পারদ বিষ থেকে বাঁচাতে সালফার-লিমোনিন সমৃদ্ধ নয়া প্রযুক্তি!
দিব্য কান্তি দত্ত
আপনার জন্য একটা কুইজ। “একমাত্র তরল ধাতুর নাম কি?” উত্তর নিশ্চয়ই মাথায় চলে এসেছে এতোক্ষণে? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন; ‘পারদ’ বা ইংরেজিতে ‘মার্কারী’। সংক্ষেপে এর পরিচয় দিতে গেলে- পারদের প্রতীক ‘Hg’, পারমাণবিক সংখ্যা ৮০, এর অবস্থান পর্যায় সারণির ষষ্ঠ পর্যায়ের দ্বাদশ গ্রুপে। এটি একটি ডি-ব্লক মৌল এবং এর ভর ২০০.৫৯২ গ্রাম। পারদের একটা ব্যবহার জানতে চাইলে প্রথমেই থার্মোমিটারের কথা মাথায় আসবে আপনার? জ্বরে আধমরা হয়ে থাকলে তো এই যন্ত্রই রোগী বেচারীর জ্বরের মাত্রাটা জানিয়ে দেয়। এছাড়া ম্যানোমিটার, ব্যারোমিটারেও ব্যবহার করা হয় এই মৌলটিকে। যাদের দাঁত কখনো ভেঙেছে এবং ভাঙা অংশ ভরাট করাতে হয়েছে তাদের অনেকেই হয়তো জানেন যে, দাঁতের ফাঁকা জায়গা ভরাট করার জন্য পারদের ধাতু সংকর বা অ্যামালগাম ব্যবহার করা হয়।
এতোক্ষণ পারদের অনেক গুণগান তো হলো; এত উপকারের ছলে আড়ালে-আবডালে এই মৌলটি কত অপকার করে চলেছে আপনার আর আপনার চারপাশের পরিবেশের সে খেয়াল কি রাখেন? মানুষের স্বাস্থ্যের অবনতির জন্য ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(WHO)’ এর বিবেচিত প্রধান দশটি রাসায়নিক উপাদানের একটি হল পারদ। এটি প্রধানত ‘নিউরোটক্সিন’। এরা নিউরনের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করে। মানুষের পুরো মস্তিষ্ক জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য নিউরন। পারদ নিউরন ধ্বংসের দ্বারা মস্তিষ্কের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে বাঁধাগ্রস্ত করে এবং স্নায়ুগুলোকে ভুল সংকেত প্রদানের দিকে ধাবিত করে। পারদ এবং এর যৌগ স্নায়বিক, পরিপাক প্রভৃতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিনষ্ট করে। এছাড়া ফুসফুস, বৃক্ক, ত্বক এবং চোখও এসব যৌগ দ্বারা প্রভাবিত হয়।
পারদ বা মার্কারীর যৌগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিষাক্ত হচ্ছে ‘মিথাইল মার্কারী’। পৃথিবী পৃষ্ঠে প্রচুর পরিমাণে পারদ পাওয়া যায়। এছাড়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগ এবং আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুতপাতের ফলে ভূগর্ভ থেকে এরা মাটির ওপরে উঠে আসে। এরপর বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবে এরা তৈরি করে মিথাইল মার্কারী। মানবদেহে এসব যৌগ ঢোকার একটা প্রধান মাধ্যম মাছ খাওয়া। এর ফলে পারদ বিভিন্ন প্রাণির দেহে, আরও সূক্ষভাবে বললে প্রতিটি কোষে ঢুকে যায়। এর ফলে দেখা দিতে পারে দীর্ঘ এবং গুরুতর ধরনের রোগ। গর্ভবতী মহিলাদের ভ্রূণের বিকাশ কমে যেতে পারে এসব যৌগের আক্রমণে, ধ্বংস হতে পারে ভ্রূণ, জন্ম হতে পারে বিকলাঙ্গ বাচ্চার। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে মানুষের পরিবেশ ব্যবহারের ধরন ও উৎপাদন ব্যবস্থার কারণে সাগরে পারদের পরিমাণ দশ শতাংশ বেড়ে গেছে। উৎপাদন প্রণালী, খনি খনন, তেল ও গ্যাস নিষ্কাশন, বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রভৃতি এখন পারদ এবং এর যৌগের মূল উৎস হয়ে উঠেছে।
