বনজীবী; নোনাপানির এই জীবনের শেষ কোথায়?- শেষ পর্ব

আসাদ রহমান

বাঘকে এরা মোটেই ভয় পায় না। বাঘের সাথে এদের সম্পর্ক হল মামা-ভাগ্নে সম্পর্ক। কয়রা উপজেলার কয়রা, বেদকাশী এই দুই ইউনিয়নের বেশির ভাগ মানুষ বনজীবী, বংশানুক্রমে তারা কেউ গাজী, কেউ সর্দার। সুন্দরবনে গিয়ে তারা কেউ কাকড়া ধরে, কেউ সাদা মাছ ধরে আবার কেউ চিংড়ির পোনা ধরে। এর মাঝে মাঝে তারা মধুও সংগ্রহ করে যদি চোখের সামনে পড়ে যায়। মাঝে মাঝে ফরেস্টারের চোখ ফাঁকি দিয়ে নৌকায় তুলে নেয় দু’টো কাঠ, খরকুটো, গোলপাতা। জঙ্গলে যাবার জন্য সরকারী পাস থাকলেও এইসকল বনজীবীদের খুব কম অংশই সেই কার্ড নিতে পারে। কারণ সরকারী বরাদ্দ কম। ২০১১ সালে যেখানে ছিল ৩৫০ কার্ড, ২০১২ সালে তার সংখ্যা ২০০ তে নেমে আসে। সুন্দরবন রক্ষার জন্য এই আয়োজন। বরাদ্দ কম হলেও আওয়ামীলীগ, বি.এন.পি. নেতারা সেই কার্ড হাতিয়ে নেন আগেই কারণ এই কার্ড গুলোর নামে তথা কার্ডধারী বনজীবীদের নামে যে সরকারী সাহায্য আসে সেগুলোর লোভে। তাই এই সকল বনজীবীদের জঙ্গলে যেতে হয় চুরি করে, সরকারী কোন পাসের তোয়াক্কা না করে, দায়িত্বপ্রাপ্ত উপরের মহলে টাকা ঘুষ দিয়ে। জঙ্গলে গিয়ে কাজ করা ছাড়া, আর অন্য কোন কাজ নেই এই সকল গাজী, সর্দারদের। কিছু কিছু মানুষ যদিও কাজের তাগিদে জায়গা বদল করছে, তবে সেটা সাময়িক। অন্য কোন জেলায় গিয়ে কিছু টাকা রোজগার করে তারা আবার চলে আসে। আবার কিছু মানুষ বেনাপোল হয়ে দালাল ধরে চলে যায় ভারতে। সেখানে গিয়ে কাজ নেয় ইট ভাটায়। এই ইট ভাটা গুলোতে গিয়ে একবার ঢুকার অর্থ হলো পাক্কা ৬ মাস সেখানে থাকতেই হবে। সেখান থেকে ৬ মাসের আগে সে আর বের হতে পারবে না। যদি কেউ পালানোর চেষ্টা করে তবে তাকে শেঁকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয় অথবা বি.এস.এফ. এর কাছে তুলে দেয়া হয় আর তার সাথে অকথ্য নির্যাতন তো থাকছেই।

