বনজীবী; নোনাপানির এই জীবনের শেষ কোথায় ?- পর্ব : ২

আসাদ রহমান

২০০৯ সালের ২৫ মে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলা’র তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়েছিল খুলনার দাকোপ, কয়রা, পাইকগাছা, বাগেরহাটের রামপাল, মংলা, শরণখোলা উপজেলাসহ গোটা দক্ষিণ উপকূলের বিস্তীর্ণ জনপদ। আইলা’র আঘাতে উপকূলীয় ১১ টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় খুলনা জেলার দাকোপ ও কয়রা উপজেলা এবং সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলা। আইলা’র ফলে এই ৪ উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন জোয়ারের লবণাক্ত পানিতে সম্পূর্ণ প্লাবিত হয়ে যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে বিবেচিত খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী, উত্তর বেদকাশী, মহেশ্বরীপুর ও কয়রা সদর ইউনিয়ন, দাকোপ উপজেলার সুতারখালি ও কামারখোলা ইউনিয়ন, সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়ন, এবং আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়ন। সরকারি হিসেবে, আইলা’র আঘাতে মৃতের সংখ্যা ছিল ৩৩০ জন। এছাড়া আইলা’র আঘাতে শারীরিক ভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয় ৭ হাজার ১ শ’ ৩ জন মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ১৩ হাজার ৭ শ’ ৭৪টি। পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো ৯ লক্ষ ৪৮ হাজার ৬ শ’ ২১টি এবং মোট ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৩৯ লক্ষ ২৮ হাজার ২ শ’ ৩০ জন। আইলায় লবণাক্ত পানি ঢোকায় দুর্গত এলাকা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় স্বাদু পানির মাছ, গো-চারণ ভূমি। গাছপালা মরে বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়। (সূত্র- সংবাদপত্রের খবর)

agnisarothi_1383564417_3-SAM_2103_800x600
৩ নং কয়রা গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট নদী

৩ নং কয়রা গ্রামের ও তার আশেপাশের গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ পেশায় বনজীবী। তারা সুন্দরবনে গিয়ে নদীতে মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ির পোনা, মধু আহরন করে জীবিকা নির্বাহ করে। এলাকার বেশির ভাগ মানুষ যে পেশায় বনজীবী অনেক আগে থেকেই ছিল, বিষয়টা তেমন নয়। এদের মধ্যেও ছিল নানা বৈচিত্রের পেশাজীবী। কিন্তু এক আইলা তাদের জীবন লন্ডভন্ড করার পাশাপাশি পরিবর্তন করে দিয়েছে তাদের পেশা, সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, অর্থনীতি এবং অন্যান্য সকল কিছু। আইলা’র কারনে এই অঞ্চলের কৃষি জমিতে প্রচুর লবন চলে আসে সে সময়। আর যার ফলাফল হল, হাজার হাজার বিঘা কৃষি জমিতে আবাদ বন্ধ হয়ে যাওয়া। আর আবাদ বন্ধ হওয়ায়, এলাকার বিশাল একটি জনগোষ্ঠী কর্মহীন হয়ে পড়ে। রাস্তাঘাট নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারনে ভ্যান/রিক্সা চালনাকেও পেশা হিসেবে গ্রহন করতে পারেনি এলাকার লোকজন। আইলা’র পূর্বে বিভিন্ন পেশার মানুষ ছিল এই এলাকাটিতে। বনজীবীদের যখন বনে যাওয়ার মৌসুম থাকত না তখন তারাও অন্যের জমিতে দিন মজুরীর কাজ করত। কৃষি কাজ বন্ধ আর রাস্তা-ঘাট নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারনে বিশাল একটি জনগোষ্ঠী কর্মহীন হয়ে পড়ে। যার ফলাফল- অভাব আর অভাব। মানুষজন নিকটবর্তী শহর গুলোতে এমনকি বেনাপোল হয়ে দালাল ধরে ভারতে পর্যন্ত সিজনাল মাইগ্রেশন শুরু করে। নিকটবর্তী শহর গুলোতে গিয়ে তারা রিক্সা-ভ্যান চালানো, রাজমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করে। আর তাদের মধ্যে ক’জন অবৈধ ভাবে সীমান্ত পেড়িয়ে, ভারতে গিয়ে কাজ নেয় ইট ভাটা গুলোতে।

