মৃত্তিকা কথন এবং আন্তর্জাতিক মৃত্তিকা বর্ষ,২০১৫
মনিজা মনজুর
মৃত্তিকা- সহজ বাংলায় যাকে আমরা মাটি বলি। যে কি না সভ্যতার ক্রমবিকাশের সকল উৎস আর নিদর্শন ধারণ করে আছে। খাদ্য উৎপাদন থেকে বহুতল ভবন নির্মাণে, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবের আবাসস্থল থেকে সুবিশাল মহীরূহে, পানি পরিশোধন থেকে জলবায়ু সুরক্ষায় এমনকি সংস্কৃতি বিনোদনেও কোথায় নেই মাটির অবদান?
একটা প্রবাদ আছে- মৃত্তিকা সর্বংসহা। হ্যাঁ, লক্ষ-কোটি বছর ধরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে, নবরূপে রূপান্তরিত হয়ে সে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। যে মৃত্তিকা পরম মমতায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মানবকুলের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের যোগান দিয়ে যাচ্ছে সেই মৃত্তিকার উপর দাঁড়িয়ে কখনো কি ভেবে দেখেছি সে কেমন আছে? ভেবেছি কি মৃত্তিকা না থাকলে আমাদের অস্তিত্ব থাকতো কি না?
ক্রমবর্ধমান নগরায়ন, দূষণ, ব্যাপক হারে বনভূমি ধ্বংস, জলাবদ্ধতা, পানি এবং বাতাসের ক্রিয়ার ফলে মাটিক্ষয় এবং অপরিকল্পিত চাষাবাদের ফলে বিশ্বের অনেক অঞ্চলের মৃত্তিকার স্বাস্থ্য এখন ভঙ্গুরপ্রায়। মাটির গুণগত পরিমাণ হ্রাসের ফলে খাদ্যের পুষ্টি উপাদানেও ঘাটতি দেখা দিচ্ছে, লক্ষণীয় হচ্ছে বাস্তুসংস্থানের অসামঞ্জস্যতা। অন্যদিকে অজ্ঞতার কারণে অধিক মুনাফার আশায় কেউ ফসলি জমিতে নির্মাণ করেন বাসস্থান আবার অধিক উৎপাদনের আশায় জমিতে অহেতুক সার-কীটনাশক ব্যবহার করে পুষ্টি উপাদানহীন ফসল ফলানোর চেষ্টা করেন। এভাবেই মানবসৃষ্ট কারণে ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বৈচিত্র্যে ভরপুর অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ- মাটি। অভাব জ্ঞানের, সচেতনতার, সুপরিকল্পনার।
কোনো এলাকার এক ইঞ্চি নতুন মাটি উৎপন্ন হতে ওই এলাকার জলবায়ু এবং মাটি গঠনের প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে কমপক্ষে প্রায় ৫০০ থেকে ১০০০ বছর সময় লাগে! যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণায় দেখা গেছে পানি এবং বাতাসের ক্রিয়াকলাপ জনিত কারণে শুধুমাত্র চাষাবাদের জমি থেকেই প্রতি বছরে প্রায় ১.৭ বিলিয়ন টন মাটি ক্ষয় হয় (সূত্রঃ ইউএসডিএ, ২০০৭)। বাংলাদেশ সরকারের প্রাকৃতিক সম্পদবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ”সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস” (সিইজিআইএস)-এ গবেষণাপ্রসূত ফলাফল অনুযায়ী ১৯৪৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত উপকূলে ভূমি ভাঙ্গনের পরিমান ১,১৮০ বর্গ কিঃমিঃ এবং গড়ার পরিমান ২,৯৭০ বর্গ কিঃমিঃ এবং মোট জেগে ওঠা ভূমির পরিমান ১,৭৯০ বর্গ কিঃমিঃ। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) রামগতি স্টেশনের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, পাহাড়ি এলাকায় প্রতি বছর মোট মৃত্তিকাক্ষয়ের পরিমাণ ২.০ থেকে ৪.৭ টন/হেক্টর। এছাড়া বনাঞ্চল উজাড় হওয়ার কারণে দেশের বনভূমির পরিমাণ প্রতি বছর প্রায় ৩ শতাংশ হারে হ্রাস পাচ্ছে, ফলস্বরূপ এসব এলাকায় পানি দ্বারা মৃত্তিকাক্ষয়ের পরিমাণ বছরে প্রায় ১০২ টন/হেক্টর (সূত্রঃ বাংলাপিডিয়া)। মৃত্তিকার সহজলভ্যতার তুলনায় হারানোর পরিমাণ টা আঁচ করে নিন তাহলে… মমতাময়ী মৃত্তিকা একবিংশ শতাব্দীর চাহিদা পূরণের সাথে পাল্লা দিয়ে উঠতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে।