agnisarothi_1380860972_5-SAM_2394_800x600
সরকারী পাস

সুন্দরবনে মাছ ধরতে যাওয়া এসব মানুষের কাছে সব চেয়ে বড় আতংকের নাম ডাকাত। বাঘের জন্য তারা পীরের কাছ থেকে ‘পড়া লাল রুমাল’ নিয়ে গেলেও এই ডাকাতদের কাছে তারা অসহায়। ডাকাতের জন্য কোন ‘পড়া লাল রুমাল’ নেই, নেই কোন মাদূলী-তাবিজ। কয়েক বছর আগে সুন্দরবনে ডাকাতি গ্রুপ ছিল ৩/৪ টি আর এখন  ১০/১২ টিরও বেশি। জঙ্গল হল এ সব ডাকাতের রাজত্ব। পুলিশ, কোস্ট গার্ডদের কোন তোয়াক্কা করে না তারা। একেকটি ডাকাতি গ্রুপে ৩০/৪০ জন থেকে শুরু করে ১৫০/২০০ জন পর্যন্ত রয়েছে। রয়েছে অনেক আধুনিক অস্ত্র। যেগুলো আমাদের পুলিশ কিংবা কোস্ট গার্ডের কাছে শুধুই স্বপ্ন। এই রকম একটি সুসজ্জিত বাহিনীর সাথে কোস্ট গার্ড কিংবা পুলিশ কোন কিছু করে উঠতে পারে না বিধায় তারাও এই সব ডাকাতদেরকে ঘাটাতে যায় না খুব একটা। বীরদর্পে ডাকাতেরা ঘুরে বেড়ায় সুন্দরবনের নদীগুলোতে। এমনকি তারা ফরেস্টারের বিছানায় পর্যন্ত ঘুমায়। সুন্দরবনের সব থেকে বড় ডাকাত গ্রুপ হল গামা গ্রুপ। এরপর রয়েছে রাজু গ্রুপ। রাজু হল গামার ভাগ্নে। মামা- ভাগ্নে হলেও তাদের মধ্যে কাটাকাটি সম্পর্ক। আগে তারা একই গ্রুপে ছিল। সুন্দরবনে অরাজকতা সৃষ্টি কারী এইসব ডাকাত গ্রুপ বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায় এই নদী থেকে ঐ নদীতে। সুন্দরবনে মাছ ধরতে হলে একজন জেলেকে প্রতি চারমাসের জন্য, একজন ডাকাতকে ৬০০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। এখন দেখা গেল একজন জেলে একজন ডাকাতকে ৬০০০ টাকা দিল, সেইখানে সে, সেই ডাকাতের কাছে ৪ মাসের জন্য সুরক্ষিত কিন্তু অন্য কোন ডাকাতের হাতে পড়লে আবার তাকেও মুক্তি-পণ দিতে হবে। এছাড়াও এর সাথে রয়েছে ফরেস্টারের ঘুষের টাকা আবার মাছ/কাঁকড়া পাওয়ার অনিশ্চয়তা।

একটি কেসঃ

জনাব রহিম গাজী (ছদ্মনাম)। পেশায় বনজীবী। মোট ৬ জনের সংসার তার। জঙ্গলে গিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় তাকে। আগে সে তার নৌকায় ‘জন’ খাটাত। কিন্তু মজুরীর দাম বৃদ্ধির কারনে এবার সে আর জন না নিয়ে তার দুই ছেলের প্রাইমারী স্কুলের পড়াশুনা বন্ধ করে দিয়ে তাদের নিয়ে যায় মাছ ধরতে। সুন্দরবনের নদীর একটা জায়গাকে সে মাছ ধরার জন্য নিরাপদ মনে করে, কারন এই জায়গায় ৬ মাস মাছ ধরার জন্য সে রাজু ডাকাত কে ৬০০০ টাকা চাঁদা দিয়েছে। মাছ ধরতে ধরতে, একদিন সে দেখে বড় কি একটা লঞ্চের মত তার নৌকার দিকে আসছে। তার আর বোঝার বাকী থাকে না যে এটা ডাকাতি নৌকা। সে তো টাকা দিয়েছে রাজু ডাকাতকে এই ভেবে সে বুকে সাহস নিয়ে আবারো মাছ মারতে থাকে। ডাকাতি নৌকা যখন তার নৌকার কাছে আসে তখন সে বুঝতে পারে যে এটা রাজু ডাকাত না। গামা ডাকাত। এসেই গামা ডাকাত তার নৌকায় থাকা চাল,ডাল,পানি, তরকারী, মাছ কেড়ে নেয়। তাকে মারধোর করা শুরু করে। এক পর্যায়ে সে যখন বলে যে সে রাজু ডাকাতকে টাকা দিয়েছে তখন তার উপর নেমে আসে আরো নির্যাতন। কেন সে রাজুকে টাকা দিবে? এক পর্যায়ে তাকে গামা ডাকাতের লোকজন নৌকায় তুলে নেয় এবং তার দুই সন্তানকে ছেড়ে দেয় এবং একটা বিকাশ নাম্বার দিয়ে বলে ৭ দিনের মধ্যে এই নাম্বারে ১০০০০ টাকা না দিলে তোর বাবাকে জবাই করে বাদায় (জঙ্গলে) ফেলে রাখব। রহিম গাজী এবং তার সাথে আরো ৩/৪ জন জেলেকে নিয়ে গামা ডাকাত চলে আসে। তারা গিয়ে ওঠে ফরেস্ট অফিসে। দুটো হরিন মারে তারা। ফরেস্ট অফিসের ভেতরে থাকে গামা ডাকাত এবং তার বাহিনী, আর বাইরে বেঁধে ফেলে রাখা হয় রহিম গাজী এবং বাকী বন্দীদের। সারা রাত মশার কামড়ে অতিষ্ট হয়ে ওঠে তারা। হাত বাঁধা থাকার কারণে, মশা তাড়াতে না পেরে সারা রাত মশার খোড়াক হতে থাকে। ৭ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরও রহিম গাজীর পরিবার টাকা না দিতে পারলে, ৮ম দিনে তারা রহিম গাজীকে তার বাড়িতে ফোন দিতে বলে। রহিম গাজী তাদের কথা মত ফোন দেয়। ফোনে কথা বলার সময় নৌকার বড় একটা কাঠ দিয়ে রহিম গাজীকে প্রচুর মারা হয়, কারন ফোনে যেন তার পরিবার রহিম গাজীর কান্না চিৎকার শুনতে পায়। রহিম গাজীর পরিবার গামা ডাকাতের কাছে অনেক অনুরোধ করে আরো একটা দিন সময় চেয়ে নেয়। পরের দিন তার পরিবার এলাকার মহাজনদের কাছে প্রতি হাজারে ২০০ টাকা হারে সুদে ১০০০০ টাকা ঋন নিয়ে গামা ডাকাতের দেয়া বিকাশ নাম্বারে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু সেদিন যখন ডাকাতেরা রহিম গাজীকে ছেড়ে দিবে তার আগ মুহুর্তে সেখানে কোস্ট গার্ডের রেইড পরে। কোস্ট গার্ডের সাথে গামা ডাকাত গ্রুপের বন্দুক যুদ্ধ হয়। প্রায় ৩/৪ ঘন্টা যুদ্ধের পর গামা ডাকাত রহিম গাজী এবং অন্যান্য বন্দীদের ফেলে রেখে চলে যায়। কোস্ট গার্ড বন্দীদের ডাকাত সন্দেহে তুলে নিয়ে যায় এবং জেলে রাখে। তাদের কথা আর কেউ শোনেনা। দেয়া হয় তাদের নামে ডাকাতি মামলা। সেই মামলায় তিন বছরের জেল হয় রহিম গাজীর। জেলে যাওয়ার কারনে, তার পরিবার একেবারে রাস্তায় বসে যায় কারন উপার্জন করার লোক বলতে তার পরিবারে সে ছাড়া আর কেউ ছিল না।