আইলা’র পরপর সময়ে এই অঞ্চলে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেনী। কারণ এই সময় সরকা্রি, বেসরকারি, এন.জি.ও. থেকে প্রচুর সাহায্য এসেছে আইলায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের জন্য। মধ্যবিত্ত এই শ্রেনীর লোকজন নিজেদের আত্মমর্যাদা, মানসম্মানের কারণে রিলিফের লাইনে গিয়ে দাঁড়াতে পারেনি, আর তার সাথে শেষ সম্বল বিঘা কয়েক জমি লবনে নষ্ট হয়ে যাওয়া তো থাকছেই। প্রভাবশালীরা রিলিফ আত্মসাৎ করেছে অথবা কর্তৃপক্ষের সাথে যোগসাজস করে ঘরে তুলেছে অনেক অনেক রিলিফ আর দরিদ্ররা লাইনে দাড়িয়ে রিলিফ খেয়েছে। ফাঁপরে পড়েছিল এই মধ্যবিত্ত শ্রেনী। তারা না পেরেছে যোগসাজস করে রিলিফ ঘরে তুলতে, না পেরেছে মান ইজ্জতের ভয়ে লাইনে দাড়াতে। আইলা পূর্ববর্তী সময়ে এই অঞ্চলের নারীরা ছিল খুব বেশি পর্দাশীল। ধর্ম ছিল তাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসে। একজন নারী ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করবে এটা কখনো এই সমাজ মেনে নিতে পারতো না। আর নারীরাও এই পর্দাকে মেনে নিয়েছিল ধ্রুব সত্য হিসেবে। ঘরের চারটা দেয়াল-ই হয়ে উঠেছিল একেকজন নারীর জন্য একেকটি পৃথিবী। ঘর- সংসারের বাইরে গিয়ে কাজ করা যেন গোনাহ এর কাজ। জীবন চলছিল তার নির্দিষ্ট নিয়মে। আর এক আইলা এসে তাদের সকল ধরনের ধ্যান- ধারণা পরিবর্তন করে দিয়ে তাদের মধ্যে জিইয়ে রাখল শুধু টিকে থাকার লড়াই। আইলা পরবর্তী সময়ে, বিভিন্ন  উন্নয়ন সংস্থাগুলো তাদের রিলিফ এবং কাজ নিয়ে হাজির হল নারীদেরকে টার্গেট করে। আর অভাবী এই সকল পর্দানশীন নারীরাও তাদের অভাবী পরিবার গুলো থেকে ক্ষুধার তাড়নায় বের হয়ে যুক্ত হতে শুরু করল সংস্থাগুলোর তথাকথিত ‘উইমেন এম্পাওয়ারমেন্ট’ নামক ডিস্কোর্সের সাথে। তারা যুক্ত হয় এন.জি.ও. গুলোর ট্রেনিং, ঋন, রিলিফ কিংবা কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী গুলোতে।

agnisarothi_1383564267_1-IMG_0728_320x240
ঝিলিঘাটা বাজার

এক আইলা এসে এই অঞ্চলের অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, ধর্ম, রীতি-নীতি, পেশা, মুভমেন্ট, রাজনীতি সব কিছুর পরিবর্তন করে দেয়। আইলা’র সময় এখানে মাছের কোন কমতি ছিল না, কিন্তু মাছ রান্নার চুলা তথা উপযুক্ত স্থান তাদের ছিল না। মাছের প্রাচুর্য্য থাকলেও সেই মাছ মানুষ কিনে খেতে পারত না কারণ টাকা নেই। আর টাকা উপার্জনের জন্য কাজ নেই। মাছ খেতে হলে নদীতে ধরে খেতে হত। আইলা পরবর্তী সময়ে, এলাকার বেশ কয়েকটি বাজার বিগত কয়েক বছর ধরে (২০১১,২০১২,২০১৩) পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, সেখানে ছোট তেলাপিয়া মাছ ছাড়া আর কোন মাছ খুব বেশি উঠতে দেখা যায় নি। তেলাপিয়া মাছের দাম অন্য মাছের তুলনায় অনেক কম এবং সহজলভ্য। সুন্দরবনের নদী গুলোতে ধরা পরা বেশির ভাগ মাছ চলে যায় শহরে। ৩ নং কয়রা গ্রামের ঝিলিঘাটা বাজারে একদিন এক ছোট বাচ্চাকে (৭/৮ বছর) তেলাপিয়া মাছ বিক্রি করতে দেখা যায়। তাকে যখন মাছের কে.জি. কত জিজ্ঞেস করা হয়; সে নিশ্চুপ থাকে, কোন উত্তর দেয় না। তাকে তিনবার জিজ্ঞেস করা হয় তোমার মাছের কে.জি. কত খোকা? সে নিশ্চুপ থাকে, কোন উত্তর দেয় না। সে প্রশ্নই বোঝে নি। পরে যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়; মাছের পোয়া কত, তখন সেই শিশু উত্তর দেয় ২০ টাকা। এখানে বিষয়টি এমন যে, এই এলাকার মানুষ অভাবের কারনে, তারা মাছ কে.জি. হিসেবে কিনে না দীর্ঘ দিন, কিনে পোয়া হিসেবে। আর তাই সেই শিশুটি কে.জি. নামক এই বাটখারাটির সাথে পরিচিত নয়। বাজারটিতে মিষ্টি, জিলাপী, খুরমার একটি দোকান রয়েছে।agnisarothi_1383304095_9-IMG_0661_800x600

মিষ্টি বানানোর একটি বিশেষত্ব আছে এখানে। মিষ্টি তৈরি হয় দুধ ছাড়াই। আইলায় এই এলাকার বেশিরভাগ গরু ছাগল মরে যাওয়ার কারনে এখানে দুধের দাম আর সোনার দাম সমান। আর তাই এখানকার দোকানে মিষ্টি বানানো হয় সামান্য গুড়া দুধ, ময়দা আর চিনি দিয়ে। সামান্য গুড়া দুধ আর ময়দা এক সাথে মিশিয়ে গোল গোল করে তা চিনির শিরার মধ্যে ডুবিয়ে দেয়া হয়, ব্যাস হয়ে গেল মিষ্টি।agnisarothi_1383304328_10-IMG_0767_800x600

(চলবে)

লেখক, 
গবেষকইইপি/সিঁড়ি রিসার্চ টিম

লেখাটির প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics