এক পানির অণুর বয়ান!
আমি পানির অণু।দুইটি হাইড্রোজেন আর একটি অক্সিজেন এর সমন্বয়ে এই দুনিয়ায় আমার পদচারণা শুরু। আমি সাক্ষী হয়ে আছি যুগ যুগ ধরে ঘটে যাওয়া অনেক ইতিহাসের। কোন এক অনুকূল পরিবেশে আমি নিজেকে বাংলাদেশে আবিষ্কার করি! সেখানের এক পুকুরে ছিলো আমার অবস্থান। ভালোই কাটছিল আমার দিনগুলি।
এক সময় দেখলাম, এক পানি গবেষক একটি সাদা বোতলে করে আমাকে সহ আমার সহজাত ভাইদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে! কিছুই করার ছিল না। শুধু নীরবে অবলোকন করলাম তার কারবার খানা!
আমাদের বন্দি করলো একটি শীতলকারক যন্ত্রে। ঠাণ্ডায় আমরা জমে যাচ্ছিলাম।
পরেরদিন সকালে সাদা এপ্রোন পড়া এক মহিলা আমাদের বের করে নিল! ভাবলাম এই বুঝি আমাদের মুক্তি দিবেন। কিন্তু হায়…সেই মহিলা ওই গবেষকের দিকেই যাচ্ছিলেন। আমরা এতোগুলো ভাই থাকা সত্ত্বেও কিছুই করতে পারলাম না!
গবেষক একটি ১০০ মিলিলিটার এর বীকার নিলেন। বুঝতে আর বাকি রইল না যে, ১০০ মিলিলিটার বীকারের মধ্যে যারা পড়বে, তাদের আর রক্ষা নেই!
ভীতু মন নিয়ে প্রার্থনা করতে থাকলাম যেন আমরা ওই বীকারের ভিতরে না পরি। পরে দেখলাম, আমরা কতিপয় ভাইয়েরা বেঁচে গেছি এই যাত্রায়!.. সেই গবেষক পরে আমাদেরকে তার গবেষণাগারের পাশের একটা নদীতে ফেলে দিল। কিন্তু হায় আমরা সেই বন্দি অবস্থায়ই রয়ে গেলাম। কেননা বোতল সহ আমাদেরকে সেখানে ফেলে দিল!.. অপেক্ষায় ছিলাম, কবে আমাদের মুক্তি ঘটবে এই বোতল থেকে!
একদিন এক ভিক্ষুক নদীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি সাদা বোতলটি লক্ষ করলেন। আর কি মনে করে যেন আমাদের মুক্ত করে দিলেন আর বোতলটি নিয়ে প্রস্থান করলেন।
কি কারণে আমাদের মুক্তি দিল,তা অজানাই থেকে গেল!
এক ক্ষরার মৌসুমে নদীর পানি যখন শুকিয়ে যাচ্ছিল,সেই মুহূর্তে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে নিজের শারীরিক অবস্থা পরিবর্তন করে জলীয় বাষ্পে পরিণত হই! আর ভাসতে থাকি অজানা উদ্দেশ্য! তখন ভেসে ভেসে দেখতে থাকি দেশের হালচাল! যখন দেখি আমাদের দিয়ে ব্যবসা করে দুনিয়ার মানুষগুলো সফল হয়, তখন নিজের কাছে অনেক ভাল লাগে। দেশের কতিপয় মানুষের অমানবিক আচরণ দেখলে আবার খারাপ লাগে। তবে, ওই সকল মানুষের প্রতি ঘৃণা জন্মায় যারা, পানি দূষণ করে যাচ্ছে কোন সংকোচ ব্যতীত! বিশেষ করে,ঢাকার বুড়িগঙ্গা আর বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর পানি দূষণের হার অনেক বেশি! তবে কিছু সচেতন নাগরিকদের সজাগ দৃষ্টি থাকায় দূষণের হার অতি দ্রুত কমবে বলে আশা করা যায়।
আমি সাক্ষী থাকি অনেক অজানা ঘটনার যা আজ অবধি সাধারণ মানুষ এর কাছে প্রকাশিত হয় নি। আমাকে চুপ থাকতে হয়। কারণ আমার কথা শোনার সময়টুকু নেই এই মানুষ গুলোর। আমি যে নিতান্তই এক পানির অণু মাত্র!
আকাশে অনবরত ঘটে যাওয়া রসায়ন আমি অবলোকন করি,আর নীরবে হাসি!
