জেব্রার ডোরা কাটা দাগের নেপথ্যের রহস্য !
সাফায়াত উল্লাহ নিয়াম
আমরা সবাই হয়তো কমবেশি জেব্রা দেখেছি এবং এর সম্পর্কে জানি। সাদা আবরণের মাঝে কালো ডোরাকাটা দাগগুলো অনে সুন্দর, তাই না? প্রতিটা জিনিসের পিছনে একটা ‘কিন্তু’ থেকেই যায়। কিন্তু কেন এই ডোরাকাটা দাগ? অবশ্যই কোন প্রয়োজনেই এই দাগের সৃষ্টি। মাঝে মাঝে অনেক অপ্রয়োজনীয় জিনিসও প্রয়োজনে আসে…বৈ কি? কিন্তু ডোরাকাটা দাগগুলো প্রয়োজনীয় কিংবা অপ্রয়োজনীয় সেই প্রশ্ন নিয়তই আসবে। তো দেখা যাক…
জেব্রার ডোরাকাটা দাগগুলো মূলত তাদের ছদ্মবেশ ধারণ করার জন্য বিশেষ উপযোগী। এই দাগগুলো শিকারীদের দৃষ্টিভ্রম করার জন্য এবং মাছি তাড়ানোর জন্য যথেষ্ট। যদিও প্রাচীন মতবাদের দিকে তাকালে দেখা যায়, চার্লস ডারউইন বলেছেন, “দক্ষিণ আফ্রিকার সমতল ভূমিতে ডোরাকাটা দাগগুলো কোন প্রভাব ফেলতে পারে না”। বহুদিন এই মতবাদ চলে আসলেও বিজ্ঞান ভিত্তিক ও যুক্তিনির্ভর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই মতবাদের আমূল পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে।
কোইনল্যান্ড ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক জেব্রার দলবেঁধে চলাফেরা লক্ষ্য করেন। এতে তাঁরা গবেষণা করে পেয়েছেন ডোরাকাটা দাগ ২ প্রকার দৃষ্টিভ্রম সৃষ্টি করে, যা শিকারী প্রাণিদের থেকে তাদের বাঁচিয়ে রাখে।
দৃষ্টিভ্রমতার প্রথম পর্যায়কে বলা হয় চাকার কামরার ফলাফল। এটা বুঝতে হলে একটি উদাহরণ দেয়া লাগে। একটি হেলিকপ্টারের পাখার ব্লেড কল্পনা করা যাক। কিন্তু এটা ঘুরার সময় এক নাগারে ঘুরতে থাকলে একদৃষ্টে চেয়ে থাকলে দেখা যাবে এর পাখাগুলো বিপরীত পাশ থেকে ঘুরে আসছে। যাকে আমরা দৃষ্টিভ্রম হিসেবে বলে থাকি। এমনকি গোলাকার গতিশীল যেকোনো বস্তুর (যেমনঃ সাইকেলের চাকা, ফ্যান ইত্যাদি) ক্ষেত্রেও এরকম দৃষ্টিভ্রমের সৃষ্টি হয়ে থাকে। আর দ্বিতীয় পর্যায়কে বলা হয় বারবারপোল ইলিউশন (Barberpole Illusion)। এই পর্যায়ে ডোরাকাটা দাগগুলো আনুভূমিকভাবে নড়ে; কিন্তু আমরা একে লম্বালম্বিভাবে নড়তে দেখি। বাস্তবিকপক্ষে এই দৃষ্টিভ্রমের ব্যাপারটা পুরোই অসম্ভব !
পূর্বের আলোচনায় দেখা যায়, এই দুই প্রকার দৃষ্টিভ্রম যা জানলাম মূলত কাজে লাগে জেব্রার শিকারীদেরকে ফাঁকি দেয়া এবং পোকামাকড়দের প্রতিহত করা ক্ষেত্রে। আফ্রিকার গহীন অরণ্যে কিংবা অন্যান্য বিভিন্ন জঙ্গলে যেগুলো জেব্রার বিচরন ক্ষেত্র, সেখানে জেব্রারা তাদের ডোরাকাটা দাগের মাধ্যমে প্রাণীর চোখে ধুলা দেয়;যারা জেব্রা শিকার করে খায়।
কিন্তু এরা যেহেতু ডোরাকাটা দাগ দেখিয়ে ছদ্মবেশী হয়, সেহেতু আপনার হয়তো মনে হবে যে আফ্রিকার গহীন অরণ্যেরে গাছপালা সাদাকালো বলে জেব্রারা তাতে মিশে যায়। কিন্তু আসলে তা নয়! আমরা সবাই জানি কিংবা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে দেখেছি সিংহ জেব্রাদের আহার করে বেঁচে থাকে। কিন্তু একটা বিষয় জেনে রাখা দরকার যে, সিংহ কালার ব্লাইন্ড বা বর্ণান্ধ। তাঁরা নির্দিষ্ট কিছু রং আলাদা করে চিনতে পারে না বা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। ওদের জগতটাই সাদা কালো। ওরা মূলত হালকা সাদা, হালকা কালো বুঝতে পারে স্পষ্টভাবে। কিন্তু বর্ণান্ধতার ফলে ওদের পক্ষে জেব্রার উপস্থিতি চিহ্নিত করতে বেশ কষ্টকর হয়। সেজন্যই সিংহের চোখে ধুলা দেয়ার জন্য সাদাকালো দোরাকাটা দাগগুলো বেশ কাজে দেয়।
ছদ্মবেশী রুপটা তখনই ফুঁটে উঠে যখন তাঁরা একসাথে দলবেঁধে চলাফেরা করে। আরেকটা ব্যাপার হলো, মানুষের হাতের রেখা যেরকম একজনের সাথে আরেকজনের মিলে না, ঠিক তেমনই জেব্রাদের ডোরাকাটা দাগগুলো একটা জেব্রার সাথে আরেকটার মিলে না। এতে বেশ অনেকখানি তফাৎ দেখা যায়। কিন্তু এদের ডোরাকাটা দাগগুলো যদি এক রকম হতো তবে দেখা যেতো যে, এরা এক সমতলে হেটে যাচ্ছে। এতে এরা যে জেব্রা তা সুস্পষ্টভাবে বুঝা যেতো। তাই নয় কী? এতে কিন্তু তাঁরা শিকারীর চোখে ধুলা দিতে পারতো না। যেহেতু এদের ডোরাকাটা দাগগুলো একে অপর থেকে ভিন্ন, তাই এরা চলার সমইয় দেখা যায় দাগগুলো আনুভূমিকভাবে নড়ছে। এতে করে অনেক দূর থেকে দেখলে দেখা যাবে, অদ্ভুত কিছু একটা নড়ছে। এটা একটা লক্ষন হতে পারে। আরেকটা ব্যাপার হলো , এদের অনেক দূর থেকে দেখলে দেখা যাবে এরা এলোমেলোভাবে সামনে পিছনে এগিয়ে যাচ্ছে। যার কারণে এরা আসলেই কোনদিকে যাচ্ছে তার সুস্পষ্ট কোন ধরণা পাওয়া যায় না। এটাও আরেকটা লক্ষন হতে পারে। যার কারণে সিংহ কিংবা অন্যান্য শিকারী তা দেখে এগুতে পারে না।
এছাড়াও এরা তাদের ডোরাকাটা দাগের মাধ্যমে রক্তচোষা পতঙ্গকে দূরে রাখে। জেব্রার গায়ের দাগে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে যার কারণে রক্তচোষা পতঙ্গ এতে আকৃষ্ট হয় না। এই বিষয়ে একটা প্রতিবেদন ইংরেজি বিজ্ঞান বিষয়ক ম্যাগাজিন “External Biology” তে প্রকাশিত হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা সেখানে আরো বলেছেন, ডোরাকাটা দাগগুলো রক্তচোষা পতঙ্গকে কতটুকু আকৃষ্ট করবে না তা নির্ভর করবে ডোরাকাটা দাগগুলো কতটুকু আলোর প্রতিফলন করে।
আবার দেখা যায়, মাছি কালো রঙ্গে বেশ আকৃষ্ট হয়। কিন্তু জেব্রার বেশির ভাগই সাদা হওয়ায় এবং আলোর অনুভূমিক প্রতিফলনের দরুণ মাছি আকৃষ্ট না হওয়ার পাশাপাশি দৃষ্টিভ্রমেরও শিকার হয়ে থাকে।
খুব সুন্দর না? প্রকৃতির আবাধ বিচরণ আর নিয়মের ফাঁদেই হোক কিংবা সৌন্দর্যের ব্যাপারই হোক, জেব্রাদের এই ডোরাকাটা দাগ তাদের নানাভাবে সাহায্য করছে। এগুলো তাদের উপকারে তো আসছে বটেই, এছাড়া শুধুমাত্র চোখের দেখাতেই কতটা মনোমুগ্ধকর!
লেখক,
এসএসসি, বিজিএফ স্কুল এন্ড কলেজ
ব্রাহ্মণবাড়িয়া।