
প্রকৃতিতে সালফারের ঘাটতি; বিশেষজ্ঞ কী বলছেন? পর্ব-১
দিব্য কান্তি দত্ত
প্রাণিজগতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হল সালফার। প্রাথমিক উৎপাদন অর্থাৎ, উদ্ভিদের খাদ্য তৈরি থেকে শুরু করে জীবজগতের ওপর সালফারের রয়েছে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বায়ুমণ্ডল থেকে প্রাণিজগৎ, পুরোটা জায়গা জুড়ে সালফার নামক মৌলটি ভ্রমণ করে একটি চক্রের সাহায্যে; যে চক্রটিকে আমরা সালফার চক্র হিসেবে চিনি। এই চক্রটি কিছু প্রক্রিয়ার সমন্বয় যার মাধ্যমে সালফার খনিজ মাধ্যম এবং জীবজগতের মধ্যে বিভিন্ন রূপে পরিভ্রমণ করে থাকে। সালফারের এই চক্রের প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে যে ধাপগুলো রয়েছে তা হল-
- সালফারের জৈব অবস্থা থেকে অজৈব অবস্থায় রূপান্তর
- সালফাইড যৌগ এবং সালফার মৌলের জারণ
- সালফেট থেকে সালফাইডে বিজারণ এবং
- সালফাইডের জৈব রূপে মজুদ হওয়া
শুধু জীববৈজ্ঞানিক দিক থেকেই নয়, ভূতাত্ত্বিক দিক থেকেও এই চক্র মহাগুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বিভিন্ন ধরণের খনিজের স্থায়িত্ব এবং পরিণতি নির্ভর করে এই চক্রের ওপরে। আর জীববৈজ্ঞানিক দিক থেকে তো এই চক্রের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, সালফার শুধু বাস্তুসংস্থানিক ভারসাম্য রক্ষা করতেই সহায়তা করেনা; এই সালফার হচ্ছে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় প্রোটিন এবং কো-ফ্যাক্টর এর সংগঠক উপাদান।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা হচ্ছে, এই চক্র সঠিকভাবে পরিচালিত হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ সালফার প্রয়োজন। অতিরিক্ততা অথবা সালফারের স্বল্পতা চক্রে ব্যাঘাত ঘটাবে। সালফার চক্র এই মূহুর্তে মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণ, বর্তমান পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে সালফারের পরিমাণ প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে। বিগত বিশ বছরের উপাত্ত নিয়ে ‘ইলিনয়িস বিশ্ববিদ্যালয়’র পরিচালিত সমীক্ষা এই তথ্যই দিচ্ছে। সমীক্ষা আরও বলছে, এর ফলে মধ্যপশ্চিমাঞ্চলের জলবিভাজিকা এবং নদীগুলোতে সালফারের পরিমাণ ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে যার প্রভাব পড়তে চলেছে কৃষিজমিতে। এর ফলে কৃষকদের কৃষিভূমিতে পৃথকভাবে সালফার প্রয়োগের প্রয়োজন হতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা।
বায়ুদূষণ নীতিমালা প্রণয়ন করে জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার নিয়ন্ত্রিতভাবে কমিয়ে ফেলাই এর অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তাঁরা। শক্তি উৎপাদনের জন্য দহন এবং বিভিন্ন শিল্পকারখানায় পণ্য উৎপাদনের জন্য দহন সালফারের প্রধান উৎস। এই দুই উৎস থেকে ২০১৩ সালে মোট সালফারের যথাক্রমে ৫২ শতাংশ এবং ২৮ শতাংশ নির্গত হয়। বিগত দুই দশকে জীবাশ্ম জ্বালানীর ওপর নিয়ন্ত্রণের মাত্রা বাড়ানোয় ২০০৯ সালে প্রকৃতিতে মোট সালফার নির্গমনের মাত্রা ছিল ০.৪১ মিলিয়ন টন। এরপর থেকে তা প্রতিবছর কমতে থাকে এবং ২০১৩ সালে এই নির্গমনের মাত্রা ছিল ২০১২ সালের তুলনায় ১০.৬ শতাংশ কম।
মানুষের কর্মকাণ্ডের ওপর সালফার চক্র ব্যাপকভাবে নির্ভর করে। কয়লার দহন, জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার, প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার, শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়া প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ডের ওপর সালফার নির্গমনের মাত্রা নির্ভর করে। আমেরিকায় বায়ুমণ্ডল এবং ভূপৃষ্ঠে নির্গত মোট সালফারের দুই-তৃতীয়াংশ নির্ভর করে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের উপর। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মানবজাতির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের (কিংবা অপকর্ম যাই বলুন না কেন) প্রভাব না থাকলে হয়তো সালফার ততদিন পর্যন্ত বড় বড় পাথরে আটকা পড়ে থাকত যতদিন না পর্যন্ত টেকটোনিক অ্যাক্টিভিটির ফলে পাথরগুলো ভূপৃষ্ঠে উঠে আসত এবং গঠনগত ও রাসায়নিক পরিবর্তনের শিকার হত।
এখন, দূষণ কমাতে জীবাশ্ম জ্বালানী, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি ব্যবহারের বাঁধাধরা নিয়ম বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে কিনা প্রকৃতিতে ফসল উৎপাদনের জন্য এবং তা নিয়ে ‘ইলিনয়িস বিশ্ববিদ্যালয়’র গবেষকদের মতামত, ধারণা, আশঙ্কা এবং ভবিষ্যৎ চিন্তা সম্পর্কে জানব পরের পর্বে…