একসময় আমি আবিষ্কার করি, আমার শরীর তাপ শোষণ করার ক্ষমতা রাখে! আর তখনই বুঝলাম,আমি সাধারণ কোন গ্যাসীয় পদার্থ না। আমি গ্রীণ হাউস গ্যাস! তখন নিজের কাছে খুব খারাপ লাগছিল এই ভেবে যে,আমার কারণে এই গ্রহের তাপমাত্রা দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছে। বায়ুমণ্ডল এ ভাসতে ভাসতে দেখা হলো, আরো অনেক গ্রীণ হাউস গ্যাসের সাথে। দেখা হলো কার্বন ডাই অক্সাইড ও তার ছোট ভাই কার্বন মনোক্সাইড এর সাথে! ওরা সবাই আমার মত নিরুপায়! অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমরা এই পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে মানুষ এর টিকে থাকার ব্যাপারে তাদের মনকে প্রশ্ন বিদ্ধ করছি! আরো উপরে দেখা হলো এক বিশাল গর্তের সাথে! নাম জিজ্ঞাস করায় উত্তম পেলাম “ওজোন হোল”!
ঘাবড়ে গেলাম এমন নাম শুনে!তারপর সেই ওজোন হোল তার করুণ পরিণতি তুলে ধরলো।পৃথিবীর জন্য উপকারী ওজোন স্তর এর ক্ষয় হতে হতে তার জন্ম! সেও আমাদের মত নিরুপায়।ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও তার ভিতর দিয়ে অতিক্রম করছে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মিগুলি! আর সেটা দুনিয়াবাসীর জন্য এক চরম বিপদ সংকেত!
আমি ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টি রূপে ফিরে আসলাম মাটির কাছে। আমি নিজেকে প্যারিস এ আবিষ্কার করলাম! অনেক সুন্দর নগরী এটি। মানুষ গুলো অনেক পরিশ্রমী! প্যারিস শহরের কিছু জায়গা ভ্রমণের পর যাত্রা শুরু করলাম পাতালের দিকে। পাতালে যেতে যেতে দেখা হল মাটির বিভিন্ন স্তর এর সাথে! এক এক স্তর এক এক রকম! কারো জৈব পদার্থ বেশি, আবার কারো খনিজ অংশ বেশি। কিন্তু একটু গভীরে গিয়ে মুখোমুখি হলাম অনেক অজানা ছোট প্রানীর সাথে! তারা নাকি মাটি তৈরিতে ভূমিকা পালন করে!
আরো দেখলাম, সোনা আর হীরার খনি! দেখা হলো কয়লার খনির সাথেও। মজার ব্যাপার হলো, হীরা আর কয়লা নাকি একি মায়ের পেটের ২ ভাই! কিন্তু দেখে কিছুতেই বুঝা যাচ্ছিল না! একজন কালো,অন্য জন চকচকে!
তারপর পাতালের এক পাশ থেকে অন্য পাশে যাত্রা শুরু করলাম। কতো কি যে দেখলাম যাত্রাকালে! পাতালের পানির ভাণ্ডার গুলো দিনে দিনে শুকিয়ে যাচ্ছে। কি যে হবে সেই পানি প্রিয় মানুষ গুলোর! পানি ছাড়া কিভাবে ওরা দুনিয়ার বুকে টিকে থাকবে? ভাবলেই গা শিউরে ওঠে!
আচমকা উপরের দিকে টান অনুভব করলাম। আটকা পরলাম এক নলের মধ্যে।বুঝতে আর বাকি রইল না যে,দুনিয়ার মানুষ এর পানির যোগান দিতে উপরের দিকে আমাকে টেনে তুলছে।
আমি আজ অনেক খুশি! আমি প্রথম নিজেকে যে দেশে আবিষ্কার করি, সেখানেই ফিরে আসলাম আবার! সেই দেশ হল “বাংলাদেশ”। আমার প্রাণের দেশ! খুব ভালবাসি এই দেশের মানুষ গুলোকে। খুবই ভালো লাগে এই দেশের মাটির গন্ধ। এতো দিন খুব মনে পড়ছিল এই দেশের মানুষ এর আতিথেয়তা! তারপর আমরণ আমি থেকে যাই এই দেশের মানুষের কাছে! ঘুরে বেড়াই এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি। অবলোকন করি, মানুষের হাসি-কান্না,আনন্দ-উল্লাস। আরো অবলোকন করি, মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা, প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি মানুষের অকল্পনীয় প্রেম, জীব ও গাছপালার প্রতি ভালবাসা! এছাড়াও অবলোকন করি,দেশের প্রতি মানুষের ভালবাসা,”দেশপ্রেম”।
মো:নাঈম হাসান (মুন্না)
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
সয়েল এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস (SES)