তাই জীবন রক্ষার এই বহুমুখী অনন্য উপাদানের উপর গুরুত্বারোপ করে জাতিসংঘের ৬৮তম অধিবেশনে ইংরেজী ২০১৫ সালকে ‘আন্তর্জাতিক মৃত্তিকা বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে কাজ করছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা ”ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন” (এফএও) এবং ”সয়েল সায়েন্স সোসাইটি অব আমেরিকা” (এসএসএসএ)। আর সমগ্র আয়োজনটি সম্পন্ন হচ্ছে গ্লোবাল সয়েল পার্টনারশিপ (জিএসপি) কাঠামোর অধীনে। ‘আন্তর্জাতিক মৃত্তিকা বর্ষ’ উদযাপনের মূল উদ্দেশ্য বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা বৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে অভিযোজন ক্ষমতা বাড়ানো, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং দীর্ঘমেয়াদী টেকসই উন্নয়নে মৃত্তিকার গুরুত্ব তুলে ধরা।
মৃত্তিকা সম্পর্কে জানতে এবং জনসাধারণকে জানাতে নির্দিষ্ট মাসের উপর ভিত্তি করে কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। প্রতি মাসের ভিত্তিতে প্রতিপাদ্য বিষয়গুলো নিম্নরূপ-
জানুয়ারী- জীবন রক্ষায় মাটি
ফেব্রুয়ারী – শহুরে জীবনে মাটির ভূমিকা
মার্চ – কৃষিতে মাটি
এপ্রিল – পানি পরিশোধন ও ধারণে মাটি
মে – ভবন এবং অবকাঠামো ধারণে মাটি
জুন – বিনোদনে মাটি
জুলাই – সজীবতায় মাটি
আগস্ট – স্বাস্থ্য রক্ষায় মাটি
সেপ্টেম্বর – প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় মাটি
অক্টোবর – মাটি ও আমাদের ব্যবহারযোগ্য পণ্য
নভেম্বর – মাটি ও জলবায়ু
ডিসেম্বর – মাটি, সংস্কৃতি ও মানুষ
তাঁদের এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রতিটি বিষয়ের উপর নির্মাণ করা হয়েছে দুই মিনিটের ভিডিওচিত্র। আরো আছে নিয়মিত সংবাদ প্রকাশনা, মৃত্তিকা বিজ্ঞানীদের কার্যকলাপ সাধারণ মানুষ এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া, মৃত্তিকা বিজ্ঞানকে আরো জনপ্রিয় করে তোলা ইত্যাদি।
এবার চলুন এক নজর দেখে নিই কেন এই বিষয়গুলো নির্ধারন করা হয়েছে। জীবন ধারণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হলো- আলো, বাতাস, পানি এবং মাটি। এই চারের সমন্বয়ে উদ্ভিদের গড়ে ওঠা; যা আমাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের যোগান দেয়। ভূগর্ভস্থ শিলার ক্রমাগত পরিবর্তনের ফলে সৃষ্টি হয় মাটি। অসংখ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীবের বাসস্থান এই মাটি। অণুজীবগুলো তাদের ক্রমাগত কার্যকলাপের ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে। এক টেবিল চামচ মাটিতে অণুজীবের সংখ্যা বিশ্বজুড়ে মানব সংখ্যার সমান! বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় মাটির ভূমিকা অনন্য। তাই বলাই যায়, মাটি জীবন ধারণ করে।
শহুরে মানুষের সাথে মাটির সম্পর্ক খুব একটা গভীর না। কিন্তু এই মাটিই শহুরে জীবনকে পূর্ণতা দিচ্ছে নিঃস্বার্থভাবে। ভেবে দেখেছেন কী? আপনার পিজ্জা হাটের মজাদার পিজ্জার সাথে যে মাটির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য? পিজ্জার মুখরোচক উপাদান টমেটো, ক্যাপসিকাম, ক্লোভার, পেঁয়াজ, গাজর আর পিজ্জা ক্রাস্ট তো আসে গম থেকেই, যা মাটিতেই ফলে। আর বীফ পিজ্জার বীফ? গরু ঘাস খেয়ে তার দেহে যে পুষ্টি নেয়, সেই ঘাস তো মাটিতেই জন্মে। শহুরে জীবনে মাটির গুরুত্ব বুঝতে বাড়ির পাশে খালি জায়গায় ছোট্ট একটা বাগান করেই ফেলুন না!
মাটি ছাড়া কৃষি অকল্পনীয় একটা ব্যাপার। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। মাটি দেহের পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় সকল উপাদানের আধার। তাই উর্বর মাটি কৃষিক্ষেত্রের আধার।
মাটিতে ধারণকৃত পানি উদ্ভিদের খাবার, আবার প্রাকৃতিক পানি পরিশোধনেও মাটি অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। বৃষ্টির পানি মাটির উপরিভাগে বিভিন্ন সার এবং পশু বর্জ্যের সাথে মিশে দূষিত হয় এবং ভূগর্ভস্থ এলাকায় পরিচালিত হয়। ভূগর্ভস্থ এলাকার মাটির বুনট যদি সূক্ষ্ম বা মিহি হয় তাহলে তা প্রাকৃতিকভাবে খুব ভালো পানি পরিশোধনকারী হিসেবে কাজ করে। শহুরে এলাকায় সবুজায়নের মাধ্যমেও পানি ধারন এবং পরিশোধন করা যায়। আপনার নিকটস্থ হ্রদের পানি যদি পরিষ্কার দেখতে পান তাহলে ধন্যবাদ দিন মাটিকে। কারণ মাটির চেয়ে ভালো পরিশোধনকারি দ্বিতীয়টি নেই।
‘ইট-পাথরের দালান’। এই ইট কিন্তু বালু এবং কাদা মাটির মিশ্রনে তৈরি। আর দালান, কাঠের বাড়ি, মাটির ঘর, খড়ের ঘর, ছনের ঘর কিংবা বাঁশের ঘর যেভাবেই বলুন না কেন সব কিন্তু মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মাটির উপরেই। তবে শহুরে এলাকায় বাড়িঘর অবশ্যই পাথর এবং বালি থাকবে এমন বুনটের মাটির উপর নির্মাণ করতে হয়। নতুবা সেখানে পানি জমে ভবন ধসের আশংকা থাকে।
এবার আসি ‘বিনোদনে মাটি’। একটু অন্যরকম তাইনা? ছোটবেলায় সমুদ্রতীরে বালুর ঘর তৈ্রি করেছেন অনেকেই। সেখানেই তো মাটি, খেলার ছলে আপনার স্বপ্নের বালুর রাজপ্রাসাদেও মাটির উপস্থিতি। ঘোড়দৌড়ের খেলায় ঘোড়ার সুরক্ষা এবং পর্যাপ্ত শক্তির জন্য প্লে গ্রাউন্ডকে চার স্তরের অর্থাৎ চারটি ভিন্ন বুনটের মাটিতে সাজানো হয়।
বাবা ডাইও্যম নামে একজন আফ্রিকান রক্ষনশীলতাবাদী বলেছেন, ‘শেষ পর্যন্ত আমরা তাই রক্ষা করবো যা আমরা ভালোবাসি। আমরা তাই ভালোবাসবো, যা আমরা বুঝতে পারবো। এবং আমরা তাই বুঝতে পারবো, যা আমাদের শেখানো হবে’।
সুতরাং মৃত্তিকা কে জানুন, বুঝুন, এর গুরুত্ব উপলব্ধি করুন এবং ভালোবাসুন।
মৃত্তিকা দিবসের বাকি বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে এনভায়রনমেন্টমুভ এর সাথেই থাকুন। আসছে আরো অনেক কিছু…