা অকপটে। ক্রিস মার্টিনের মতে, ‘আমরা আমাদের নিজেদের মধ্যে বাস করতে অক্ষম হবো, যদি আমরা আমাদের গান বিক্রি করে দেই।’ শিল্পীর সার্থকতা তো এখানেই। মহৎ মনের অধিকারী না হলে এতো এতো উৎসাহ কিভাবে তাঁরা গানের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে এখনো ! পৃথিবীর মায়ায় নিজেদের উজার করে দিয়ে কত মানুষকে প্রাণের গান উপহার দিচ্ছেন তাঁরা। মায়াবী সুর আর চমৎকার কথার গাঁথুনি দিয়ে মাতিয়ে রেখেছেন বিশ্বকে। এই হচ্ছে Coldplay। হৃদয়ের গভীর ছন্দেই যাদের বসবাস আর মানবতার শুদ্ধতম পথেই যাদের নিরন্তর যাত্রা।