আইলা’য় সর্বশান্ত হয়ে যাওয়া এইসব বনজীবীদের দুঃখ দুর্দশার কথা শোনার মানুষ অনেক কম। যদিও কয়রায় কিছু এন.জি.ও. কাজ করে চলেছে কিন্তু তাদের সাহায্য সহায়তাও পর্যাপ্ত নয়। আর যদি সরকারী উদ্যেগের কথা বলি তবে সরকারী সাহায্য সহযোগীতা যা বরাদ্দ তা সরকারী কর্মচারী, চেয়ারম্যান-মেম্বার, দলীয় নেতা নেত্রীদেরই পেট ভরাতে পারেনা, সেখানে এই সব অসহায় মানুষের দুঃখ মোচন করবে কী করে? অবস্থা এতটাই খারাপ যে কোন বেসরকারী সাহায্য সংস্থাও যদি সেখানে সাহায্য করতে যায় তবে আগে চেয়ারম্যান, মেম্বার, দলীয় নেতা কর্মীদের উদর পূর্তী করাতে হয়। কিছুদিন ধরে খবরে জলদস্যু ধরা পরা মারা যাওয়ার বেশ কিছু খবর কানে আসছে। এটি একটি ভাল সংবাদ। কিন্তু ধরা কিংবা মারা পড়ছে কোন জলদস্যুরা? ধরা পড়ছে সেই সব চুনোপুটির দল যাদের প্রশাসনের সাথে আতাত নেই, প্রশাসনকে খুশি রাখে না। এটা একটা আই ওয়াশ ছাড়া আর কিছুই নয়। রাঘব বোয়ালেরা ঠিকই বহাল তবিয়তে চাঁদার জন্য বনজীবীদের অপহরণ, খুন, জুলুম-নির্যাতন করেই চলেছে দিনের পর দিন। দেখার কেউ নেই।

লেখক, 
গবেষকইইপি/সিঁড়ি রিসার্চ টিম

লেখাটির প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখাটির দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখাটির তৃতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics