সুন্দরবন ট্র্যাজেডিঃ এটিই উপযুক্ত বিশেষণ নয় কি!!
রাফী শামস
গত ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ডুবে যায় তেল বাহী ট্যাংকার ‘সাউদার্ন স্টার- ৭’।শ্যালা নদীর পানি হারিয়ে যায় পুরু-তেলের আস্তরণে।কিন্তু এখন পর্যন্ত বড় আকারে তেল অপসারনের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি,স্থানীয় অধিবাসিরা ঝুকি নিয়ে স্বল্প পরিসরে তেল অপসারণের কাজটি করে যাচ্ছেন।থালাবাটি বালতি নিয়ে তাঁরা নদী থেকে তেল সংগ্রহ করছেন যা কিনা আবার পদ্মা ওয়েল এর ঠিকাদার ৩০ টাকা লিটার হারে কিনে নিচ্ছেন। সুন্দরবনের প্রায় ৮০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এই তেল,যা কিনা এখন পর্যন্ত বিশ্বের সব থেকে বড় এবং ভয়াবহ ম্যানগ্রোভ বন বিপর্যয়ের ঘটনা।এর আগে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমন ঘটনা ঘটলেও সেগুলোর ব্যাপ্তি ছিল সর্বোচ্চ ৫-৬ হাজার হেক্টর।আর গত কয়েকদিনে সুন্দর বনের প্রায় ৮ হাজার হেক্টর জুড়ে ফার্নেস তেল ছড়িয়ে পড়েছে,যা শুধু মাত্র শ্যালা নদীতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি-পশুর,রূপসা,বলেশ্বর নদী সহ সুন্দর বনের অভ্যন্তরীন জলাশয়েও ছড়িয়ে পড়েছে এই তেল (সূত্রঃ বনবিভাগ, প্রথমআলো)।এই দুর্ঘটনা আমাদের সামনে বেশ কিছু প্রশ্ন নিয়ে এসেছে।সেই সাথে বুঝিয়ে দিয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ বনের প্রতি আমাদের অবহেলা কতো বেশি! পূর্বাপর ঘটনা আমাদের কে এ কথাই বলতে বাধ্য করে, রানা প্লাজার মতো সুন্দরবনও এক ট্র্যাজেডির শিকার।
প্রথমেই দেখা যাক এই দুর্ঘটনার ফলে সুন্দরবন কী কী ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।নীচের চার্টে বিভিন্ন মেয়াদে কী ধরণের ক্ষতি হতে পারে তার একটি ধারণা দেয়া হয়েছে।
শ্বাসমূলীয় বনে তেল ছড়িয়ে পড়ার সব থেকে বড় ক্ষতিকর প্রভাবটি হল তেলের আস্তরণ পড়ে ঢাকা পড়ে যায় শ্বাসমূল,এতে করে মারা যাবে গাছ গুলো,আর এর প্রভাব পড়বে বনের অন্যান্য প্রাণীকূলের উপর।সমগ্র বনের খাদ্য-শৃংক্ষল ভেঙে পড়বে,যার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি।পরিবেশ গত এই প্রভাবের পাশাপাশি এই দুর্ঘটনা স্থানীয় অধিবাসীদের জীবন-জীবীকা তে কী বড় ধরণের প্রভাব ফেলবে সেটা কি আমরা ভেবে দেখেছি? নাইজেরিয়ার নাইজার ব-দ্বীপে ২০০৮ সালে শেল কোম্পানির পাইপ থেকে তেল নিঃসরণের ঘটনা ঘটে।এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ৩০ হাজার মানুষের জীবিকা।এতে ধ্বংস হয় এক হাজার হেক্টর শ্বাসমূলীয় বন।আর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির শিকার হয় আরও পাচ হাজার হেক্টর।এই ক্ষয়ক্ষতির যে হিসেব দেয়া হয়েছিল তা গত মঙ্গলবারের সুন্দরবনের বিপর্যয়ের তুলনায় কম! এর আগে ঘটে যাওয়া এরকম দুর্ঘটনা গুলোর প্রভাব লক্ষ করলে দেখা যাবে দশ বছরেও সেই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যায়নি,আর সুন্দর বনের এই দুর্ঘটনা তো পূর্বের যেকোন ঘটনার থেকে ভয়াবহ!
ভারত-বাংলাদেশ নৌ প্রটোকল রুট ও দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে দেশের নৌবাণিজ্য যোগাযোগ পথ হিসেবে ব্যবহৃত ঘষিয়াখালী চ্যানেল মংলার নালা ও রামপালের কুমার নদী ভরাট হয়ে প্রায় তিন বছর ধরে বন্ধ রয়েছে।তখন থেকে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে শ্যালা নদীকে বিকল্প পথ হিসেবে ব্যবহার করছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআইডব্লিউটিএ।২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর,প্রধানমন্ত্রি সুন্দরবনের ভেতরের নৌপথ বন্ধের নির্দেশ দেন।২০১২ সালের ২১ আগস্ট পরিবেশ ও বন মন্ত্রনালয় নৌপরিবন মন্ত্রনালয় কে চিঠি দিয়ে একই দাবি করে।কিন্তু কোন দাবিতেই ভ্রূক্ষেপ করেনি নৌপরিবহন মন্ত্রনালয়।প্রশ্ন হল স্বয়ং প্রধানমন্ত্রির নির্দেশ সত্যেও কেন এবং কার স্বার্থে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে নৌ চলাচল বজায় রাখা হল?এই দুর্ঘটনা ঘটার সাথে সাথেই ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে যে পদক্ষেপ গুলো নেয়ার কথা ছিল সেগুলো নেয়া হয়নি।মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ এর জন্য দায়ী করেছেন যন্ত্রপাতির অভাব কে।সতর্কতা মূলক পদক্ষেপ ছাড়া কেন এতদিন ধরে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে নৌ চলাচল করছিল?
এই দুর্ঘটনা কর্তৃপক্ষের চোখ খুলে দেবে কিনা সেটা সময়ই বলে দেবে কিন্তু এই মুহুর্তে এই ক্ষতি যতটা হ্রাস করা সম্ভব সেই কাজটিই করতে হবে।ইতিমধ্যে স্থানীয় অধিবাসিরা নিজেরাই কোন রকম দ্রব্যাদি ছাড়াই তেল অপসারণের কাজ করছেন,যা তাদের স্বাস্থ্য ঝুকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।তারা নিজেদের গায়ে বিষাক্ত তেল বহন করে পরিষ্কার করছে তাদের জীবিকার উৎস এই নদীকে।
এর মধ্যেই এর ক্ষতিকর প্রভাব গুলো দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।সুন্দরবনের যে এলাকাটিতে এই তেল ছড়িয়ে পড়েছে সেটি বিশ্বের বিপদাপন্ন দুই প্রজাতি গাংগেয় ও ইরাবতী ডলফিনের বিচরণ ক্ষেত্র।এই ঘটনার পর ঐ এলাকায় আর কোন ডলফিনের দেখা মেলেনি।অনেক স্থানে বিভিন্ন সরীসৃপের মৃতদেহ ভেসে উঠতে দেখা গিয়েছে।
এই মুহুর্তে আমাদের করণীয় কী হতে পারে?সরকারি ভাবে বড় আকারে পদক্ষেপ শুরু করার আগে আমাদের কি করণীয় আছে সেটা একটু দেখে নেয়া যাক।একটা বালতিতে বড় ছিদ্র করতে হবে।ছিদ্রটি এমন হতে হবে যেন তার মধ্য একটি ১ ইঞ্চি বা ১.৫ ইঞ্চি পুরু সফট ফোম গোল করে কেটে বিছানো যায়। এবার তা দিয়ে তেল মিশ্রিত পানি তুলতে হবে নদী থেকে।তেল ফোমের উপর জমা হবে।আর পানি আবার নদীতে পড়ে যাবে।তেল বেশী পরিমাণে বালতিতে জমে গেলে তা ড্রামে ঢেলে রাখতে হবে।এক সময় ফোম তার ছাঁকন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে।তখন নতুন ফোম দিয়ে আবার একই কাজ চালিয়ে যেতে হবে।সব ড্রাম ভরে গেলে তা নদীর পারে বড় ট্যাংকারে জমা করতে হবে।একইভাবে অসংখ্য গ্রুপে ভাগ হয়ে কাজটি করা যেতে পারে।মূলত এভাবেই স্থানীয় মানুষেরা তেল অপসারণ করে যাচ্ছেন,অনেক ক্ষেত্রে ফোমের বদলে ব্যবহার করছেন নিজেদের শরীর!
নৌবাহিনীর জাহাজ কান্ডারি-১০ ঘটনাস্থলে পৌছেছে।নদীতে এক ধরণের রাসয়নিক পদার্থ ছড়িয়ে তেল ছড়ানো বন্ধ করা হবে বলে জানিয়েছে তারা।তেল ছড়ানো বন্ধ ও কমানোর জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে ‘তেল খেকো ব্যাকটেরিয়া’ যা এর পূর্বে বিভিন্ন স্থানে সফল ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
“এই নদীর পানি খাই আমাদের জীবন চলে।আর কয় দিন পর নদীর পানি লবণ হই যাবে।এর আগেই পানি পরিষ্কার না করলি সামনের দিনি পানির অভাবে মরতে হবিনি”- স্থানীয় অধিবাসি লাভলু গাজীর এই আক্ষেপ কি কর্তা ব্যক্তিদের কানে যাচ্ছে?প্রথমেই যদি পরিবেশবাদীদের উদ্বেগ কে আমলে নিয়ে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে নৌ চলাচল বন্ধ করা হত তাহলে হয়তো আজ এই আক্ষেপ শুনতে হতনা।এই আক্ষেপের সুর আরও কত করুন হয়,আরও কত ক্ষতির সম্মুখীন হয় আমাদের সুন্দরবন সেটাই এখন দুশ্চিন্তার বিষয়।
(ছবি ও কৃতজ্ঞতাঃ কল্লোল মুস্তফা,শাফায়েত আজাদ)