এত ঝামেলার পরে এখন খুশির বিষয় হলো এই যে, প্রকৃতি থেকে ক্ষতিকর পারদ সরানোর জন্য অস্ট্রেলিয়ার ‘ফ্লিন্ডার বিশ্ববিদ্যালয়’র গবেষকরা একটি নতুন যৌগ আবিষ্কার করেছেন। এর নাম ‘সালফার-লিমোনিন-পলিসালফাইড’ যা পারদের সাথে যুক্ত হয়ে প্রকৃতি থেকে অপ্রয়োজনীয় পারদ সরিয়ে ফেলতে সহায়তা করবে। যৌগটি সালফার এবং লিমোনিনের সমন্বয়ে তৈরি একটি পলিমার। সালফার হাইড্রোজেনের সাথে যুক্ত হয়ে পচা ডিমের দূর্গন্ধ তৈরি করার জন্যই প্রখ্যাত। অপরপক্ষে লিমোনিন পাওয়া যায় কমলালেবুর খোসায় এবং অন্যান্য লেবুজাতীয় ফলে। প্রতিবছর পেট্রোলিয়াম শিল্পকারখানাগুলোতে ৬০ থেকে ৭০ মিলিয়ন টন সালফার উৎপন্ন হয়। অপরপক্ষে সাইট্রাস শিল্পকারখানা থেকে প্রতিবছর ৭০০০০ টন লিমোনিন প্রস্তুত করা হয়। বর্তমানে ব্যবহৃত পলিমারগুলোর অধিকাংশই পেট্রোলিয়ামের সীমাবদ্ধ সরবরাহ থেকে তৈরি করা হয়। তাই পারদ অপসারণের জন্য নতুন যৌগ প্রস্তুতির কাজে নতুন উৎসের খোঁজ পাওয়া দুঃসাধ্য। যেহেতু সালফার আর লিমোনিন দুটোই শিল্পকারখানার বর্জ্য থেকে অফুরন্ত পাওয়া যায়, সেহেতু এ দুটো উপাদান থেকে সালফার-লিমোনিন-পলিসালফাইড তৈরি অনেকটা এক ঢিলে দুই পাখি মারার মত ব্যাপার। অর্থাৎ, একদিকে যৌগ তৈরি করে বর্জ্যগুলো ব্যবহার করা যাচ্ছে এবং অপরদিকে তৈরিকৃত যৌগ দ্বারা পরিবেশ থেকে ক্ষতিকর পারদও দূর করা যাচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা সালফার এবং লিমোনিনের সমন্বয়ে এই পলিমারটি তৈরির পূর্বে দুটো রাসায়নিক উপাদানই পরীক্ষা করে দেখেছিলেন। সালফার এবং লিমোনিনের সাহায্যে খুব সহজেই পলিমার তৈরি করা যায়। পলিমারটিতে প্রচুর সালফার থাকার কারণে এই যৌগের ধাতুর প্রতি উচ্চ আসক্তি রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে এটিকে পানিতে ব্যবহার করা হলে এটি প্রথমবারেই পঞ্চাশ শতাংশের ওপরে পারদ অপসারণ করতে পারে। কয়েকবার ব্যবহারে এটি পানিকে খাবার উপযোগী করে তুলবে। এটি প্রস্তুতির খরচ যথেষ্ট কম হওয়ায় এটি পানি বিশুদ্ধকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার হলো, এই যৌগে পারদ মিশ্রিত হওয়া মাত্র এটি বর্ণ পরিবর্তন করবে। অতএব, একে পারদ চিহ্নিতকরণে নির্দেশকের ভূমিকায়ও ব্যবহার করা যাবে। বিজ্ঞানীরা এতটুকু নিশ্চিত হতে পেরেছেন যে, পলিসালফাইড যৌগটি বিষাক্ত নয়। তবে এটি স্বাভাবিকভাবেই নদী, হ্রদ কিংবা সাগরে ব্যবহার করা যাবে কিনা এ বিষয়ে তারা এখনো অনিশ্চিত।
গবেষকেরা বর্তমানে প্রধানত পরিবেশ এবং বাস্তুসংস্থানের ওপর এর প্রভাব নিয়ে পর্যালোচনা করছেন। এই গবেষণার অর্থ সংস্থানে আছে ‘ফ্লিন্ডারস পার্টনার্স’ এবং এতে গবেষণা ও আর্থিক উভয় ক্ষেত্রে সহযোগী হিসেবে আছে ‘টুলসা বিশ্ববিদ্যালয়’। ‘ফ্লিন্ডার বিশ্ববিদ্যালয়’র ‘সংশ্লেষ রসায়ন’র প্রভাষক এবং এই দলের গবেষক জাস্টিন চকারের মতে, “আমাদের লক্ষ্য মাটি এবং ভূগর্ভস্থ পানি থেকে এই পদার্থ ব্যবহারের দ্বারা পারদ অপসারণ করা। এছাড়া আমরা বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পানির ফিল্টারেও এই পদার্থ ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে চাইছি। আশা করছি আগামী এক বছরের ভিতরেই আমরা তা করতে পারবো। সবচেয়ে বড় কথা, আমরা অন্যান্য বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীদের অকস্মাৎ আসা দূর্যোগের জন্য অতিসত্ত্বর ব্যবস্থা গ্রহণ করার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে চাই।”